বিশ্ব পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক দেশের নাম আর্মেনিয়া। দেশটি আয়তনে তেমন বড় না হলেও এর রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। প্রকৃতির লীলাভূমি আরমেনিয়ার সৌন্দর্য তার ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মতোই সমৃদ্ধশালী। ১১,৪৮০ বর্গ মাইলের ছোট্ট এই দেশ নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রায় ৩,০০০ বছরের প্রাচীন সংস্কৃতি, ভাষা আর ঐতিহাসিক সব নিদর্শন সংরক্ষণ করে আসছে। দেশটির উত্তরে জর্জিয়া, দক্ষিণে ইরান, পূর্বে আজারবাইজান ও পশ্চিমে তুরস্ক। দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৯,৩৪,২৫২।
আর্মেনিয়ার চারপাশে ঘিরে আছে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী দেশ। ফলে দেশটিকে বার বার বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়েছে। রোমান, বাইজান্টাইন, আরব, তুরস্ক, পারস্য, মঙ্গোল, জর্জিয়া, রাশিয়ার মধ্যে পালাক্রমে হাতবদল হয়েছে দেশটি। দেশটির পশ্চিমাংশ দীর্ঘদিন অটোম্যান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। সে সময় তুর্কিরা আর্মেনীয়দের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। এই ভয়ঙ্কর গণহত্যা থেকে নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নেয়। আর এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আর্মেনীয়দের বসতি গড়ে ওঠে।
বিশ্বের প্রাচীন সংস্কৃতি আর সভ্যতা দেখার জন্য প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু পর্যটক আর্মেনিয়া ভ্রমণে আসেন। দেশটিতে দেখার আছে অনেক কিছু। এই দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও বিখ্যাত। এর চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে পুরানো দিনের বেশ কয়েকটি মৃত আগ্নেয়গিরির শৃঙ্গ। দেশটির বিভিন্ন শহরের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে চোখে পড়বে শুধু সবুজের সমারোহ। প্রত্যেকটি রাস্তায় দেখা যায় জুনিপার গাছের সারি। আর চোখে পড়বে সবুজে ঢাকা প্রচুর পার্ক। এছাড়া দেশটির নানা প্রান্তে অসংখ্য আর্ট গ্যালারি, মিউজিয়াম, মিউজিক হল, থিয়েটার হল ছড়িয়ে আছে।
ইয়েরেভান
আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভান। এটি আর্মেনিয়ার এক ঐতিহাসিক শহর। এই শহরকে ভালভাবে জানতে পারলেই পুরো দেশটি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। শহরের কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত আর্মেনিয়ান গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করলে একটি জাতির বেঁচে থাকার এক রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। শহরের প্রধান আবোভিয়ান স্ট্রিট ধরে হেঁটে যেতে যেতে প্রাচীন আর্মেনীয় সংস্কৃতির নানা ছবি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কাছেই রিপাবলিকান স্কয়ার। বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত শানবাঁধানো এক উন্মুক্ত চত্বর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এখানে স্থাপন করা হয়েছিল এক স্মৃতিসৌধ। সৌধের অপরদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর্ট মিউজিয়াম, হিস্ট্রি মিউজিয়াম, একটি মিউজিক হল ও রাষ্ট্রপতি ভবন। অন্যদিকে রাজপথ আর পানির ফোয়ারা। পথে পথে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট-বড় ক্যাফে আর রেস্তোরাঁ। শহরটি অনেকের কাছে ক্যাফে অব সিটি হিসেবেও পরিচিত। এই শহরেই দেশটির একমাত্র মসজিদ ব্লু মস্ক অবস্থিত।
কাসকেড
