আসাদের রক্ত- ‘বৃথা যেতে দেবো না!’ পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখতে চেষ্টা করে ওসমান, না হে, মিছিলের মাথা দ্যাখা যায় না। অনেক সামনে উঁচু একটা বাঁশের মাথায় উড়ে আসাদের রক্তমাখা শার্টের লাল ঝাণ্ডা। বাঁশের মাথায় এই শার্ট হলো দস্তিদারের হাতের লাল লন্ঠন। নদীর জাহাজ নয়, নদীই আজ ছুটতে শুরু করেছে দস্তিদারের লাল লন্ঠনের পেছনে। এই পাগলপারা জলোস্রোতকে আজ সামলায় কে?
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’য়ে আসাদের নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে জেগে উঠা গণমিছিলের বর্ণনা ঠিক এ রকম। এক আসাদের মৃত্যুতে সমগ্র পূর্ব বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেই বিক্ষোভের জোয়ার আঘাত করে পরাক্রমশালী সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সিংহাসনে। ঢাকার রাস্তায় শোষিত আর বঞ্চিত মানুষের শ্লোগানে পাকিস্তানের মসনদ কেঁপে ওঠে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম দশকে রাজনীতির ভিত্তিটি ছিল ভীষণ রকমের নড়বড়ে, সংসদীয় গণতন্ত্রের কলকব্জা কাজ করছিল না ঠিকঠাক। ১৯৫৮ সালের সামরিক আইন জারীর মাধ্যমে ক্ষমাতায় চলে আসেন আইয়ুব খান। রাজনীতিবিদদের ধরে জেলের অন্ধকারে নিক্ষেপ করা হয়ে উঠে নিয়মিত ব্যাপার।
এক বছরের মাথায় আইয়ুব খান চালু করেন বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্র। পাকিস্তানের দুই অংশে ইউনিয়ন বোর্ডকে ‘ইউনিয়ন কাউন্সিল’ নাম দেওয়া হয়। ১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশ থেকে চল্লিশ হাজার করে মোট আশি হাজার ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদেরকেই মৌলিক গণতন্ত্রী বা বেসিক ডেমোক্র্যাট হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
সেই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান এক অদ্ভুত গণভোটের আয়োজন করলেন। এই আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আইয়ুব খানের উপর তাদের আস্থা আছে কিনা তা ছিল ভোটের উদ্দেশ্য। ৯৬.৬ শতাংশ মৌলিক গণতন্ত্রীর ‘হ্যাঁ’ ভোটে ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।
১৯৬৫ সালের ঐ একই ধরনের মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটের উপর ভিত্তি করে আবারো নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। আইয়ুব খানের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন ফাতেমা জিন্নাহ। নির্বাচনে প্রায় সব বিরোধী দল মিলে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ফাতেমা জিন্নাহর হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় শেখ মুজিবুর রহমান আইয়ুব খানের কঠোর সমালোচনা করায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ৫৩.১২ শতাংশ আর পশ্চিমে ৭৩.৫৬ শতাংশ ভোটে জিতে যান আইয়ুব খান। বাঙালী শিক্ষিত আর তরুণ জনতার মধ্যে ক্ষোভ আর আক্রোশ তীব্র হতে থাকে। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামক প্রহসনের মাধ্যমে বিশাল জনগণকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়।
সরাসরি ভোটে প্রার্থীকে নির্বাচিত করার সুযোগ থাকলে ফাতেমা জিন্নাহর জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। তবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিকভাবে সচেতন সমাজ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ‘আইয়ুব স্বৈরাচার বিরোধী’ জনমত চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে, ফলে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক বাতিঘর হয়ে উঠে ছাত্রসমাজ। ফলে সামরিক সরকার রাজনৈতিক নেতাদেরকে কারাগারে আটকে রাখলেও সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ছাত্রদের ডাকে তারা নেমে এসেছে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে।
পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্বের বৈষম্য নিয়ে কথা উঠতে থাকে। একই দেশের দুই প্রদেশ নাকি বাঙালীদের উপর প্রভুত্ব কায়েমের জন্যই এই পাকিস্তানের সৃষ্টি। এমন পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক রাজনৈতিক সম্মেলনের মাধ্যমে ছয় দফাকে দেশবাসীর সামনে নিয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় দফা দিয়েই পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর চক্ষুশুলে পরিণত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তবে ইতোমধ্যে বাঙালী জনসাধারণ বুঝতে পারে, ছয় দফা ছাড়া মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব।
দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার আর ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া ছাত্র জনতা আর সাধারণ মানুষ ছয় দফাকে কেন্দ্র করে জেগে উঠতে থাকে। তবে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ছয় দফা তখনো পাশ হয়নি। ছয় দফা পাশ করানোর ব্যাপারে তৎকালীন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ সদস্যরা শেখ মুজিবের সমর্থনে সক্রিয় ছিল। আওয়ামী লীগ ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিয়ে ‘আমাদের বাঁচার দাবী ছয় দফা কর্মসূচী’ এই নামে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করে। দৈনিক ইত্তেফাক ছয় দফা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে, দেশব্যাপী ছয় দফার প্রতি জনমত গড়ে তোলার কাজ শুর হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মীদের সরকার গ্রেফতার শুরু করে। এর প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগের হরতালের ডাকে সাড়া দিয়েছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি।
