মানুষ আবেগপ্রবণ প্রাণী। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ভয়-ভালোবাসা প্রভৃতি আবেগের মেলবন্ধনেই আমাদের জীবন। নানারকম এই আবেগের মধ্যে সুখের সন্ধানেই আমরা বেশি ব্যস্ত থাকি। আমরা সুখী হতে চাই, আমরা আত্মিক শান্তি পেতে চাই। আমাদের ব্রেইনওয়েভ ও অবচেতন মন এই সুখ অনুসন্ধান ও প্রাপ্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা সহজেই ভুলে যাই যে, আমরা নিজেরাই আমাদের বাস্তব জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
আমাদের জীবনটা আসলে বাহ্যিক কোনোকিছুর প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না, নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের নিজেদের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা। তাই সচেতনতার গভীর স্তর সম্পর্কে জ্ঞানলাভের মাধ্যমে আপনি আপনার অবচেতন মনের দরজাকে খুলে দিতে পারেন এবং আপনার নিজের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তৈরি করতে পারেন আপনার জীবন বাস্তবতাকে। এজন্য আপনাকে জানতে হবে ব্রেইনওয়েভ সম্পর্কে, জানতে হবে ব্রেইনওয়েভ ও অবচেতন মন কীভাবে আপনার মানসিক অবস্থা ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সে সম্পর্কে।
আমাদের মস্তিষ্ক কয়েক বিলিয়ন নিউরন নিয়ে গঠিত। এই অসংখ্য নিউরন ইলেকট্রনিক পালসের সাহায্যে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে। নিউরনগুলো একসাথে হয়ে যখন একটি সিগন্যাল তৈরি করে, তখন মস্তিষ্কে অনেকগুলো বৈদ্যুতিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। এগুলোকে বলা হয় ব্রেইনওয়েভ প্যাটার্ন, কারণ এদের ধর্ম প্রায় তরঙ্গের মতো। ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্কের এই বৈদ্যুতিক পালসগুলোকে মস্তিষ্কের আবরণীতে EEG (Electrocephalogram) নামক যন্ত্র লাগিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
নানারকম কম্পাঙ্কের পাঁচ ধরনের ব্রেইনওয়েভ রয়েছে। এই ব্রেইনওয়েভগুলো নির্ধারণ করে আমরা কতটা সফলভাবে চাপ নিয়ন্ত্রণ করছি, কাজে কতটা মনোযোগ দিতে পারছি বা রাতে কতটা ভালো ঘুমাচ্ছি। যদি এই পাঁচ ধরনের ব্রেইনওয়েভের কোনোটা কম, কোনোটা বেশি উৎপন্ন হয়, তাহলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই প্রত্যেক প্রকার ব্রেইনওয়েভই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক প্রকার ব্রেইনওয়েভই আমাদেরকে কোনো না কোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। সেটা হতে পারে নতুন কোনো বিষয়ে শেখা বা দীর্ঘ কর্মময় দিনের শেষে বিশ্রাম। আমরা যখন সক্রিয় থাকি, তখন উচ্চ কম্পাঙ্কের ব্রেইনওয়েভ কাজ করে। আর যখন শিথিল থাকি বা ঘুমিয়ে থাকি, তখন কম কম্পাঙ্কের ব্রেইনওয়েভ কাজ করে।
