২০১১ সালের কথা। সে বছর অক্টোবরে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ‘মিড ডে মিল’ (বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার) নামে একটি কার্যক্রম চালু করে। ফরিদপুরের নয়টি উপজেলায় একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়, যেখানে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির বিত্তবান সদস্য এবং স্থানীয় অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তায় শিশুদেরকে কোনোদিন খিচুড়ি, কোনোদিন রুটি ও ডিম, পাউরুটি, কলা, সিঙ্গারা, সমুচা ইত্যাদি খাওয়ানো হতো। এতে ওই সময় বিদ্যালয়গুলোতে উপস্থিতির হার ৯০ শতাংশে পৌঁছে যায়। কিন্তু মাস ছয়েকের মধ্যেই এ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের হার ফের অনেক নিচে নেমে আসে।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জাপানের স্কুলগুলোতেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার অনেক কমে যায়, যার প্রধান কারণ ছিল দেশ জুড়ে চরম খাদ্য ও অর্থের অভাব। জাপান সরকার তখন শিক্ষার্থীদেরকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য মিড ডে মিল প্রকল্প চালু করে। অর্থাৎ, দেশের সকল স্কুলে দিনে এক বেলা বিনামূল্যে খাবার দেয়া শুরু হয়। সেই থেকে শিক্ষার্থীরা আবারো স্কুলমুখী হয়। অভিভাবকেরাও আর তাদের সন্তানদের স্কুলে যাওয়ায় বাঁধ না সেধে, এই ভেবে নিশ্চিন্ত অনুভব করতে থাকেন যে অন্তত একটা বেলা তো সন্তানরা পেট ভরে খেতে পাবে। এর পাশাপাশি যদি কিছু শিক্ষার্জনও করা যায়, তা মন্দ কী!
অনেকেরই ধারণা, এই একটি প্রকল্পের জন্যই ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা, যার পথ ধরে আজ তারা পৃথিবীর সবচেয়ে শিক্ষিত জাতিগুলোর মধ্যে একটি। এবং আজ তারা বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও, মিড ডে মিলের এ ঐতিহ্য ঠিকই অক্ষুণ্ণ রেখেছে। তাই তাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির পেছনে মিড ডে মিলের অবদানকে স্বীকার করে নিতেই হবে।
এবার আবার ফিরে আসা যাক আমাদের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে, এবং একদম বর্তমান প্রেক্ষাপটে। যারা দেশ-কাল সম্পর্কে সচেতন, তাদের নিশ্চয়ই আর আঁচ করতে বাকি নেই যে, চলমান করোনাকালেই শুধু থমকে নেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বরং করোনা-পরবর্তী সময়ে আরো কঠিন দিন আসতে চলেছে। অনেকেরই আশঙ্কা, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ফের চালু হলেও, দেশে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার নিকট অতীতের যেকোনো সময়কে ছাপিয়ে যাবে। কোনো কোনো শিক্ষাবিদ তো এমন অনুমানও করে ফেলেছেন যে, করোনা-পরবর্তী সময়ে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ফিরবে না। অর্থাৎ, গড়ে দেশের প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন বিদ্যালয়ে তাদের শেষ ক্লাসটি করে ফেলেছে।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন মড়ক লাগার পেছনে প্রধান কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক মন্দা। করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, ফলে অর্থনৈতিকভাবেও তারা হয়ে পড়েছে ভঙ্গুর। অচিরে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে হয় না, বরং করোনা-পরবর্তী সময়ে আরো অনেকেই চাকরি হারাবে, বন্ধ হয়ে যাবে তাদের আয়ের পথ। এমতাবস্থায় অনেক বাবা-মায়ের পক্ষেই আর সন্তানকে স্কুলে পাঠানো সম্ভব হবে না। বিশেষত দিন-মজুর কিংবা স্বল্প আয়ের বাবা-মায়েরা চাইবে, বিদ্যমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে তাদের সন্তানরাও যেন স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে কোনো কাজ করতে শুরু করে, নিজেদের অন্নসংস্থান নিজেরাই করে, এবং সংসার চালাতেও কিছুটা অবদান রাখে। এদিকে মেয়ে শিশুদেরকে বাল্যবিয়ে দেয়ার প্রবণতাও অনেক বৃদ্ধি পাবে।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এই আসন্ন বিপদের মাত্রাকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে পারে যে জিনিসটি, তা হলো মিড ডে মিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যে প্রকল্প হাতে নিয়ে সফলতার মুখ দেখেছিল, তার অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশ সরকারও। এতে করে করোনা-পরবর্তী সময়ে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার যতটা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেকটাই হয়তো কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
যদি এমন একটা সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা যায় যে- সন্তানদের স্কুলে পাঠালে একটা বেলা অন্তত তারা পুষ্টিকর খাবার পাবে, তাহলে অনেক দরিদ্র অভিভাবকই দ্বিতীয়বার ভেবে দেখবেন, আসলেই তারা সন্তানের লেখাপড়ায় ইতি টানবেন, নাকি আরো কিছুদিন চালিয়ে নিতে দেবেন। একবার সন্তানের স্কুল ছাড়িয়ে দেবার পর খুব কম অভিভাবকই আবার কোনোদিন তাদেরকে স্কুলে পাঠান। কিন্তু যদি তারা সন্তানকে স্কুলে পাঠানো অব্যাহত রাখেন, তাহলে কিছুটা হলেও সম্ভাবনা অবশ্যই রয়ে যায় যে, একদিন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে এবং তাদের সন্তানরাও স্কুলের চৌকাঠটা নির্বিঘ্নে ডিঙাতে পারবে।
