বলা হয় যে, একটি বাসায় বসবাসকারী মানুষদের পরিচয় অনেকখানি তুলে ধরে সেই বাসার রান্নাঘরটি। খাবার তৈরি করতে গিয়ে রান্নাঘরেই সবথেকে বেশি বর্জ্য তৈরি হয়, ময়লা হয় রান্নাঘরটি, আর একে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটিও একটি গুরুদায়িত্ব। সমাজতত্ত্বের ভিত্তিতে পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই রান্নাঘর, যেহেতু বাহ্যিক বর্জ্যের সিংহভাগই তৈরি হয় এখানে।
কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায়, আমাদের পরিবেশকেও সংজ্ঞায়িত করা হয় দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে। একটি হলো বাহ্যিক পরিবেশ, অপরটি অভ্যন্তরীণ পরিবেশ। বাহ্যিক পরিবেশের সংজ্ঞা সমাজতত্ত্ব অনুযায়ী একইরকম রয়ে গেছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ পরিবেশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে জীবদেহের অভ্যন্তরীণ কার্যব্যবস্থাকে।
অভ্যন্তরীণ এই পরিবেশের রান্নাঘর হিসেবে তুলনা করা হয় লিভার তথা যকৃতকে। পরিপাকতন্ত্রের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই যকৃৎ। একটি রান্নাঘরে যেমন তাপ উৎপন্ন হয়, সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করে সেখানে; তেমনিভাবে জীবদেহের রান্নাঘর তথা যকৃতের অন্যতম প্রধান একটি কাজ হলো তাপ উৎপাদনের মাধ্যমে পুরো দেহে সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা।
যদি খোঁজ করা হয়, আমাদের আশেপাশেই এমন অসংখ্য রোগী পাওয়া যাবে যারা যকৃতের রোগে ভুগছেন। হৃদরোগগুলো ঢালাওভাবে যেমন প্রচারিত হয়, সবাই সচেতন থাকতে চেষ্টা করেন তাও ভয় পান অনেকে। যকৃতের ক্ষেত্রেও মানুষের তেমনি সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন, সবচেয়ে বেশি সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে। খাবার বেশি খেলে আপনার ডায়াবেটিস হয়েই থেমে থাকবে তা নয়, আরো খারাপের দিকেও যেতে পারে। আপনি যা-ই খাবেন, সবকিছুর চাপ যকৃতকেই সামাল দিতে হবে। আপনার গৃহীত খাদ্যের উপরই নির্ভর করছে এই সুবিশাল অঙ্গটির ভালো থাকা।
যকৃতের রোগ মানেই যে জন্ডিস, তা নয়। এই জন্ডিসের ব্যাপারে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে আমাদের। জন্ডিস কোনো রোগ নয়, রোগের একটি লক্ষণমাত্র। এই লক্ষণটি অনেক রোগের কারণেই প্রকাশ পেয়ে থাকতে পারে, কেবলি যে হেপাটাইটিস রোগের লক্ষণ তা নয়। যকৃতের সবগুলো কাজের মধ্যে একটি প্রধান কাজ হলো নির্দিষ্ট আয়ু শেষে রক্ত অর্থাৎ রক্তের লোহিত কণিকাগুলো ধ্বংস করা।
লোহিত কণিকা ধ্বংস হয়ে হলুদ রঙের বিলিরুবিন উৎপাদন করে থাকে যকৃৎ। এখন কোনো কারণে যদি অত্যধিক পরিমাণে লোহিত কণিকা ধ্বৎস হয়; তখন ত্বক, চোখের সাদা অংশকে সাধারণের তুলনায় অধিক হলুদ দেখতে পাই, সেটিকেই বাইরে থেকে আমরা জন্ডিস হিসেবে চিহ্নিত করি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় জীবদেহের রোগকে দু’ভাবে বর্ণনা করা যায়।
একধরনের রোগ হয়ে থাকে সংক্রামক, যা কোনো আণুবীক্ষণিক জীবের মাধ্যমে প্রাণী থেকে প্রাণীতে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। আর রয়েছে অসংক্রামক রোগ, যে রোগগুলোর জন্য কোনো জীবাণুকে দায়ী করা যাবে না। এসকল রোগের পেছনে থাকে কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর কিংবা দৈনন্দিন জীবনযাপনের শর্ত। আপনি কায়িক শ্রম করেন না, অতিরিক্ত পরিমাণে চর্বিযুক্ত খাদ্যগ্রহণ করেন; এসব অভ্যাস আপনাকে কিছু নির্দিষ্ট রোগের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। যেমন ওজন বৃদ্ধি কিংবা মোটা হয়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি। যকৃতে সংক্রামক কিংবা অসংক্রামক উভয় রোগই দেখা দিতে পারে। যারা মদ্যপান করেন, যকৃতে অসংক্রামক রোগের জন্য মদ্যপান একটি গুরুত্বপূর্ণ রিস্ক ফ্যাক্টর।
