পুরো কক্ষজুড়ে খেলা করছে প্রায় অর্ধশতাধিক শিশু। প্রত্যেকেরই বয়স চার থেকে ছয় বছরের মধ্যে। চারদিকে থরে থরে সাজানো রয়েছে অসংখ্য খেলনা পুতুল, গাড়ি আর পশুপাখি। এগুলোই ওদের খেলার উপকরণ। কারো রেলগাড়ি ঝমঝম শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে রেললাইন বেয়ে, আবার কারো বিমান একটু আগেই বিমানবন্দর থেকে টেক-অফ করলো। একটু দূরেই হয়তো কেউ আবার ব্যস্ত নিজের খেলনা পুতুলের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে।
শিশুদের সবারই মুখে লেগে আছে নির্মল এক হাসি। দেখে বোঝা যাছে, খুব উপভোগ করছে ওরা। খেলতে খেলতে মাঝেমধ্যে ছোটখাট ঝগড়া বাধছে যদিও, কিন্তু সেটা মিটমাট করে যে যার খেলায় মগ্ন হয়ে পড়ছে।
একটূ দূরে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে শিশুদের খেলা দেখছেন একজন মনোবিদ। একটু একটু করে নিজের নোটবুকে টুকে নিচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য। মাঝেমধ্যে কোনো শিশুকে ডেকে আনছেন নিজের কাছে। অনুচ্চ স্বরে বুুঝিয়ে দিচ্ছেন কিছু একটা। তারপর আবার ফেরত পাঠাচ্ছেন খেলার মাঝে।
রাজধানীর একটি অভিজাত স্কুলে প্রতি সোমবার এ দৃশ্যটি দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে কার্যক্রমটিকে শিশুদের অর্থহীন খেলাধুলা বলে মনে হলেও এটি মূলত একটি সাইকোথেরাপি কৌশল, যার নাম প্লে থেরাপি।
প্লে থেরাপি কী?
‘প্লে থেরাপি‘ কী? এর উত্তর লুকিয়ে আছে প্রশ্নে উদ্ধৃত শব্দযুগলের মাঝেই। সোজা ভাষায় উত্তর দিতে গেলে বলতে হয়, খেলতে খেলতে শিশুদের নানা মানসিক সমস্যার সমাধানের পদ্ধতিই হলো প্লে থেরাপি।
শিশুদের মন সহজ-সরল হয়, এ কথাটি আমরা সকলেই জানি। তাই তাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন বড়দের চাইতে একদমই আলাদা৷ এ কারণেই শিশুদের মনস্তত্ত্বে দেখা দেয় নানা অসঙ্গতি, যার সঠিক চিকিৎসা না করা হলে তা রুপ নিতে পারে মানসিক অস্বাভাবিকতায়।
শিশুদের মনে কী চলছে, সেটি জানবার এক অব্যর্থ কৌশলের নাম প্লে থেরাপি। এই থেরাপিতে একটি শিশুবান্ধব পরিবেশে শিশুদের খেলনা দিয়ে খেলার ব্যবস্থা করা দেয়া হয়। শিশুরা কীভাবে খেলছে, তা পর্যবেক্ষণ করতে সেখানে উপস্থিত থাকেন এক বা একাধিক থেরাপিস্ট। তারা শিশুদের আচরণ ও প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে তাদের সমস্যাগুলো নিরুপণ করেন।
এছাড়াও প্লে থেরাপিতে কাউন্সেলিংয়েরও ব্যবস্থা থাকে, যেখানে একজন শিশু তার নানা সমস্যার কথা থেরাপিস্টের কাছে অকপটে তুলে ধরতে পারে।
কাদের জন্য এই থেরাপি?
যেসব শিশুর মধ্যে ন্যূনতম বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছে, এবং খেলনা দিয়ে খেলবার যোগ্যতা অর্জন করেছে, তাদেরকে প্লে থেরাপির জন্য উপযোগী বলে বিবেচনা করা হয়। সাধারণত এর জন্য তিন থেকে বারো বছর বয়সসীমাকে বেছে নেয়া হয়, কেননা এই বয়সে শিশুদের খেলনার প্রতি আকর্ষণ থাকে সর্বোচ্চ।
যদিও বর্তমান যুগে ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশগুলোর দৌরাত্ম্যে শিশুদের কাছে খেলনার আবেদন ক্রমশই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসছে, তবুও শিশুদের মানসিক সমস্যা সমাধানে প্লে থেরাপির গুরুত্ব রয়ে গেছে আগের মতোই।
ইতিহাস
প্লে থেরাপির ধারণাটি বেশ অাধুনিক শোনালেও এর রয়েছে শতো বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। তবে মজার ব্যাপার হলো শুরুর দিকে এই থেরাপিটির কোনো নাম ছিলো না। সেসময় এটি ছিলো শুধুই একটি কৌশল, যা দ্বারা অন্য কোনো থেরাপি প্রয়োগের সময় শিশুদের মানসিক পরিবর্তন শনাক্ত করা হতো।
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে ষাটের দশক পর্যন্ত একে কেবল একটি কৌশল হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। এরপর কার্ল রজার্স এই কৌশলটিকে একটি সাইকোথেরাপিতে রূপ দেন, যার মূল লক্ষ্য শিশুর মনে জমে থাকা নেতিবাচক আবেগগুলোকে বের করে আনা। এরপর অ্যনা ফ্রয়েড ও মেলভিন ক্লেইনের মতো মনোবিদরা এই থেরাপিটিকে শিশু-চিকিৎসায় প্রয়োগের মাধ্যমে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় করে তোলেন।
প্লে থেরাপির রকমফের
