বিংশ শতকের শুরুর কথা। পেনসিলভেনিয়ায় জন্ম নেয়া চার্লস এম. শোয়াব মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ধনকুবের এন্ড্রু কার্নেগির মালিকানাধীন কার্নেগি স্টিল কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট হন। এরপর বেথেলহেম স্টিল কর্পোরেশনের সুবিশাল দায়িত্ব নিয়ে তিনি নিজের ঘরে, মানে পেনসিলভেনিয়ায়, চলে আসেন। সেটা ১৯০৩ সাল। একজন সাধারণ কর্মী থেকে ‘স্টিল ম্যাগনেট’ হিসেবে তার এই উত্থান সত্যিই রূপকথার মতো মনে হয়। ইঞ্জিনিয়ার চার্লস শোয়াবের বয়স তখন মাত্র ৪১ বছর।
কেমন ছিলেন চার্লস শোয়াব নামের এই মানুষটি? তার সম্পর্কে সমসাময়িক দুই মহান দিকপালের দুটো মূল্যায়ন জানাই যথেষ্ট।
প্রথমটি সেলফ হেল্প বিষয়ক লেখালেখির অন্যতম পুরোধা ডেল কার্নেগির। নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের পরিচালনায় চার্লস শোয়াব অবস্থা বুঝে বিভিন্ন সৃজনশীল কৌশল কাজে লাগাতেন। সেসবের কথা ডেল কার্নেগি তার কালজয়ী মাস্টারপিস ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস এন্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল’ (১৯৩৬) বইতে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও জানতেন, তার প্রাক্তন নিয়োগকর্তা ধনকুবের এন্ড্রু কার্নেগি শোয়াবকে বেতন দিতেন বছরে ৭৫,০০০ ডলার। তার উপরে আবার বোনাস ছিলো ১ মিলিয়ন ডলার।
আরেক দিকপাল নেপোলিয়ন হিলকে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডেল কার্নেগি বলেছেন,
চার্লস বেতন পেতেন তার দৈনন্দিন, স্বাভাবিক পারফরমেন্সের জন্যে। আর প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে যেভাবে কাজ আদায় করে নিতেন, বোনাস পেতেন সেটার জন্যে।
শোয়াব সম্পর্কে দ্বিতীয় মূল্যায়ন ইতিহাসখ্যাত উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসনের। কার্নেগি স্টিল কর্পোরেশনে থাকাকালে নিউ ইয়র্কভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান জে. পি. মরগানের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদনে শোয়াবের ভূমিকা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে তার চাতুর্যপূর্ণ দক্ষতা দেখে এডিসন তাকে মাস্টার হাসলার উপাধি দেন।
ঝকঝকে চিন্তার ক্ষুরধার মস্তিষ্কের এই মানুষটির মাঝে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার অদম্য তাড়না ছিলো। আর এটাই জন্ম দিয়েছিলো এক চমৎকার কর্মপদ্ধতির। আজকের পরিভাষায়, প্রোডাক্টিভিটি ফর্মূলার।
এবারে দ্বৈরথের দ্বিতীয় ব্যক্তি। তার নাম আইভি লেডবেটার লী (১৮৭৭ – ১৯৩৪)। জেনে নেয়া যাক, তিনি কেমন ছিলেন।
আইভি লী তার সময়ে আমেরিকার সুবিখ্যাত পাবলিসিটি এক্সপার্ট ছিলেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গ্রাজুয়েট অধুনা পাবলিক রিলেশন্সেরও পথিকৃৎ।
১৯১৩ সালে লুডলো ম্যাসাকারের ফলে বিব্রতকর অবস্থায় থাকা রকফেলারের মতো শীর্ষ ধনী পরিবারের ইমেজ পুনরুদ্ধারে আইভি লী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এছাড়াও তিনি পেনসিলভেনিয়া রেলরোড, ইউনিয়ন প্যাসিফিকের মতো সুবৃহৎ প্রতিষ্ঠানের পাবলিক রিলেশন্স বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তার কাছ থেকে আরও পরামর্শ নিত সেই সময়কার অনেক ব্যাংক, তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্যাকেজিং প্রোডাকশন লাইনসমূহ।