যকৃতের রোগগুলোর মাঝে মরণঘাতী কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে লিভার ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস কিংবা হেপাটাইটিস-সি সংক্রমণকে। ক্যান্সার কিংবা লিভার ক্যান্সার একটি অসংক্রামক রোগ, এর পেছনে কোনো অণুজীবের হাত নেই; রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর, এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসও যেমন হতে পারে, তেমনিভাবে সংক্রামক রোগও দায়ী থাকতে পারে।
ভ্যাক্সিনেশন পদ্ধতি এবং সচেতনতার দরুণ যকৃতের সংক্রামক রোগ অনেকটাই কমে এসেছে (যদিও হেপাটাইটিস-সি সংক্রমণ নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এখনো আশার আলো দেখা বাকি)। যকৃতকে আরো ভালো রাখা সম্ভব যদি আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা যায় এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পারিবারিকভাবে যদি নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা যায়, তাহলে পরবর্তী জেনারেশনের জন্য এটি বিরাট সুফল বয়ে আনতে সক্ষম।
এই খাদ্যাভ্যাস কীরূপে পরিবর্তিত ও নিয়ন্ত্রিত করা যায়, তা নিয়ে বহু বছর ধরেই চলছে গবেষণা। গবেষণার ফলাফলগুলো থেকে প্রতিবারেই এই তথ্যই উঠে এসেছে যে, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে যকৃতের বহু রোগ কমিয়ে আনা সম্ভব, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। যকৃতের ক্যান্সারের ব্যাপারটি বিশদভাবে বুঝতে হলে, বেশি কিছু জিনিসে পূর্বধারণা প্রয়োজন।
ইনসুলিন শব্দটির সঙ্গে নিশ্চয়ই সকলের পরিচিত রয়েছে। ইনসুলিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি হরমোন। এই হরমোনটির কাজ হলো, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেড়ে গেলে, গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেনে রূপান্তিরত করে যকৃতে সঞ্চয় করে রাখা; ফলস্বরূপ রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে না। জীবদেহে উপস্থিত সবকিছুরই নির্দিষ্ট সীমা রয়েছে যা লঙ্ঘনে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। গ্লুকোজের পরিমাণ যাতে না বাড়তে পারে এ লক্ষ্যে কাজ করে থাকে ইনসুলিন হরমোনটি।
ইনসুলিন শব্দটির সাথেই চলে আসে ডায়াবেটিসের কথা। ইনসুলিনের জটিলতা দু’ভাবে দেখা দিতে পারে জীবদেহে। একভাবে হতে পারে, ইনসুলিন প্রস্তুতকারক কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে ইনসুলিন তৈরি হয় না। আরেকভাবে হতে পারে, জীবদেহে ইনসুলিন ঠিকই তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তারা কার্যসম্পাদনে অক্ষম হয়ে পড়েছে। গ্লুকোজের পরিমাণ কমানোর জন্য তারা কাজ করতে পারছে না। ফলে, আমাদের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের দরুণ রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যেতে শুরু করে।
চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, নিয়মিত শস্যদানা ও শাক-সবজি গ্রহণ ইনসুলিনের অকার্যকারিতা, রক্তে অব্যবহৃত ইনসুলিনের আধিক্য এবং অণুজীব সংঘটিত কোনো ইনফেকশনের মতো রোগগুলোকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এখন এই রোগগুলোই মূলত যকৃৎ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ফলে, একদল গবেষক সিদ্ধান্ত নেন যে, দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় শস্যদানা সম্পূর্ণরূপে খাওয়ার সাথে যকৃৎ ক্যান্সারের কোনো যোগসাজশ রয়েছে কিনা ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা হবে। এর আগে কখনো যকৃৎ ক্যান্সারের সাথে খাদ্যতালিকার সম্পর্ক নিয়ে কোনোরূপ গবেষণা করা হয়ে উঠেনি।
