১.
নিউ জিল্যান্ডের পেসার অ্যাডাম মিলনে ইনজুরির কারণে আইপিএল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তরুণ পেসার আলজারি জোসেফকে দলে অন্তর্ভুক্তি করে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। মিলনেকে নিলামে ৭৫ লাখ রুপি দিয়ে কিনে নিয়েছিল মুম্বাই। নিয়মানুযায়ী জোসেফকে এই দামের মধ্যে কিনে নেয় তারা। ইনজুরি আক্রান্ত মিলনের বদল প্রাথমিক স্কোয়াডে ডাক পেলেও, শুরুতেই মূল একাদশে জায়গা পাননি জোসেফ। এরপর লাসিথ মালিঙ্গা দেশে ফিরে গেলে একাদশে জায়গা পান তিনি।
শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড হঠাৎ করেই লাসিথ মালিঙ্গাকে দেশে ডেকে পাঠান। শুরুতে আইপিএল খেলার অনুমতি দিলেও পরে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় তাকে। এতে করে ভাগ্য খুলে যায় জোসেফের। লাসিথ মালিঙ্গা দেশে ফিরে যাওয়ার পরের ম্যাচেই তিনি একাদশে জায়গা করে নেন। ৬ই এপ্রিল সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে আইপিএলে তার অভিষেক ঘটে।
হায়দ্রাবাদের ঘরের মাঠে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়েছিলো মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। ১৮তম ওভার শেষে তাদের সংগ্রহ ছিলো সাত উইকেটে মাত্র ৯৭ রান। তখন নবম ব্যাটসম্যান হিসাবে ক্রিজে আসেন অভিষিক্ত আলজারি জোসেফ। ব্যাট হাতে কোনো মোকাবেলা না করলেও অপর প্রান্ত থেকে কিয়োরান পোলার্ডের ব্যাটিং তাণ্ডব দেখেছিলেন তিনি। শেষ ১২ বল থেকে ৩৯ রান তুলে দলকে ১৩৬ রানের পুঁজি এনে দিয়েছিলেন পোলার্ড। জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালোই করেছিলেন হায়দ্রাবাদের দুই ওপেনার জনি বেয়ারস্টো এবং ডেভিড ওয়ার্নার।
ফর্মে থাকা এই দুই ওপেনার উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ৩৩ রান যোগ করেছিলেন। বেয়ারস্টো ১৬ রান করে ফিরে যাওয়ার পর শুরু হয় জোসেফের ধ্বংসাত্মক বোলিংয়ের বিপরীতে ভেঙে পড়ে স্বাগতিকদের ব্যাটিং লাইনআপ। তিনি আইপিএলে নিজের প্রথম বলে সাজঘরে ফেরান ডেভিড ওয়ার্নারকে। এরপর নিজের দ্বিতীয় ওভারে এসে ফেরান বিজয় শংকরকে। নিজের প্রথম স্পেলে হায়দ্রাবাদের টপ অর্ডারের দুই ব্যাটসম্যানকে ফেরানোর দ্বিতীয় স্পেলে এসে তাদের লোয়ার মিডল-অর্ডার এবং টেল-এন্ডারদের একাই গুড়িয়ে দেন জোসেফ। একে একে দীপক হুদা, রশিদ খান, ভুবনেশ্বর কুমার এবং সিদ্ধার্থ কৌলকে সাজঘরে ফেরত পাঠান। তার বোলিং তোপের মুখে পড়ে হায়দ্রাবাদ মাত্র ৯৬ রানে গুটিয়ে গিয়ে ৪০ রানে পরাজিত হয়।
আলজারি জোসেফ আইপিএলে নিজের অভিষেক ম্যাচে মাত্র ১২ রানের বিনিময়ে ছয় উইকেট শিকার করেন, যা আইপিএলের ইতিহাসে সেরা বোলিং বিশ্লেষণ। এর আগে ২০০৮ সালে আইপিএলের প্রথম আসরে পাকিস্তানের বাঁহাতি পেসার সোহেল তানভীর ১৪ রানের বিনিময়ে ছয় উইকেট শিকার করেছিলেন, যা আইপিএলের পরবর্তী দশ আসরেও কেউ ভাঙতে পারেননি। অবশেষে দ্বাদশ আসরে এসে জোসেফ এক ইনিংসে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড গড়লেন। সোহেল তানভীর যখন রেকর্ডটি গড়েছিলেন, তখন জোসেফের বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর।
আইপিএলে নিজের প্রথম ম্যাচে বল হাতে দলের জয়ে অবদান রাখার পর, দ্বিতীয় ম্যাচে ব্যাট হাতে অবদান রাখেন। পাঞ্জাবের বিপক্ষে ১৯৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১৪০ রানে ছয় উইকেট হারায় মুম্বাই। এরপর ক্রিজে এসে পোলার্ডের সাথে ৫৪ রানে জুটি বাঁধেন জোসেফ। জয় থেকে মাত্র চার রান দূরে থাকতে পোলার্ড সাজঘরে ফিরে গেলে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন তিনি। শেষ বলে যখন দুই রান প্রয়োজন ছিল, তখন ঠাণ্ডা মাথায় ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে খেলে প্রয়োজনীয় দুই রান নিয়ে নেন জোসেফ। ১৩ বলে অপরাজিত ১৫ রানের ইনিংস খেলে দলকে শেষ হাসি হাসান তিনি।
২.