কম্পাঙ্কের উচ্চক্রম অনুসারে ব্রেইনওয়েভগুলো হচ্ছে গামা, বিটা, আলফা, থিটা এবং ডেলটা। ওয়েভগুলোর বিস্তারিত বর্ণনার আগে বলে নিই, কোনো একটি নির্দিষ্ট ব্রেইনওয়েভ সম্পর্কে বলা হচ্ছে মানে সেই ব্রেইনওয়েভটি প্রকট। আপনি সারাদিন কাজ করলেন। তারপর যদি আপনার ইইজি করা হয়, তাহলে পাঁচরকম ব্রেইনওয়েভই ধরা পড়বে। কিন্তু বিশেষ একটি ব্রেইনওয়েভ আপনার সারাদিনের সচেতনতার উপর ভিত্তি করে প্রকট হয়ে ধরা পড়বে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। সাধারণত ঘুমের সময় কম কম্পাঙ্কের অর্থাৎ ধীরগতির ব্রেইনওয়েভের সমন্বয় দেখা যায়। কিন্তু র্যাপিড আই মুভমেন্টের (REM) সময় গামা ওয়েভের সম্পৃক্ততাও খুঁজে পাওয়া গেছে।
ব্রেইনওয়েভগুলোর পর্যায়ক্রমিক উঠানামা কীভাবে আমাদের অচেতন থেকে সচেতন করে, সে সম্পর্কে একটি পরিচিত উদাহরণ টানা যাক। সকালে ঘুম থেকে জাগার জন্য আমরা এলার্ম দিই। এলার্ম যখন বাজতে শুরু করে, তখনও আমরা ঘুমের দেশে থাকি। তখন কাজ করে ডেলটা ওয়েভ। ডেলটা থেকে ব্রেইনওয়েভ থিটায় উঠে গেলে এলার্মের শব্দে আমরা সজাগ হই। আলফা হাজির হলে আমরা ধীরে ধীরে উঠে বসি। আর বিটা ওয়েভের আবির্ভাবে আমরা পূর্ণ সচেতন হয়ে কাজ করা শুরু করি। এলার্ম যদি কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করা হয়, আমরা আবার ঘুমিয়ে পড়তে পারি । কিন্তু এই ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। একটু পরেই সারাদিন কী করব, সেই পরিকল্পনা নিয়ে মগজ ভাবতে শুরু করে। দিনের এই সময়টিতে আমাদের মস্তিষ্ক খুবই সক্রিয় থাকে।
এখন পাঁচ প্রকার ব্রেইনওয়েভ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
গামা ওয়েভ
গামাওয়েভ উচ্চ পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সাথে জড়িত। শিখনের জন্য গামা ওয়েভ গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয় যে, ৪০ হার্টজ গামা ওয়েভ আমাদের ইন্দ্রিয়োপলব্ধি এবং নতুন জিনিস শেখার সাথে জড়িয়ে আছে। দেখা গেছে, মানসিক প্রতিবন্ধীদের গামা ওয়েভ গড়পড়তার চেয়ে কম থাকে। গামা ওয়েভের কম্পাঙ্কের সীমা ৪০-১০০ হার্টজ। এই ওয়েভের মাত্রা বেশি হলে দুশ্চিন্তা সহ অন্যান্য মানসিক রোগ হতে দেখা যায়। আর মাত্রা কম হলে বিষণ্ণতা, শিখনে প্রতিবন্ধকতা প্রভৃতি ঘটে থাকে। গামা ওয়েভের ভারসাম্য বজায় থাকলে আপনি ইন্দ্রিয়োপলব্ধি, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ, তথ্য বিশ্লেষণ, শিখন, REM ঘুম প্রভৃতি সুন্দরভাবে করতে পারবেন।
বিটা ওয়েভ
বিটা ওয়েভের কম্পাঙ্কের সীমা ১২-৪০ হার্টজ। যখন আমরা জেগে থাকি, তখন বিটা ওয়েভ কাজ করে। আপনার সচেতন চিন্তা, যৌক্তিক চিন্তা বা উত্তেজনায় সাড়া দেওয়া প্রভৃতির সাথে বিটা ওয়েভ জড়িত। সঠিক মাত্রার বিটা ওয়েভ স্কুলের হোমওয়ার্ক বা এই ধরনের কাজ করতে সাহায্য করে।
বিট ওয়েভের অতিরিক্ত মাত্রার কারণে অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা হতে পারে। কফি বা উত্তেজক কোনো পানীয় পান বিটা ওয়েভের মাত্রা বৃদ্ধি করে। বিটা ওয়েভ খুব দ্রুতগতির ব্রেইনওয়েভ, যা সারাদিন সক্রিয় থেকে মানুষের জটিল চিন্তা, লেখাপড়া এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখে।
বিটা ওয়েভের মাত্রা কমে গেলে আপনি দিবাস্বপ্নে তলিয়ে যাবেন, বিষণ্ণতায় ভুগবেন বা “ঠিক বুঝলাম না” জাতীয় কথাবার্তা বলবেন।
আলফা ওয়েভ