পাবলিক রিলেশন্স পেশায় আসার আগে আইভি লী নিউ ইয়র্ক টাইমসে সাংবাদিকতা করতেন। ফলে পাবলিসিস্ট হিসেবে মিডিয়ার সামনে তার বক্তব্য হতো খোলামেলা, সুস্পষ্ট আর ভণিতাহীন। সাংবাদিকরাও সংবাদ লেখার সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট পেয়ে অত্যন্ত তুষ্ট থাকতো।
আইভি লী তার ক্যারিয়ারে বহুমুখী কর্মতৎপরতার এক বিস্ময়কর উদাহরণ রেখে গেছেন। একদিকে জনহিতৈষী কর্মকান্ডের জন্যে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান রেডক্রসের পাবলিসিটি ডিরেক্টর ছিলেন। আবার অত্যন্ত সাহসী মানুষ হিসেবে ১৯২০ দশকের প্রায় পুরোটাই তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য অনেক চেষ্টা চালিয়েছেন।
মোটকথা, মেধা-স্পষ্ট বক্তব্য-কাজ উদ্ধারের জন্যে ক্ষিপ্র ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারার মতো গুণসমূহের বিরল সংমিশ্রণ ছিলেন আইভি লী।
ঘটনার শুরু যেভাবে
১৯১৮ সাল। নিজের টিমের কর্মদক্ষতা বাড়াতে চার্লস শোয়াব তৎকালীন সুবিখ্যাত উপদেষ্টা আইভি লীর সাথে বৈঠকে বসলেন। দুজন একে অপরকে ভালোভাবেই চিনতেন। দেখা হবার অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই শোয়াব জানতে চাইলেন লীর কাছে,
“আমার টিমের প্রোডাক্টিভিটি আমি কীভাবে আরো বাড়াতে পারি?”
একটু ভেবে লী উত্তর দিলেন,
আমি আপনার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে ১৫ মিনিট সময় কাটাতে পারি?
কাজের মানুষ, তাই শোয়াবের সাথে সাথেই প্রশ্ন,
আপনার পরামর্শের জন্যে কত ফি দিতে হবে?
আগে সাংবাদিকতা আর এখন পাবলিক রিলেশন্স, দুটো পেশাতেই লীর কারবার মানুষ নিয়ে। আর সামনের ব্যক্তিকেও তিনি ভালোভাবেই জানতেন। স্টিল ম্যাগনেটের সামনে তাই তিনি তার মাস্টারস্ট্রোক খেললেন।
লী উত্তর দিলেন,
যদি আমার পরামর্শ কাজ না করে, কোনো অর্থই লাগবে না। আজ থেকে তিন মাস পর্যন্ত দেখুন কী হয়। এরপর ফলাফলে আপনি যেরকম সন্তুষ্ট হবেন, সেই পরিমাণের চেক পাঠিয়ে দেবেন।
একেবারে ক্লাসিক ‘উইন-উইন’ সিনারিও। শোয়াব রাজি হয়ে গেলেন।
আইভি লী মেথড: সহজ ম্যাজিক
সচেতন পাঠক খেয়াল করেছেন যে, শোয়াবের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে লী মাত্র ১৫ মিনিট সময় কাটিয়েছিলেন। এই সময়ে তাদের সাথে একটি অত্যন্ত সরল রুটিন বা কর্মপদ্ধতি তিনি আলোচনা করেছেন। ৫ ধাপের সেই মেথডটি এরকম।
১) প্রতিদিনের কাজ শেষে, আগামীদিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি করণীয় (কাজ বা টাস্ক) কাগজে লিখে ফেলতে হবে। কিছুতেই ছ’টির বেশি লেখা যাবে না।
২) এরপর এই ছয়টি কাজকে তাদের প্র্যাকটিক্যাল গুরুত্ব অনুযায়ী ক্রমানুসারে সাজাতে হবে।
৩) পরের দিন কাজের শুরুতে শুধু প্রথম কাজটিতে সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিতে হবে। প্রথম কাজটি পুরোপুরি শেষ করে তারপর দ্বিতীয় কাজে হাত দিতে হবে। এরপর একে একে সব কাজ এভাবেই শেষ করতে হবে।