আলজারি জোসেফ ১৯৯৬ সালের ২০শে নভেম্বর অ্যান্টিগাতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। তার বাবা নিজে একজন ক্লাব ক্রিকেটার ছিলেন। তাই ছেলের বল মোকাবেলা করতে বাড়ির উঠোনে নেমে পড়তেন। জোসেফের শৈশবের স্বপ্নের তারকা ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই কিংবদন্তি পেসার অ্যান্ডি রবার্টস এবং কার্টলি অ্যামব্রোস। দুইজনেই অ্যান্টিগার ক্রিকেটার ছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটকে গুরুত্বের সাথে নেওয়া জোসেফের ২০১৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। ঐ মৌসুমেই ৪৬ রানে সাত উইকেট শিকারসহ দুইবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করে নির্বাচকদের নজরে এসেছিলেন, যার ফলে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেন।
একজন পেসারের মধ্যে যেসব গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, সবকিছুই আছে জোসেফের মধ্যে। ছয় ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন এই পেসার প্রথম জনসমক্ষে আসেন ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে। ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের দুর্দান্ত গতি আর সুইং দিয়ে ধরাশায়ী করার পর তিনি আলোচনায় আসেন। এরপর ফাইনালে ভারতের টপ-অর্ডারকে একাই গুড়িয়ে দিয়ে দলকে শিরোপা জেতাতে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
জোসেফ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার ছিলেন। তিনি ঘন্টায় ১৪৭ কিলোমিটার গতিতেও বল করেছেন। বাংলাদেশের স্পিনসহায়ক উইকেটে তিনি ছয় ম্যাচে ১৩.৭৬ বোলিং গড়ে এবং ৩.৩১ ইকোনমি রেটে ১৩ উইকেট শিকার করেছিলেন, যা আসরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সর্বোচ্চ। তার বোলিং স্টাইল ছিল কিছুটা কাগিসো রাবাদার মতো, যা দেখে অনেকেই বলছিলেন, তিনি এখনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য প্রস্তুত। এর মধ্যে একজন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক পেসার এবং ২০১৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ধারাভাষ্যকার ইয়ান বিশপ।
আলজারি জোসেফ বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলার আগ পর্যন্ত তার শৈশবের হিরো কার্টলি অ্যামব্রোসের সাথে দেখা করার সুযোগ পাননি। শিরোপা নিয়ে যখন দেশে ফেরেন, তখন বিমানবন্দরে তাদেরকে স্বাগতম জানানোর যে পার্টি রাখা হয়েছিল, সেখানে উপস্থিত ছিলেন কিংবদন্তি অ্যামব্রোস। তিনি জোসেফের সাথে দেখা হওয়ার পর বলেন,
‘আমি অ্যান্টিগান, তুমিও অ্যান্টিগান। আমি গর্বিত। আমি যদি এখানে থাকি, যেকোনো সময় তোমার যদি কোনো সাহায্য কিংবা পরামর্শের প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাকে কল করতে পারো। আমি তোমার বেশিরভাগ ম্যাচ দেখেছি। তুমি ঠিক পথেই আছো। তুমি খুব বেশি হাসো না, আমি এটাই পছন্দ করি। তুমি আক্রমণাত্মক। কিন্তু আমি তোমাকে বলতে চাই, এখন থেকেই মূল কাজ শুরু। এখন তোমার উপর পুরো বিশ্ব চোখ রাখবে। তাই আমি তোমাকে বলতে চাই, কঠোর পরিশ্রম করো। ফিটনেস ঠিক রাখো। প্রতিনিয়ত স্কিলে উন্নতি সাধন করো।’
জোসেফ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার আগে ২০১৬ সালের জুনে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে নেটে বোলিং করেন। তার বোলিং দেখে অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার বলেছিলেন,
‘He bowled fast, beautiful yorkers – and what an athlete!’