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। মূলত এর মাধ্যমেই শেখ মুজিবকে রাজনীতি থেকে বাইরে ছুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আইয়ুব সরকার এই মামলার মধ্য দিয়ে নিজের পতনের রাস্তাই তৈরি করে নিয়েছিল।
ক্রমাগত ধরপাকড়ের সম্মুখীন হয়ে আওয়ামী লীগ আর বড় সব রাজনৈতিক দলের সাংগঠিক কাজ চালিয়ে যাওয়াই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে ওঠেছিল। তাই আন্দোলনের মূল কেন্দ্রে উঠে আসে ছাত্রসমাজ। ১৯৬৯ সালে জানুয়ারিতে ছয় দফাকে ছাত্র সমাজের দাবীর সাথে একত্র করে এগারো দফা নিয়ে আন্দোলনে আসে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদে ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া এবং মেনন গ্রুপসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের মোট আটজন ছাত্রনেতা। ছাত্রসমাজের বেশ কয়েকটি দাবীর সাথে ছয় দফাকে যুক্ত করে প্রকাশ করা হয় এগারো দফা। মাওলানা ভাসানী আর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করেছিল।
১৭ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করায় পুলিশ ছাত্রদের উপর হামলা করে। এর প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় ছাত্র ধর্মঘট। ব্যাপক ধরপাকড় আর গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে থাকে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের কর্মসূচী। সরকারি নির্যাতন বন্ধ, আটক ছাত্রদের মুক্তি আর এগারো দফার দ্রুত বাস্তবায়নে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২০ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেয়। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ছাত্রদের মিছিল বের হয় ধর্মঘটের সমর্থনে। মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ঠিক সামনের রাস্তাটি আসাদের রক্তে লাল হয়ে যায়। সেই মূহুর্ত থেকেই আইয়ুব খানের পতনের দিন গোনা শুরু হয়ে যায়।
শহীদ আসাদ, পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এম.এ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের সদস্য ছিলেন, ঢাকা হল (বর্তমান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) শাখার ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব ছিল আসাদের কাঁধে। আসাদের বাবা মাওলানা আবু তাহের নরসিংদীর শিবপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
আসাদ ছিলেন সংগঠক হিসেবে অসাধারণ। নরসিংদীর শিবপুর-হাতিরদিয়া-মনোহরদি এলাকায় কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেন তিনি। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে শিবপুর এলাকায় একটি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তার লেখা দিনলিপিতে পাওয়া যায়, ১৯৬৮ সাল থেকেই একটি সার্বভৌম আর শ্রেণিশোষণমুক্ত দেশের স্বপ্ন দেখে আসছিলেন।
আসাদের মৃত্যুর পর সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে, আইয়ুব গেটের নাম বদলে হয় ‘আসাদ গেট’। আসাদ হয়ে উঠেন প্রতিবাদের প্রতীক। গুলিবিদ্ধ আসাদকে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মৃত্যু হয়। আসাদের রক্তেভেজা শার্ট নিয়ে মিছিলে নামে সাধারণ ছাত্রজনতা। দুই মাইল দীর্ঘ সেই মিছিল কাপিয়ে দিয়েছিল আইয়ুব খানের মসনদ। আসাদের মৃত্যু আলোড়ন তুলে কবি সাহিত্যিকদের মাঝে। হেলাল হাফিজ লিখেন তার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’, সেই বিখ্যাত দুই লাইন,
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
আসাদের মৃত্যুতে রাস্তায় নেমে আসা বিক্ষুব্ধ জনতাকে সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন। ২৪ জানুয়ারি হরতালে ঢাকার রাস্তায় আবারো গুলি চলে। সচিবালয়ের সামনে রুস্তম আলী এবং স্কুলবালক মতিয়ুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। লাশ নিয়ে মিছিল করতে করতে মানুষ গভর্নর হাউজ (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করতে যায়। ছাত্রনেতাদেরকে সামনে রেখে এই আন্দোলন হয়ে উঠে ‘আইয়ুব পতনের আন্দোলন’। ১৪৪ ধারা কিংবা সান্ধ্য আইন দিয়ে ছাত্র আর সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখা কঠিন হয়ে ওঠে।
৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঢাকা সফরে এসে দেখেন যানবাহন, স্কুল-কলেজ আর দেয়ালে দেয়ালে “আইয়ুব ফিরে যাও” লেখা সম্বলিত পোস্টার। পুরো পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক কাজকর্মের চাকা মূলত অচল হয়ে আছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। ভাসানীর নেতৃত্বে গায়েবী জানাজা হয় জহুরুল হকের। চারদিকে সাধারণ জনতা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মুখে মুখে তপ্ত স্লোগান, “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।”
সাধারণ জনতা এইদিন আগুন দেয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারক বিচারপতি এম. এ. রহমানের বাসভবনে। বাদ যায়নি কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহবাজউদ্দিন, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা হাসান আসকারি, প্রাদেশিক যোগাযোগমন্ত্রী সুলতান আহমদের বাসভবন। আরো অনেক সরকারি বাসভবনে আগুন দিতে উদ্যত হয় সাধারণ জনতা। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যা করা হয় শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে।
এই ঘটনাবলীর পথ ধরেই ঊনসত্তরের ২৫ মার্চ গদি ছাড়েন আইয়ুব খান। এক আসাদের মৃত্যুতে দারুণভাবে আবেগতাড়িত হয়েছিল পুরো জাতি। আসাদের রক্তমাখা একটি শার্টের মিছিল থেকেই শহীদ হয়েছিলেন রুস্তম, মতিয়ুর। বাঙালী জাতির ইতিহাসে তাই আসাদ চিরস্মরণীয়। শামসুর রাহমান তার ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় লিখেছিলেন,
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।