আর্মেনিয়ার ইয়েরেভান শহরের আরেকটি দর্শনীয় স্থান কাসকেড, এক মনোরম প্রমোদ উদ্যান। ফুলের বাগান, তার দু’ধারে পায়ে চলা পথ। পথের ধারে ধারে বেঞ্চ পাতা। উদ্যানের শোভা বাড়াচ্ছে দর্শনীয় সব পানির ফোয়ারা। উদ্যানটি নানা দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যে উদ্ভাসিত। বাগানের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য, প্রস্তর মূর্তি, পিতল কিংবা তামার ছোট ছোট টুকরো দিয়ে তৈরি বিভিন্ন রকমের জীবজন্তুর ক্যালিগ্রাফি সাজানো আছে। চারদিকে যেন বিমূর্ত সব শিল্পকলার সমাহার। সবসময় ছোট-বড় সব ধরনের মানুষের কলতানে উদ্যানটি মুখরিত।
মাদার আরমেনিয়া ওয়ার মেমোরিয়াল
১৯৯২ সালে আর্মেনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর দেশটিতে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। তার স্মারক হিসেবেই একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। অনেক উঁচু বেদির ওপর স্থাপন করা হয়েছে তলোয়ার হাতে এক নারীর প্রস্তর মূর্তি। স্মৃতিস্তম্ভটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যেন শহরের যেকোনো স্থান থেকে এটি দেখা যায়। স্মৃতিস্তম্ভটির বেদির ওপর রুশ বর্ণমালায় লেখা ‘মাইর আইয়াস্তান’, অর্থাৎ মাদার আরমেনিয়া ওয়ার মেমোরিয়াল।
এসমিয়াদজিন
ইতিহাসে আর্মেনিয়া প্রথম দেশ যারা খিস্টান ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এখানকার শতকরা ৯০ ভাগ লোক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। এসমিয়াদজিন খ্রিস্টানদের এক পবিত্র ধর্মস্থান, একইসাথে দর্শনীয় স্থানও বটে। স্থানটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
স্থানটি খ্রিস্টান ধর্মানুসারীদের কাছে বড় পবিত্র। বিভিন্ন দেশের খ্রিস্টান মিশনারি থেকে পুরোহিতরা এখানে অধ্যয়নের জন্য আসেন। গির্জার বাইরে পর্যটকদের জন্য দোকানের পসরা বসিয়ে আছে স্থানীয়রা। গির্জার মধ্যেই রয়েছে একটি ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা, যেখানে যিশুর সাথে জড়িত বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আছে।
মাতেনাদারান মিউজিয়াম
আর্মেনীয় ভাষায় ‘মাতেনাদারান’ শব্দের অর্থ সংরক্ষণশালা। এর প্রকৃত নাম ‘মাতেনাদারান ইনস্টিটিউট অব অ্যানসায়ন্ট ম্যানুস্ক্রিপ্টস’। প্রাচীন পান্ডুলিপির অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য তথ্যভিত্তিক বিশ্বের এক বৃহত্তম সংগ্রহশালা। এ ধরনের সংগ্রহশালা পৃথিবীতে খুবই বিরল। এই সংগ্রহশালায় রয়েছে ২,০০০ ভাষায় লেখা ২৩,০০০ এরও বেশি পান্ডুলিপি এবং ৩০,০০০ নথির এক অপূর্ব সংগ্রহ।
প্রাচীন গসপেলের পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে মাতেনাদারান আর্কাইভে। এখানে আর্মেনীয় ভাষার উৎপত্তি থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত ভাষার ক্রমবিকাশের ধারা দেখানো হয়েছে। মিউজিয়ামের পাশেই রয়েছে একটি সুন্দর স্থাপত্যকর্ম।
দিলিজান জাতীয় উদ্যান
আর্মেনিয়ার চারটি দর্শনীয় জাতীয় উদ্যানের মধ্যে এটি অন্যতম। ২০০২ সালে উদ্যানটি দেশটির জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই উদ্যানটি প্রাকৃতিক খনিজ প্রস্রবনের জন্য বিখ্যাত। বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই উদ্যানকে ঘিরে এক সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করা হয়েছে। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন গির্জা ও মনস্ট্রি। হঘহারসিন মনস্ট্রি, গোশভক মনস্ট্রি, তার পাশে মাতোসভাঁক মনস্ট্রি, আখনাবাত গির্জা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
লেক সেভান
