গত কয়েক শতকে প্রচুর পরিমাণে নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্রুকিং ইন্সটিটিউটের মতে, ১৯০০ সালে বিশ্বে মাত্র ১৬টি শহর ছিল যেখানে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষের বাস করতো। বর্তমানে শহরের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি এসব শহুরে এলাকায় অধিবাসীদের সংখ্যাও বেড়েছে। বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনগণের বাস এই শহরগুলোতে।
জাকার্তা
ইন্দোনেশিয়ার অত্যন্ত ব্যস্ত শহর জাকার্তা। এই শহর সম্পর্কে একটি দুর্ভাগ্যজনক সংবাদ হলো এটি বিশ্বের অন্যান্য নিম্নভূমির শহরের মতো ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের জলে। ২০১৯ সালের ডুবন্ত শহরগুলোর মধ্যে জাকার্তা দ্রুততম। দশ মিলিয়ন বাসিন্দা নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার এই নিচু ও উপকূলীয় রাজধানী মূলত জলাভূমির উপর অবস্থিত। তাছাড়া জাকার্তায় বন্যার প্রাদুর্ভাব রয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অধিক নগরায়ন ও শিল্পায়ন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, অপরিকল্পিতভাবে জমি ব্যবহার করার ফলে প্রতি বছরই একটু একটু করে শহরটি সমুদ্রতলে চলে যাচ্ছে। এছাড়া শহরটির বাসিন্দারা যে হারে পাম্পের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে পানি তুলছে তা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ২০১৩ সালে অধিক বন্যার ফলে কয়েকটি স্থানের কিছু অংশ একবারে ২ মিটার নিচে ডুবে যায়। জাকার্তার উত্তর দিক বিগত ১০ বছরে প্রায় ২.৫ মিটার ভূমি সমুদ্রে ডুবে যায়। এছাড়া গড়ে প্রতি বছর ২৫ সেন্টিমিটার ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।
জাকার্তার এই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ফর ক্রিস্টিয়ান এইড’ এর গ্লোবাল লিডার ড. ক্যাথেরিন ক্রেমার বলেন, এই পরিস্থিতির পেছনে মূলত দুটি সমস্যা দায়ী। একটি হলো প্রাকৃতিক এবং অপরটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। তিনি এই বছর বিশ্বের ডুবন্ত শহরগুলোকে নিয়ে একটি রিপোর্টও তৈরি করেন। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সম্প্রতি বিশ্বের অনেক শহরেই জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আর জাকার্তার অধিবাসীদের এই পরিবর্তনের জন্যই বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ক্রেমার জানান, জাকার্তা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- বন্যা, ঝড়-বৃষ্টির কারণে দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আর এর পেছনে জলবায়ুর পরিবর্তনকেই দায়ী করেন তিনি। তাছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বরফ গলে যাচ্ছে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, জাকার্তা ও এমন আরো নিচু শহরগুলো হুমকির মুখে রয়েছে।
বেইজিং
দ্য ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন ধারণা করছে যে, আগামী ২০২২ সালের মধ্যে চীন আমেরিকাকে সরিয়ে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যাভিয়েশন মার্কেট পরিচালনা করবে। ২০১৯ সালে চীন এই টার্গেট পূরণ করার উদ্দেশ্যে কাজ করবে। ২০১৯ সাল থেকেই চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের এয়ারপোর্ট ‘বেইজিং ক্যাপিটাল’ এর কিছু এয়ারলাইনসকে শহরটির নতুন বিমানবন্দর ‘বেইজিং ড্যাক্সিং’ এ পাঠানো হবে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কিংবা সেপ্টেম্বরেই ‘ড্যাক্সিং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’ খোলা হবে। উল্লেখ্য, বেইজিং ক্যাপিটাল বিশ্বের বড় বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। আটলান্টা হার্টসফিল্ড জ্যাকসন বিমানবন্দর এই দিক থেকে সবার উপরে রয়েছে। এটি বিশ্বের একমাত্র বিমানবন্দর যা প্রতি বছর ১০০ মিলিয়ন যাত্রীকে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে সহায়তা করে।
বেইজিং ক্যাপিটাল থেকে সব এয়ারলাইনস ট্রান্সফার করা হয়ে গেলে এর স্লটগুলো অন্যান্য এয়ারলাইনসের কাছে উন্মুক্ত করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, বেইজিংয়ের ড্যাক্সিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মূলত একটি বিশাল এভিয়েশন হাব; যার সেবা শুরু হলে বছরে ১০০ মিলিয়ন কিংবা এরও বেশি যাত্রীকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
ফ্লাইট গ্লোবালের এশিয়া ফিন্যান্স এডিটর এলিস টেইলরের মতে, ড্যাক্সিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দক্ষিণ ও পূর্ব চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে। এশিয়ায় আসতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এশিয়া পৌঁছাতে একজন ব্যক্তিকে অনেক সময় বেইজিং লেওভারের সাহায্য নিতে হয়। তিনি আরো বলেন, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, বেইজিং বিমানবন্দরের মাধ্যমে বিশ্বের এক প্রান্তের সাথে আরেক প্রান্তের লোকজনের যোগাযোগ বাড়ছে। এসব এয়ারলাইনস দীর্ঘ সময়ের ফ্লাইটগুলোর ভাড়া কমিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সকলের নিকট আরো সহজলভ্য করে তুলেছে।
