হ্যারি পটার সিরিজের মাধ্যমে জে কে রোলিং আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এক অনন্য সাধারণ জাদুময় জগতের সাথে। সেই জগতের বিভিন্ন দিকের দেখা আমরা পেয়েছি সাত পর্বের বইয়ের সিরিজটিতেই। কিন্তু ২০০৭ সালে সমাপ্তি ঘটেছে মূল সিরিজটির। কিন্তু এরপরও প্রকাশিত হয়েছে হ্যারি পটারের জাদুময় জগতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বই, মুক্তি পেয়েছে চলচ্চিত্র, মঞ্চস্থ হয়েছে নাটকও। এসবের মাধ্যমে জাদুময় জগতের বিভিন্ন নতুন নতুন দিক আমাদের সামনে এসেছে। এছাড়া পটারমোর নামক ওয়েবসাইটটির মাধ্যমেও লেখিকা নিয়মিতই ব্যাখ্যা দেন জাদুময় জগতের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে। কিন্তু যারা কেবল সাত পর্বের মূল সিরিজটিই পড়েছেন, কিংবা বড়জোর আট পর্বের মুভি সিরিজটি দেখেছেন, তাদের কাছে জে কে রোলিং সৃষ্ট জাদুময় জগতের অনেক কিছুই এখনো অজানা রয়ে গেছে। চলুন পাঠক, এবার আপনাদের সামনে একে একে তুলে ধরি জাদুময় জগতের সেসব অজানা অধ্যায়।
দ্য বুক অব অ্যাডমিটেন্স
হোগওয়ার্টস ক্যাসেল অসংখ্য গোপনীয়তায় পূর্ণ। জায়গা পরিবর্তনকারী সিঁড়ি থেকে শুরু করে ভুল দরজা, কিংবা হাজার হাজার মন্ত্র বশীভূত ছবি, এমনকি চেম্বার অব সিক্রেটসের মতো অতি গোপন প্রকোষ্ঠও আছে এখানে। কিন্তু এখানকার সবচেয়ে গোপনীয় জিনিসটি হলো একটি বই, যার নাম বুক অব অ্যাডমিটেন্স। যখনই কোনো নতুন জাদুকরের জন্ম হয়, এমনকি তা যদি হয়ে থাকে মাগল পরিবারেও, সাথে সাথে বইটি তা জেনে যায়। তবে ঠিক ঐ সময়ই যে শিশু জাদুকরের নাম বইয়ে লিপিবদ্ধ হয়, তা সবসময় নয়। কুইল অব অ্যাকসেপ্টেন্স নামে আছে আরেকটি কলম। নতুন জাদুকর জন্মের সাথে সাথে, তার বয়স সাত বছর পূর্ণ হলে, কিংবা আরো পরে যখন সে তার জাদু ক্ষমতা প্রদর্শন করতে শুরু করে, কলমটি অনুমতি পায় বইয়ে ঐ খুদে জাদুকরের নাম লিপিবদ্ধ করার। আর এভাবেই, খুদে জাদুকরটি চাইলে হোগওয়ার্টসে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করে।
মাগল বর্ন
মাগল মানে হলো যারা জাদুকর নয়, সাধারণ মানুষ। কিন্তু অনেক সময় মাগলদের পরিবারেও জাদুকরের জন্ম হয়। তখন তাদেরকে বলা হয় মাগল বর্ন। মোনিং মার্টল, লিলি ইভান্স (বিয়ের আগে হ্যারির মায়ের নাম) কিংবা হারমায়োনি গ্রেঞ্জার, সকলেই ছিল মাগল বর্ন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, মাগল পরিবারে জন্মেও তারা জাদুকর কীভাবে হলো? এর উত্তর আছে স্কুইবদের কাছে। স্কুইব হলো মাগল বর্নদের ঠিক বিপরীত, অর্থাৎ জাদু পরিবারে জন্মেও যাদের মধ্যে কোনো জাদুকরী ক্ষমতা নেই। এমন স্কুইবদেরকে জাদুময় জগতে থাকতে দেয়া হয় না। তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মাগল সমাজে। মাগল কোনো ব্যক্তিকে বিয়ে করে তারা সাধারণ মাগল হিসেবে জীবনযাপন শুরু করে। কিন্তু তাদের জিনের ভিতর কিছু জাদুকরী জিন রয়েই যায়। পরবর্তী কোনো একটি প্রজন্মে সেই জাদুকরী জিন আবার নতুন করে জেগে ওঠে, এবং আপাতদৃষ্টিতে মাগল মনে হওয়া কোনো ব্যক্তির সন্তান জাদুকর হিসেবে চিহ্নিত হয়।