আর্মেনিয়ার প্রাণ হচ্ছে এই লেক সেভান। ককেশাস পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই লেক আর্মেনিয়ার মোট আয়তনের শতকরা পাঁচ ভাগ দখল করে আছে। এর চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় গির্জা। এখানকার পাহাড়ের চূড়োয় অবস্থিত সেভেনাভাঙ্ক গির্জা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। পাথর বসানো সংকীর্ণ পথ ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে ওপরের দিকে। সারি সারি দর্শক যিশুর দর্শন পেতে গির্জায় প্ররবেশ করেন। গির্জাকে সামনে রেখে চারদিকের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখার মতো।
উঁচু পাথরের রেলিং দিয়ে ঘেরা সম্পূর্ণ পাহাড়চূড়া। দু’চোখ ভরে উপভোগ করা যায় প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্য। মাথার ওপর নীল আকাশ। নীচে লেকের জলে যেন তারই প্রতিবিম্ব। ছোট ছোট লঞ্চে করে যাত্রীরা চলেছে সরোবর বিহারে। লঞ্চের ডেকে বসে পর্যটকেরা প্রকৃতির সুধা আকন্ঠ পান করে চলেছেন।
এই লেকের চারদিক ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড়। চারপাশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে ভ্রমণার্থীদের অনেকেই একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য আশ্রয় নেন আশেপাশের কোন একটি পাহাড়ের পাদদেশে। আবার কেউ ট্রেকিংয়ের নেশায় পাহাড়গুলোতে উঠতে থাকেন। পাহাড় ঘেঁষে তৈরি হওয়া কিছু রেস্তোরাঁয় পরিবেশন করা হয় লেকের মাছ। পাহাড়ে পথের ধারে আছে স্যুভেনির ও ছবির দোকান।
টেম্পল অব গারনি
বহু ধর্ম আর সংস্কৃতির এক সহনশীল ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আর্মেনিয়ার গারনি গ্রামে অবস্থিত টেম্পল অব গারনি। আমের্নিয়ার খ্রিস্টান-পূর্বযুগের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মন্দিরটি প্রথম শতকে নির্মিত। এর প্রকৃত নাম নাম মির গড অব সান। মন্দিরটি তেমন বড় নয়। ছোট ছোট সিঁড়ি উঠে গিয়েছে অনেক উঁচু পর্যন্ত। মজবুত স্তম্ভের ওপর দাঁড়ানো মন্দিরটি প্রাচীনযুগের স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন।
গিমরি
গিমরি আর্মেনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। আর্মেনিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক পীঠস্থান এটি। এখানেই রয়েছে সামাজিক জীবনযাত্রার ওপর প্রতিষ্ঠিত ডায়টোগশিয়ান মিউজিয়াম, ন্যাশনাল আর্কিটেকচার অব গিমরি, সের্গেই মের্কুরভ হাউজ-মিউজিয়াম, আসলামাজিয়ান সিস্টার হাউজ-মিউজিয়াম প্রভৃতি। এখানেই প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর কুমেইরি অবস্থিত । প্রাচীন অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা এখানে দেখতে পাওয়া যায়।
শিকহঘ স্টে রিজার্ভ ফরেস্ট
শিকহঘ আর্মেনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে পরিচিত। ২০০৫ সালে এই অঞ্চলকে ঘিরে বন্য পশুপাখিদের এক অভয়াশ্রম তৈরি করা হয়েছে। এখানে ১,১০০ প্রজাতির অধিক গাছ রয়েছে। জীবজন্তুর মধ্যে চিতাবাঘ, হরিণ, ভালুক এবং বন্য ছাগল ছাড়াও নানা বৈচিত্রময় পাখি দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও এখানে বেশ কয়েটি প্রাকৃতিক ঝর্ণা রয়েছে। এর আশেপাশের চেখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ভ্রমনার্থীদের এখানে আসার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।
এসব ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বাইরেও রয়েছে আরও বেশকিছু সাংস্কৃতিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ স্থান যেমন, গোরিস, ভেনদেনজোর, সুুুসি ও জারমুক,খোর ভাইরাপ, তাতেভ প্রভৃতি। তাহলে আর দেরি কেন? চলুন বেরিয়ে পড়ি অদেখা, অজানা আর্মেনিয়ার পথে প্রান্তরে।