৪) দিনশেষে কোনো কাজ অসমাপ্ত থাকলে, তা এর পরের দিনের ছয়টি কাজের একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে।
৫) সপ্তাহের প্রতিটি কর্মদিবসে ধারাবাহিকভাবে এই রুটিন চালিয়ে যেতে হবে। ব্যস।
কেন আইভি লী মেথড (এত কার্যকরী)
প্রথমত, এটা কাজে লাগানো অত্যন্ত সহজ। আমাদের সত্যিকারের কমিটমেন্টের জায়গাগুলো অত্যন্ত ভালোভাবে চিনতে সাহায্য করে এই মেথড। মানুষ হিসেবে আমাদের জটিল চিন্তাধারাকে এরকম সহজভাবে মোকাবেলা করলেই ‘ফ্লাইট অর ফাইট’ স্ট্রেস অনেক কম হয়।
দ্বিতীয়ত, দিনের হাজারো কাজের মাঝে প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাত্র ছয়টি কাজ নির্বাচন করার মাধ্যমে যে কেউ রুটিনের মাঝে থাকা আগাছাগুলো (ডিসট্র্যাকশন বা অগুরুত্বপূর্ণ কাজ) ছেটে দিতে পারে। ছয়টি কাজের তালকা তৈরির ‘কগনিটিভ স্ট্রেস’ দিনের কাজগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাজাতেও সাহায্য করে। তাই লীর এই মেথড ওয়ারেন বাফেটের ২৫-৫ রুলের মতোই। [আগামী পর্ব হবে এই মজার পদ্ধতিটি নিয়ে]
তৃতীয়ত, মেথডটির সারল্যই এর শক্তি। সাধারণভাবে সামনের মিশন যত জটিল হয়, সেটা শুরু করাটাও তত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এসব নেতিবাচক দ্বিধা কাটিয়ে দেয় এই মেথড। ফলে প্রোক্র্যাস্টিনেশন বা দীর্ঘসূত্রিতাকে জয় করা যায় খুব সহজে। কারণ, গুরুত্বের বিচারে ছয়টি কাজের তালিকা তো গতকালই হয়ে গেছে। তাই আজকের দিনের শুরুটা খুব মসৃণ ও দ্বিধাহীন হয়।
চতুর্থত, কাজের ধারাবাহিকতা সুনিশ্চিত হয় এই মেথডের মাধ্যমে। মাল্টি-টাস্কিং নামের উপদ্রব থাকে না। একটি মাত্র কাজের মাঝে পুরোপুরি নিমগ্ন হবার ফলে মনোযোগের (বা মেন্টাল এনার্জি’র) অপচয় হয় খুবই কম। ফলে প্রতিটি কাজের মান ক্রমাগতভাবে খুব ভালো হয়। দিনশেষে তালিকার সব কাজ শেষ হয়েছে দেখে যে কারো আত্মবিশ্বাস বাড়ে দারুণভাবে।
নটে গাছটি কি মুড়লো? না, সেটি আজও বিদ্যমান…
তো শোয়াবের সেই টিমের কী হলো? আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত সরল এই ফর্মূলা বেথেলহেম স্টিল কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অতীব গুরুত্বের সাথে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে লাগলো। তিন মাস পর সবার কাজের সম্মিলিত অগ্রগতি দেখে চার্লস শোয়াব এতটাই সন্তুষ্ট হলেন যে, তিনি আইভি লীকে অফিসে আমন্ত্রণ জানালেন। নিজে অমিত প্রতিভাবান বলেই প্রতিভার কদর করলেন যোগ্যতা অনুসারে। এবং সময়ের সেরা পাবলিসিস্টের সামনে স্টিল ম্যাগনেট এবার তার মাস্টারস্ট্রোক খেললেন। সম্মানী হিসেবে তিনি লীকে ২৫,০০০ ডলারের একটি চেক লিখে দিলেন।
বেথেলহেম স্টিল কর্পোরেশনের জয়যাত্রা অব্যাহত রইল। ধীরে ধীরে তা আমেরিকার বৃহত্তম জাহাজ নির্মাতা এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। এবং চার্লস শোয়াবের মোট সম্পদ গিয়ে দাঁড়ালো ২০০ মিলিয়ন ডলারে।
১৯১৮ সালের লীর পারিশ্রমিক ২৫,০০০ ডলারের বর্তমান বাজারমূল্য ৪,০০,০০০ ডলার মাত্র!
এভাবেই ক্ষুরধার মেধার সশ্রদ্ধ মোকাবেলা আর পারস্পরিক সম্মানবোধের এক নিঃসংকোচ, সুন্দর দ্বৈরথের উদাহরণ লেখা হলো ইতিহাসে।