গ্রিংগটসে মুদ্রা বিনিময়
আমাদের দুনিয়ায় যেমন টাকা বা সম্পদ গচ্ছিত রাখার জন্য আছে ব্যাংক, সেরকম জাদুময় জগতেও আছে গ্রিংগটস। আমরা আমাদের ব্যাংকে যেমন বাংলাদেশী টাকার বিনিময়ে ভারতীয় রুপি বা মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে পারি, জাদুময় জগতেও গ্রিংগটসে গিয়ে মাগল অর্থের বিনিময়ে জাদুকরী অর্থ সংগ্রহ করা যায়। এবং এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কেননা তা না হলে মাগল বর্ন জাদুকররা জাদুময় জগতের অন্যান্য জিনিস তো বাদই দিলাম, এমনকি ওয়ান্ডটাও কিনতে পারবে না। কারণ অলিভেন্ডার পাউন্ড কিংবা ইউরো নেন না, তাকে গ্যালিয়নস, নাটস কিংবা সিকলসই দিতে হয়।
দু’জন হ্যারি পটার
হ্যাঁ, আসলেই জাদুময় জগতে দু’জন হ্যারি পটারের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সেটি কোনো টাইম ট্র্যাভেলের ফলে নয়। আমরা যে হ্যারি পটারকে চিনি, তার এক প্রপিতামহও পরিচিত ছিলেন হ্যারি পটার হিসেবে। তার ঘনিষ্ঠজনেরা তাকে এই নামে ডাকতেন, যদিও তার প্রকৃত নাম ছিল হেনরি পটার। ১৯১৩ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেছিলেন জাদুময় জগতের উচ্চ আদালত, উইজেনগেমটে। মূল হ্যারি পটার সিরিজে তার উল্লেখ ছিল না। কিন্তু তিনি বাস করতেন ‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস অ্যান্ড হোয়্যার টু ফাইন্ড দেম’-এর সময়ে। তাই মুভি সিরিজে তাকে দেখা গেলে অবাক হবেন না যেন।
হ্যারির সম্পদ
আমরা জানি, হ্যারি দারুণ সম্পদশালী। গ্রিংগটসে হ্যারির ভল্টে যে সোনা ও রূপার স্তুপ ছিল, তা উচ্চতায় ১১ বছর বয়সী এক বালককেও হার মানিয়েছিল। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ কোত্থেকে এলো? হ্যারির পূর্বপুরুষরা কি অনেক ধনী ছিলেন? আসল বিষয়টি হলো, দ্বাদশ শতকে হ্যারির পূর্বপুরুষ লিনফ্রেড অব স্টিঞ্চকম্ব ওষুধ তৈরি শুরু করেন, এবং এর মাধ্যমে তিনি বিশাল একটি ব্যবসাও ফেঁদে ফেলেন। স্কেলে গ্রো (হাড় নতুন করে গজানোর ওষুধ), পিপারাপ পোশন (ঠাণ্ডা বা ফ্লু দূর করার ওষুধ) ইত্যাদি তিনিই প্রথম বানিয়েছিলেন। তবে হ্যারির পরিবার সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী হয়ে ওঠে তার পিতামহ ফ্লিমন্ট পটারের কল্যাণে। তিনি তৈরি করেন স্লিকিয়াজিস হেয়ার পোশন, যা রুক্ষ-শুষ্ক চুলকে করে আর্দ্র ও রেশমের মতো নরম। হারমায়োনিও এই পোশন ব্যবহার করে সুফল পেয়েছিল। আর ফ্লিমন্ট পটার কেবল এই একটি পোশনের মাধ্যমেই তাদের বংশের সম্পদের পরিমাণ তিনগুণ বাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।