আলফা ওয়েভ আমাদের সচেতন ও অবচেতন মনের সেতুবন্ধন রচনা করে। অন্যকথায়, এটি বিটা এবং থিটা ওয়েভের মধ্যবর্তী কম্পাঙ্কের ব্রেইনওয়েভ। আলফা ওয়েভ আমাদের প্রয়োজনের সময় শান্ত থাকতে সাহায্য করে এবং গভীর শিথিলায়নের অনুভূতি নিয়ে আসে।
যারা কোয়ান্টামের মেডিটেশন অনুশীলন করেছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন এই বিষয়ে। সেখানে বলা হয়, “আপনার ব্রেইনওয়েভ নেমে গেছে বিটা থেকে আলফায়”। আমরা যখন প্রচুর চাপে থাকি, তখন আলফা ব্লকিং ঘটতে পারে। অর্থাৎ তখন আলফা ওয়েভকে কোনো সুযোগ না দিয়ে বিটা ওয়েভ বেশি কাজ করে। অতিরিক্ত আলফা ওয়েভের ফলে আপনি দিবাস্বপ্ন দেখেন, কোনোকিছুতে মনোযোগ দিতে পারেন না, অতিরিক্ত শিথিল বোধ করেন। আলফা ওয়েভ কমে গেলে হতে পারে দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা ও OCD। এন্টিডিপ্রেসেন্টেস আলফা ওয়েভের পরিমাণ বাড়ায়।
থিটা ওয়েভ
থিটা ওয়েভ দিবাস্বপ্ন ও ঘুমের সাথে জড়িত। থিটা ওয়েভের ফলে আমরা গভীর আবেগ অনুভব করি। অতিরিক্ত থিটা ওয়েভ মানুষকে বিষণ্ণতার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। আপনার মাথায় অতিরিক্ত থিটা ওয়েভ কাজ করলে মনে হবে, আপনি শিথিলায়নের গভীর স্তরে রয়েছেন, যেন আপনি সম্মোহিত।
থিটা ওয়েভের আধিক্য থাকলে আপনাকে অন্যের কথায় প্রভাবিত হবেন। পরিমিত মাত্রার থিটা ওয়েভের ফলে ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করে এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। থিটা ওয়েভ আমাদের বিশ্ব চরাচর থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাভাবিক সচেতনতার বাইরের জগতে নিয়ে যায়। সম্মোহনের কোনো দৃশ্যের কথা মনে পড়ে? তখন ধীরে ধীরে মানুষ জাগ্রত অবস্থা থেকে চলে যায় গভীর ঘুমঘোরে। সচেতন জগত থেকে চলে যায় তার স্মৃতির জগতে। এই অবস্থায় কোনো দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়ে। আমাদের ভয়, দুঃস্বপ্নও থিটা ওয়েভের আধিপত্যের বহিঃপ্রকাশ।
ডেলটা ওয়েভ
ডেলটা হচ্ছে মগজের সবচেয়ে ধীরগতির ব্রেইনওয়েভ। ডেলটা ওয়েভ বেশি পাওয়া যায় শিশুদের ক্ষেত্রে। আমাদের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ডেলটা ওয়েভের পরিমাণ কমতে থাকে। এই ওয়েভও গভীর শিথিলায়নের সাথে জড়িত।
আপনার ঘুমের সময় ডেলটা ওয়েভ কাজ করলে আপনি ঘুম থেকে উঠে সুস্থ ও কর্মক্ষম বোধ করবেন, ঝরঝরে লাগবে। অনৈচ্ছিক দৈহিক কর্মকাণ্ডের সাথেও (যেমন- হার্টবিট) এই ওয়েভ জড়িত। পরিমিত ডেলটা ওয়েভ আমাদের ঘুম শেষে সতেজ অনুভব করায়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, নানারকম ব্রেইনওয়েভের কারুকাজেই প্রকাশ ঘটে নানারকম আবগের। আমাদের ঘুমন্ত-জাগ্রত, সক্রিয়-নিষ্ক্রিয় সব অবস্থাই কেবলমাত্র ব্রেইনওয়েভের কারসাজি। নানাপ্রকার ব্রেইনওয়েভের ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থানই আমাদের জীবনকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে। তাই ব্রেইনওয়েভ সম্পর্কে জানার ফলে আপনি সচেতনভাবে আপনার আবেগ ও জীবনকে নতুন মাত্রা দিতে পারেন। শুরু করুন এখন থেকেই। শুভকামনা সকলের জন্য।
ফিচার ইমেজ- Flipboard