৩.
বর্তমানে অনেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলার। আইপিএলে চড়া দামে কোনো দলে অন্তর্ভুক্তি হতে পারাকে অনেক বড় অর্জন মনে করেন। টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি এক প্রকার অনীহা দেখা যায় তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে। সেদিক থেকে আলজারি জোসেফ একটু আলাদা। ইতঃমধ্যে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শতাধিক উইকেট শিকার করলেও আইপিএল খেলার আগে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মাত্র সাত ম্যাচ খেলেছেন। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও এখনও তার অভিষেক ঘটেনি।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ২০১৬ সালের আসরে দুর্দান্ত বোলিং করে আলোচনায় উঠে আসা জোসেফের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে টেস্ট ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে। তিনি যখন নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচ খেলেন, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং পরামর্শক হিসাবে কাজ করছিলেন কার্টলি অ্যামব্রোস। তাকে টেস্ট ক্যাপ পরিয়ে দেন আরেক কিংবদন্তি পেসার জোয়েল গার্নার।
ঘরের মাঠে ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। সেখানে তিনি ডেল স্টেইনকেও অনুসরণ করেন, স্টেইনের মতো ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে আউটসুইং বল করে সফলতা পাওয়ার চেষ্টা করেন। সফলতাও পেয়ে যান হাতেনাতে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম শিকারে পরিণত করেন সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলিকে। এরপর একই ইনিংসে রোহিত শর্মার উইকেটও শিকার করেছিলেন।
জোসেফের ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে একই বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে। নিজের অভিষেক ওয়ানডেতেই প্রতিপক্ষের সেরা ব্যাটসম্যান বাবর আজমের উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে কেনিংটন ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে। তিনি জনি বেয়ারস্টো, ইয়োন মরগান, জো রুট, জেসন রয় এবং স্যাম বিলিংসদের মতো স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের আউট করে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন।
পেসারদের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় বাধা ইনজুরি। জোসেফও ২০১৭ সালের শেষে পিঠের ইনজুরিতে পড়ে দশ মাসের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যান। এরপর ২০১৮ সালের জুলাইতে বাংলাদেশের বিপক্ষে দু’টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেন তিনি। ওয়ানডেতে ফিরলেও টেস্ট ক্রিকেটে ফেরেন ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে কেমার রোচ, গ্যাব্রিয়েল এবং জেসন হোল্ডারের মতো পেসার থাকা সত্ত্বেও মোট দশ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি।
অ্যান্টিগায় আলজারি জোসেফ তার ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলেন ইংল্যান্ডের সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে। ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড ১৮৭ রানে গুটিয়ে যায়। জোসেফ ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপের দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যান জো ডেনলি এবং জো রুটের উইকেট শিকার করেছিলেন। ম্যাচের দ্বিতীয় দিনশেষে খবর পান, তার মা শ্যারন মৃত্যুবরণ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে ব্রেন টিউমারের সাথে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হার মেনেছিলেন তিনি। ঘরের মাঠে নিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচে মায়ের মৃত্যুর খবর শুনেও খেলা চালিয়ে যান তিনি। চোখে অশ্রু নিয়ে প্রথমে ব্যাটিং করেন তিনি। এরপর বোলিং করতে নেমে আবারও জো রুট এবং জো ডেনলির উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজও জয় তুলে নিতে বেশি সময় নেয়নি। ইংল্যান্ডের দেওয়া ১৪ রানের লক্ষ্য কোনো উইকেট না হারিয়েই মাত্র ১৩ বলেই অতিক্রম করে তারা। ম্যাচ শেষে অধিনায়ক হোল্ডারও জয়টি জোসেফের মাকে উৎসর্গ করেছিলেন।
আলজারি জোসেফ এখন পর্যন্ত নয়টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৩২.৮৪ বোলিং গড়ে ২৫ উইকেট শিকার করেছেন। ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন ১৬টি, একবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট সহ ৩৪.০৮ বোলিং গড়ে ২৪ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। এখনও ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেননি জোসেফ। ক্রিকেটের আদি সংস্করণ টেস্ট ক্রিকেটের প্রতিই তার মনোযোগ বেশি। ইনজুরিমুক্তভাবে খেলে যেতে পারলে হয়তো একসময় কিংবদন্তি পেসারদের কাতারে নাম থাকবে আলজারি জোসেফের। অন্তত সেই সম্ভাবনা যে তিনি দেখাচ্ছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।