ফিলিয়াল প্লে থেরাপি: এই থেরাপিতে শিশু এবং থেরাপিস্ট বাদেও একটি মধ্যবর্তী শ্রেণী থেরাপিতে অংশ নিয়ে থাকেন, যাদের নাম প্রাইমারি কেয়ারগিভার। এই প্রাইমারী কেয়ার গিভাররা প্রথাগত থেরাপিস্ট নন। মূলত থেরাপিতে অংশ নেয়া শিশুদের বাবা-মা কিংবা অভিভাবকরা প্রাইমারি কেয়ারগিভারের দায়িত্ব পালন করেন। সঠিকভাবে শিশু লালন-পালনের কৌশল শিখতে এবং শিশু-অভিভাবক সম্পর্কের গাঁথুনি শক্তিশালী করতে এই থেরাপির জুড়ি নেই।
নন-ডিরেক্টিভ প্লে থেরাপি: এই থেরাপির আওতায় শিশুই নির্ধারণ করে দেয় থেরাপি কীভাবে চলবে। এখানে থেরাপিস্টের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে না বললেই চলে। এই থেরাপিতে থেরাপিস্ট পর্যবেক্ষণ করেন, শিশুকে তার মনমতো কাজ করবার স্বাধীনতা দেয়া হলে সে সেটিকে কীভাবে ব্যবহার করে।
পাশাপাশি এই অবাধ স্বাধীনতায় শিশুর প্রতিক্রিয়াও পর্যবেক্ষণ করা হয়। এভাবে থেরাপিস্টের কাছে শিশুর মনস্তত্ত্বের একটি বাস্তব চিত্র পরিষ্কার হয়ে ওঠে। যদিও শিশুকে যা খুশি তা করবার স্বাধীনতা দেবার বিষয়টি অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ হওয়ায় বর্তমান সময়ে এই থেরাপির তেমন একটা প্রয়োগ দেখা যায় না।
ডিরেক্টিভ প্লে থেরাপি: এই থেরাপির মূল বৈশিষ্ট্য হলো, থেরাপির শুরুতেই মনোবিদরা শিশুদেরকে খেলার ছলে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে দেন। এরপর খেলবার সময় শিশুরা সেগুলো ঠিক ভাবে মেনে চলতে পারছে কি না তারা তা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। বিভিন্ন রোল-প্লেয়িং গেমসের আদলে এই থেরাপির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। এই থেরাপিতে থেরাপিস্ট প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন এবং থেরাপির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে থাকেন।
স্যান্ড-ট্রে প্লে থেরাপি: এই থেরাপিতে শিশুর হাতে বালি কিংবা কাদামাটি ভর্তি একটি ট্রে ধরিয়ে দেয়া হয়। এরপর তাকে বলা হয় এই কাদামাটি দিয়ে নিজের মনমতো কিছু বানিয়ে দেখাতে। মূলত এই পরীক্ষার মাধ্যমে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শিশুর সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করা হয়। বর্তমানে এই থেরাপির জন্য বালি কিংবা কাদামাটির পরিবর্তে লেগো ব্লকস ব্যবহারের প্রচলন দেখা যাচ্ছে।
প্লে থেরাপির স্থায়ীত্ব
প্লে থেরাপি কতদিন ধরে চলতে পারে, তা পুরোপুরি শিশু এবং তার সমস্যার গভীরতার উপর নির্ভর করে। সে এই থেরাপিতে অংশ নিতে কতটা আগ্রহী, থেরাপির সময় চিকিৎসককে কতটুকু সহযোগিতা করছে, চিকিৎসকের দেয়া পরামর্শ কতোটুকু মেনে চলছে তার ওপর ভিত্তি করে থেরাপির স্থায়ীত্বের তারতম্য ঘটতে পারে। তবে অধিকাংশ প্লে থেরাপি ২০ সেশনে সমাপ্ত হয়, যেখানে প্রতি সপ্তাহে একবার করে সেশন বসে এবং প্রতি সেশনের স্থায়ীত্ব হয় ৩০ থেকে ৫০ মিনিটের মতো।
বিদ্যালয়ে প্লে থেরাপি
একটি শিশু তার দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যালয়েই কাটায়। বিদ্যালয়ের শিক্ষক বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের নিয়ে গড়ে ওঠে তার একান্ত পরিমন্ডল। এজন্য প্লে থেরাপিকে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে দাঁড়িয়েছে সময়ের দাবী।
পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কিছু দেশের বিদ্যালয়গুলোতে এ ব্যাপারে নেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ। এসব বিদ্যালয়ে সপ্তাহে পালা করে পাঠদানের ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করা হয়, যেখানে উপস্থিত থাকেন অভিজ্ঞ মনোচিকিৎসক এবং কাউন্সিলররা। খেলাধুলার ফাঁকে ফাঁকে চলে পর্যবেক্ষণ কাউন্সেলিং। দেখা গেছে এই পদ্ধতি অবলম্বন শিশুদের জন্য বয়ে আনছে বেশ ইতিবাচক ফলাফল।
প্লে থেরাপি শিশুর জন্য একটি স্বাধীন পরিবেশ নিশ্চিত করে, যেখানে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। সূক্ষ্ম খেলার ছলে শিশুর ব্যক্তিত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলো থেরাপিস্টের নজরে ধরা পড়ে বলে শিশুর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে এর জুড়ি নেই। তবে প্লে থেরাপির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি একটি সাইকো-থেরাপি। তাই ওষুধ কিংবা সার্জারির মতো এর কোনো ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তাই দিন যতই যাচ্ছে, ততই প্লে থেরাপি অভিভাবকদের কাছে হয়ে উঠছে নিরাময়ের এক ভরসাযোগ্য কৌশল।