যে-ই ভাবা সে-ই কাজ। ঢালাওভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হলো এই গবেষণার জন্য। সিদ্ধান্ত হলো, এই গবেষণার উপাত্তের হিসেবে ব্যবহার করা হবে প্রায় চারযুগ পূর্বে সংঘটিত হওয়া আমেরিকার দুইটি গবেষণার ফলাফলগুলো। গবেষণা দুইটির একটিতে সাবজেক্ট হিসেবে সেসকল নারী ছিলেন যারা পেশায় নার্স; আরেকটি গবেষণা করা হয় সকল পুরুষ চিকিৎসকদের উপর। প্রতি চার বছর পর পর তাদেরকে একটি করে প্রশ্নপত্র দেওয়া হতো, সেখানে তাদেরকে ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার অর্থাৎ সবজি জাতীয় খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ করতে হতো।
এই গবেষণাটি চলেছিলো প্রায় ৩২ বছর পর্যন্ত। এই ৩২ বছরের সময়সীমায় দেখা যায় যে, গবেষণায় অংশ নেয়া এক লক্ষ পঁচিশ হাজার মানুষের মাঝে ১৪১ জন মানুষের যকৃৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।
এই গবেষণাপত্রের একজন প্রধান লেখক হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ হাং এক বক্তব্যে বলেন যে, অধিক পরিমাণে শস্যদানা খেলে যকৃৎ ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসে, যাদের খাদ্যতালিকায় শস্যদানা কম কিংবা অনুপস্থিত, দেখা গেছে, তাদেরই যকৃৎ ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে যায়। তিনি এও বলেন যে, শস্যদানার কোনো অংশ ব্যতিরেকে খাওয়া চলবে না। কেননা এর পুরো অংশটুকুই ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে থাকে।
একটি শস্যদানা অর্থাৎ কোনো উদ্ভিদের বীজের তিনটি অংশ থাকে, বাইরের দিকে আবরণীর মতো একটা স্তর থাকে যাকে তুষ বলেই আমরা চিনি, তুষের নিচে থাকে শস্য; এই শস্য অর্থাৎ সঞ্চিত অংশটুকুই মূলত আমাদের খাবার, শস্যের ভেতর লুকিয়ে থাকে উদ্ভিদ ভ্রূণ, যা এই সামান্য বীজ থেকে পূর্ণাঙ্গ উদ্ভিদে পরিণত হবার ক্ষমতা বা নীলনকশা বহন করে থাকে।
আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় উপস্থিত শস্যদানা জাতীয় খাবার হলো আটা, ময়দা, পাউরুটি, রুটি কিংবা ভাত; এসবই শস্যদানা জাতীয় খাবারের মধ্যে পড়বে কিন্তু এতে একটি শস্যবীজের কেবল শস্য অংশটুকু উপস্থিত থাকে। গ্রহণোপযোগী করে তুলতে গিয়ে শস্যদানা থেকে তুষ এবং ভ্রূণ অংশটুকু বাদ পড়ে যায়। বাকি থাকা শস্য অংশের পুরোটাই সাধারণ শর্করা জাতীয় খাবার, যাতে অল্প পরিমাণে প্রোটিন ও মিনারেল ছাড়া আর কিছুই নেই। গুরুত্বপূর্ণ সব খাদ্য উপাদান বাদ পড়ে যায় তুষ এবং ভ্রূণের সঙ্গে।
ডাঃ হাং ও তার পুরো দল লক্ষ্য করেন যে, যকৃৎ ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য শস্যবীজের বাইরের আবরণীটির বিশদ ভূমিকা রয়েছে, অথচ এই আবরণীটিকে সবসময়ই আমাদের খাদ্যতালিকা থেকে সরিয়ে রাখা হয়। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর ক্যান্সার রিসার্চ এর বার্ষিক সভায় যকৃৎ ক্যান্সারের উপর সম্প্রতি এই গবেষণা রিপোর্টটি উপস্থাপন করা হয়।
যকৃতের ক্যান্সার একদিনে হুট করে হয়ে যাবার সম্ভাবনা এক শতাংশও নেই। খাদ্যাভ্যাসে নিয়মিত শস্যদানা সম্পূর্ণরূপে উপস্থিত থাকা এই বিষয়টিকেই নিশ্চিত করে যাতে করে ইনসুলিনের কার্যে কোনো হেরফের ঘটতে না পারে। ফলস্বরূপ আপনি যে কেবল যকৃতের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি থেকেই বেঁচে যাবেন তা নয়; ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো জটিল রোগের ঝুঁকিও কমে আসবে।