উইজার্ড এলিমেন্টারি স্কুল
খুদে জাদুকররা হগওয়ার্টস কিংবা অন্যান্য জাদুর স্কুলে গিয়ে উচ্চতর জাদুবিদ্যা শেখে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত কি তারা কিছুই করে না? অলস সময় কাটায়? মোটেই না। আমাদের বাবা-মা যেমন আমাদেরকে স্কুলে ভর্তি করার আগেই অ-আ-ক-খ কিংবা এ-বি-সি-ডি শিখিয়ে দেন, জাদুময় জগতের বাবা-মায়েরাও ঠিক সেই কাজটিই করেন। সেখানেও বাচ্চারা স্কুলে ভর্তির আগপর্যন্ত বাবা-মা কিংবা বড় ভাইবোনদের কাছ থেকে জাদুবিদ্যার প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। এছাড়া লিখতে, পড়তে ও অংক কষতেও শেখে। তাছাড়া অনেক বাচ্চা তো নিজের ইচ্ছাতেও অনেক কিছু শিখে নেয়, অনেক আগ্রহের বিষয়ে আগে থেকে পড়াশোনা করে আসে। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অবশ্যই আমাদের হারমায়োনি। ড্রেকো ম্যালফয় তাকে মাডব্লাড গালি দিলে কী হবে, সে তার অন্য যেকোনো পিওরব্লাড সহপাঠীর চেয়ে ভালো জাদু জানে। কারণ মাগল পরিবারে বড় হওয়া সত্ত্বেও যে সে হগওয়ার্টসে আসার আগেই জাদুময় জগতের অনেক খুঁটিনাটি সম্পর্কে পড়াশোনা করে এসেছিল।
জিঞ্জার উইচ
হ্যারি পটার সিরিজে ডেইলি প্রফেট সংবাদপত্রটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই পত্রিকার সাংবাদিক রিটা স্কিটার তো হ্যারির জীবন প্রায় দুর্বিষহ করে তুলেছিল। তবে সে যা-ই হোক, হ্যারি পটার মুভি সিরিজেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ হিসেবে বারবার হাজির হয়েছে পত্রিকাটি। এবং এই পত্রিকায় বেশ অনেকবারই বিশেষ একজন ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া গেছে, যার নাম জিঞ্জার উইচ। কে সে? সে হলো এক দুর্ধর্ষ হুলিগান, যে দশকের পর দশক ধরে জাদুময় জগতে ত্রাস ছড়িয়ে এসেছে।
মিনার্ভা
প্রফেসর মিনার্ভা ম্যাকগোনাগল পুরো সিরিজ জুড়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। কিন্তু তারপরও, তার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে আমরা বলতে গেলে কিছুই জানি না। তার প্রয়াত স্বামী যে এলফিনস্টোন, এবং তার বাবা যে একজন মাগল ছিলেন, এসব তথ্য কি কেউ আগে জানতেন? সে সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য মূল সিরিজের পাতায় নয়, প্রকাশিত হয়েছে পটারমোরে। আপনারা নিশ্চয়ই এ-ও জানেন না যে, মিনার্ভার দুজন ভাই আছেন, এবং যুবতী বয়সে তিনি দু’বার প্রেমে পড়েছিলেন, একবার ডগাল নামক এক মাগলের, অন্যবার এলফিনস্টোন নামক জাদুকরের। কিন্তু তারা দুজনই খুব অল্প বয়সে মারা যান। হোগওয়ার্টসে শিক্ষকতা শুরুর আগে মিনার্ভা জাদু মন্ত্রণালয়েও চাকরি করেছিলেন।
ট্রিলনির অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী
পুরো সিরিজ জুড়েই আমরা সিবিল ট্রিলনিকে একজন বদ্ধ উন্মাদ হিসেবে দেখে এসেছি। কিন্তু তিনি যে অনেকগুলো ভয়াবহ সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা হয়তো অনেকেই খেয়াল করিনি। ‘দ্য চুজেন ওয়ান’ ভবিষ্যদ্বাণীটি তিনিই করেছিলেন, যার জের ধরে মৃত্যু হয়েছিল হ্যারির বাবা-মায়ের, এবং শেষ পর্যন্ত পতন ঘটেছিল লর্ড ভোল্ডেমর্টেরও। কিংবদন্তি ভবিষ্যদ্দর্শী ক্যাসান্ড্রার বংশধর ট্রিলনি কিন্তু প্রফেসর ডাম্বলডোরের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন। ক্রিসমাসের সময় যখন তাকে একটি টেবিলে বসতে বলা হয়েছিলেন, তিনি সে অনুরোধ অগ্রাহ্য করে বলেন,“যখন তেরোজন একসাথে খায়, প্রথমে ওঠা ব্যক্তিই প্রথম মারা যায়!” বাস্তবিক কিন্তু তা-ই হয়েছিল। কেউ জানতেন না যে আগে থেকেই পিটার পেটিগ্রুকে নিয়ে ঐ টেবিলে মোট তেরোজন ছিলেন। আর প্রথম ব্যক্তি হিসেবে টেবিল ছাড়ার সুবাদে ডাম্বলডোরই সবার আগে মারা গিয়েছিলেন।
অ্যালবাস সেভেরাস পটার
সিরিজের একদম শেষাংশে আমরা জানতে পারি, হ্যারি তার ছেলের নাম রেখেছে অ্যালবাস সেভেরাস পটার, অর্থাৎ প্রফেসর অ্যালবাস ডাম্বলডোর ও সেভেরাস স্নেইপের নামানুসারে। স্নেইপের নাম যুক্ত করার পেছনে যুক্তি হিসেবে সে দেখিয়েছে, তিনি ছিলেন সম্ভবত তার চেনা সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি। কিন্তু তারপরও কিছু পাঠককে দেখা গেছে এই বিষয়টি নিয়ে নিজেদের অসন্তোষ পোষণ করতে: কেন হ্যারি এমন একজন মানুষের নাম তার ছেলের নামের সাথে যোগ করলো, যে শুধু একজন স্লিদারিনই নয়, স্কুলজীবনে তার সাথে সবচেয়ে দুর্ব্যবহার করা ব্যক্তিও বটে। হ্যারি তো চাইলে হ্যাগ্রিড, রেমুস, সিরিয়াস, মুডি কিংবা ফ্রেডের নামানুসারেও তার ছেলের নাম রাখতে পারত। কিন্তু তা না করে সে কেন ডাম্বলডোরের পাশাপাশি স্নেইপের নামকেই বেছে নিয়েছে?
নিঃসন্দেহে তারা স্নেইপের মৃত্যু-মুহূর্তের গভীর আবেগময় অংশটিকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। তাই জে কে রোলিং নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন এর কারণ: অনুশোচনা। ব্যাটল অব হগওয়ার্টসে শেষ পর্যন্ত হ্যারি জয় পেয়েছিল বটে, কিন্তু এজন্য যত মানুষকে তাদের প্রাণ হারাতে হয়েছে, তা হ্যারি কোনোদিনই ভুলতে পারেনি। ব্যাটল অব হোগওয়ার্টসের দুঃসহ স্মৃতি আজও হ্যারিকে তাড়া করে বেড়ায়। যা যা হয়েছে, সেসবের জন্য সে নিজেকেই দায়ী করে। আর সে সবচেয়ে বেশি অনুশোচনায় ভোগে সবসময় স্নেইপকে ভুল বুঝে আসার কারণে। তাই তার কাছে মনে হয়েছে, নিজের ছেলের নাম স্নেইপের নামানুসারে রাখার মাধ্যমে স্নেইপকে ন্যূনতম সম্মানটুকু অন্তত সে দেখাতে পারবে, যা স্নেইপের জীবদ্দশায় সে কখনো দেখায়নি। আর এর মাধ্যমে সে হয়তো ক্ষমা পাবে (নিজের হৃদয়ে কিংবা অন্যদের কাছে)।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/