লন্ডন
২০১৯ সালে পরিবর্তনশীল শহর কিংবা শহরের পরিবর্তন নিয়ে যখন আলাপ হচ্ছে, তখন এই তালিকায় লন্ডনের নাম থাকা অনিবার্য। আয়তনের দিক থেকে ইউরোপের সবচাইতে বড় শহর লন্ডন। তাছাড়া শহরটি অর্থনীতির দিক থেকে ইউরোপে পঞ্চম বৃহত্তম। তবে বর্তমানে এই সমৃদ্ধ শহরটি কঠিন সময় পার করছে। আর এর পেছনের কারণটি কারো কাছেই অপরিচিত নয়।
বলছি ব্রেক্সিটের কথা। অর্থাৎ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে তার এক বক্তৃতায় বলেন, যদি পার্লামেন্ট পুনরায় তার প্রস্তাবিত ব্রেক্সিট মেনে নেয় তাহলে ব্রিটেন উন্নয়ন করবে। কিন্তু গত দুই বছরেও থেরেসা মে সংশয়ী পার্লামেন্টকে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দিতে রাজি করাতে পারেননি। ব্রেক্সিট বিষয় নিষ্পত্তি করার জন্য এই বছরের ২৬ মার্চ পর্যন্ত থেরেসাকে সময় দেওয়া হয়েছিল। আগামী দুই মাসের মধ্যে আসলেই এর মীমাংসা করা সম্ভবপর হয় কি না তা দেখার বিষয়।
ব্রেক্সিট বিষয়ে অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ভালো সুযোগ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তবে বিশেষজ্ঞরা জানান, এই অনিশ্চয়তা আসলে কাজে লাগছে না। পাউন্ডের মূল্য কমে যাচ্ছে। লন্ডনের সম্পত্তির বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাংক অব লন্ডন জানিয়েছে, যদি ব্রেক্সিটের প্রস্তাব গ্রহণ করা না হয় তাহলে লন্ডন বড় ধরনের মন্দার শিকার হতে পারে।
আবার অন্যদিকে বলা হয়েছে, ব্রেক্সিটের ফলে প্রায় ৭৫,০০০ ব্যক্তির চাকরি চলে যাবে। শুধুমাত্র লন্ডনের ৫,০০০ ব্যক্তির চাকরি চলে যেতে পারে। ধারণা করা যাচ্ছে, লন্ডনের মহাদেশীয় প্রতিযোগী ফ্রাঙ্কফুট ১০,০০০ চাকরির সুযোগ বাড়াতে পারবে। যারা ব্রেক্সিটের পক্ষে, তারা মনে করছে এসব ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এরকম কিছু হবে না। এখন কোন পক্ষ যে ঠিক তা শুধুমাত্র সময়ই বলে দেবে।
বেঙ্গালুরু
বিশ্বের যেসব শহর অর্থনীতিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর মধ্যে ভারতের বেঙ্গালুরু এক নম্বরে। অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স নামক অ্যানালাইসিস ফার্মের ‘গ্লোবাল সিটিস: দ্য ফিউচার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস লিডিং আরবান ইকোনমিস টু ২০৩৫’ রিপোর্ট অনুসারে, ২০৩৫ সালের মধ্যে বেঙ্গালুরু বিশ্বের দ্রুততম বৃদ্ধিশীল অর্থনীতিতে পরিণত হবে। এর জিডিপি বৃদ্ধির হার শতকরা ৮.৫ ভাগ।
২০১৯ সালে মুদ্রাস্ফীতি থাকা সত্ত্বেও বেঙ্গালুরুর জিডিপি বৃদ্ধির হার হবে ১০.৫%। এই তথ্যটি দেন ‘গ্লোবাল সিটিস রিসার্চ’ এর প্রধান রিচার্ড হল্ট। বেঙ্গালুরু বায়োটেক ও অ্যারোস্পেস সেক্টরে উন্নতি করার কারণেই তাদের অর্থনীতিতে এরকম পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে, চাকরির সুযোগ এবং বেতন বাড়ার ফলে ভোক্তার খরচও বাড়ছে।
যে দেশের বা শহরের অর্থনীতি যত বেশি উন্নত সেখানে অভিবাসীদের ঢলও তত বেশি। এতে সীমিত সম্পদ যেমন ভূমি, পানির উপর বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে এসব সম্পদের ঘাটতি দেখা যায়। তাছাড়া পরিবেশ দূষণও বেড়ে যায়।
ঝংসান
আমেরিকা ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে পুরো বিশ্বের অর্থনীতির উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে। এই যুদ্ধের ফলে দুই দেশই অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকারও হচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বরে তারা আলোচনা করে এই বাণিজ্য যুদ্ধ ৯০ দিনের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।তাদের মধ্যে একে অপরের উপর কর আরোপ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যদিও এই বাণিজ্য যুদ্ধ কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকবে, তবুও ক্ষতি তো যা হওয়ার তা যথেষ্ট হয়েই গেছে। আমেরিকা চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্যে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলারের কর বসায়। ফলে আমেরিকার অধিবাসীরা চীনা পণ্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। আবার অন্যদিকে, চীন আমেরিকান মালপত্রে ১১০ মিলিয়ন ডলারের কর আরোপ করে বসে।
ফলে চীনের বিভিন্ন রপ্তানিকারক শহর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ঝংসানও রয়েছে। এশিয়া ট্রেড সেন্টারের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডেবোরাহ এলমস এই তথ্য দেন। তিনি আরো জানান, ঝংসানের রপ্তানির শতকরা ৭০ ভাগই যায় যুক্তরাষ্ট্রে। তারা যন্ত্রপাতি রপ্তানি করে। আর চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকৃত মালামালে এর পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। এই বছর যুদ্ধবিরতি তাদের লোকসান কতটুকু কমাবে কিংবা যুদ্ধবিরতির পর অবস্থা কী রকম হবে তা সময়ই বলে দেবে।