কারো কাছে মনে হতে পারে করোনা-পরবর্তী সময়ে রাতারাতি শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে খাবার দেয়ার প্রস্তাব নেহাতই উচ্চাভিলাষী চিন্তাভাবনা। আসলে কিন্তু তা নয়। সরকারকে নতুন করে কোনো উদ্যোগ নিতে হবে না। ইতোমধ্যেই এ ধরনের একটি নীতিমালা তাদের হাতে রয়েছে। এখন শুধু দরকার সেটির যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন।
বলছি ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯’ এর কথা। ২০১৯ সালের আগস্টে এই খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদনও কিন্তু দেয়া হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হলো ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু করা। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশে করোনাভাইরাস আসার আগে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিড ডে মিলের পাইলট প্রকল্প চালুও হয়। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয় দুর্গম চর, হাওর, উপকূলীয় অঞ্চল, পার্বত্য এলাকা, চা-বাগানের মতো পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোকে। এছাড়া ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সারা দেশব্যাপী এ নীতিমালা বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
এ নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে এমন ৩ থেকে ১২ বছরের শিশুদের জন্য এটি প্রযোজ্য হবে। তাদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তি চাহিদার ক্যালরির ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্কুল মিল থেকে আসা নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তির ১০-১৫ শতাংশ প্রোটিন থেকে এবং ১৫-৩০ শতাংশ চর্বি থেকে আসতে হবে। খাদ্য তালিকার বৈচিত্র্য ঠিক রাখতে ১০টি খাদ্যগোষ্ঠীর মধ্যে অন্তত চারটি বেছে নিতে হবে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে। সরকারের পরিকল্পনা আছে, বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে পাঁচদিন রান্না করা খাবার এবং একদিন উচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন বিস্কুট সরবরাহ করা হবে।
যদি সত্যি সত্যিই ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সারা দেশে ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯’ চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়, বিশেষত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করোনার কারণে সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলগুলোতে আগে এ ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার পরিমাণ অনেকটাই হ্রাস করা সম্ভব। করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশে যদি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে এ নীতিমালা বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু হয়, তাতে যে কেবল দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরাই লাভবান হবে, তা কিন্তু নয়। নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েদেরও চিন্তা অনেকটাই লাঘব হবে। সংসারের অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা করতে তারা নিজেদের কাজে আরো বেশি মনোযোগী হতে পারবেন, যদি সন্তানের দুপুর বেলার খাবারটা নিয়ে তাদের চিন্তা করতে না হয় বা টিফিন তৈরির ঝামেলায় যেতে না হয়।
তাছাড়া মিড ডে মিল কোমলমতি শিশুদের মাঝে সাম্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও রাখতে পারে বড় ভূমিকা। সাধারণত দেশের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়েই বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। অন্য আর কিছুতে না হলেও, দুপুরের টিফিনের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্যটা বেশ প্রকট হয়ে ওঠে। কেউ বাসা থেকে খুব ভালোমানের খাবার আনে, কেউবা অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের, আবার কেউ কেউ তো টিফিন আনতেই পারে না। ফলে এই টিফিনকে কেন্দ্র করেই বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা ব্যবধান গড়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে করোনা-পরবর্তী সময়ে এই ব্যবধান আরো দীর্ঘতর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু যদি স্কুল কর্তৃক সকল শিক্ষার্থীকেই অভিন্ন খাবার দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে তাদের মাঝে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবধানটি তৈরি হবে না। এর পাশাপাশি খুব অল্প বয়স থেকেই শিশুরা জেনে যাবে, সুস্বাস্থ্যের অর্জনে সুষম ও পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব ঠিক কতটা। এ জ্ঞান তাদেরকে স্বাস্থ্য সচেতনও করে তুলবে।
‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯’ অবশ্যই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত একটি অসাধারণ উদ্যোগ, যা প্রশংসার দাবিদার। করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার হ্রাস এবং বিদ্যালয়ে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এটি হতে পারে প্রধানতম হাতিয়ার। আমাদের আশা থাকবে, সরকার যেন এ উদ্যোগের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারে, অতীতের মতো অল্প ক’দিন পরই বন্ধ হয়ে না যায়। যদি তা সম্ভব হয়, তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার যে মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটি অনেকটাই দূরীভূত হবে। পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজি-৪ অনুযায়ী দেশে উন্নত শিক্ষা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যেও আমরা সঠিক পথেই থাকব।