ক্রিকেটে আশির দশকের পুরোটা জুড়ে ছিল উইন্ডিজের দাপট। সেই সময়ে অনুষ্ঠিত প্রথম দুই বিশ্বকাপেই চ্যাম্পিয়ন ছিল তারা, তৃতীয় আসরে হয়েছিলো রানার্স আপ। তবে ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসদের মতো মহারথীদের অবসরের পর তাদের সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় আস্তে আস্তে ম্লান হতে শুরু করে। যে দলটা প্রথম তিন আসরেই ফাইনাল খেলেছিলো সেই দল পরের আট আসরে সেমিফাইনাল খেলেছে মাত্র একবার!
এই দশকে তো ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের অবস্থা আরো সঙ্গীন, বোর্ডের সাথে ক্রিকেটারদের দ্বন্দ্বের কারণে অধিকাংশ সময়ে তারকা ক্রিকেটারদের ছাড়াই তাদের দল সাজাতে হয়। এই অচলাবস্থার আরেকটা বড় কারণ ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দিকে তারকা খেলোয়াড়দের ঝুঁকে পড়েছেন। সারা বছর এসব টি-টুয়েন্টি লিগ খেলার সুফল হিসেবে দুবার টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা ঠিকই জিতেছে উইন্ডিজ, কিন্তু দিন দিন টেস্ট আর ওয়ানডেতে তাদের খেলার মান নেমেই যাচ্ছে। অবস্থা এতটাই খারাপের দিকে চলে গেছে যে, বাছাইপর্বের বাঁধা পার হয়ে তাদের বিশ্বকাপের টিকিট পেতে হয়েছে!
সেখানেও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ভাগ্যের ছোঁয়া না পেলে এবারের বিশ্বকাপে হয়তো দর্শক হিসেবেই থাকতে হতো তাদের। তবে বিশ্বকাপের ঠিক আগমুহূর্তে নিজেদের মোটামুটি গুছিয়ে এনেছে তারা। বিশেষ করে ঘরের মাঠে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের নাম্বার ওয়ান দল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যেভাবে বুক চিতিয়ে লড়াই উপহার দিলো তাতে অনেকেই উইন্ডিজকে এবারের আসরের ডার্ক হর্সের উপাধি দিতে চাচ্ছে। কেমন হতে পারে এই ডার্ক হর্সদের স্কোয়াড? উইন্ডিজ বোর্ড কি পারবে সব দ্বন্দ্ব মিটিয়ে আবারো তারকা ক্রিকেটারদের এক ছায়ায় নিয়ে আসতে?
টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান
গত দুই দশক ধরে উইন্ডিজের সেরা ওপেনার ক্রিস গেইল, কিন্তু বোর্ডের সাথে ঝামেলার কারণে এই দশকে মেরুন জার্সিতে সেভাবে খেলাই হয়নি তার! তবে দলের দুরবস্থায় আর অভিমান নিয়ে থাকতে পারেননি, বাছাইপর্বে দলকে পার করাতে ঠিকই ফিরে এসেছিলেন। এই বিশ্বকাপ খেলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর কথা ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন তিনি। শেষটা রাঙিয়ে দিতে স্বঘোষিত ইউনিভার্সাল বস পুরোপুরি প্রস্তুত তার প্রমাণ অবশ্য ইংলিশদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজেই দিয়েছেন, সেই সিরিজে চার ইনিংস খেলে ১০৬ গড়ে করেছেন ৪২৪ রান!
উদ্বোধনী জুটিতে গেইলের সঙ্গী হওয়ার দৌড়ে এভিন লুইসই এগিয়ে আছেন। ইনজুরির কারণে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজটা মিস করলেও নিজের দিনে ম্যাচ বের করে আনার ক্ষমতা সাথে অভিষেকের পর দুই সেঞ্চুরি– সব মিলিয়ে তার দলে থাকা নিশ্চিত। ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবে ক্যারিবিয়ানরা কাকে নেবে সেটাই এখন প্রশ্ন। সাম্প্রতিক সময়ে কিয়েরন পাওয়েল, চন্দ্রপাল হেমরাজ বা জন ক্যাম্পবেল– কেউই দলে সুযোগ পেয়ে আহামরি কিছু করতে পারেননি। তাই ব্যাকআপ ওপেনার না নিয়েও দল ঘোষণা করার সম্ভাবনা আছে।
ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান হিসেবে শাই হোপের থাকাটা নিশ্চিত। এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের সাম্প্রতিক ফর্মটাও দারুণ যাচ্ছে। গত বছর ওয়ানডেতে তার গড় ছিল ৬৭.৩১ রান, সেঞ্চুরি ছিল তিনটি। হার্ডহিটারে সয়লাব এই উইন্ডিজ দলটিতে ইনিংস ধরে রেখে ঠাণ্ডা মাথায় খেলার দায়িত্বটা হোপের ওপরেই থাকবে।
চার নম্বর পজিশনের জন্য লড়াইটা হবে মারলন স্যামুয়েলস ও ড্যারেন ব্রাভোর মধ্যে। দুজনই ভীষণ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান, কিন্তু নিজেদের সেই প্রতিভার প্রতিফলন তাদের সাম্প্রতিক পারফর্মেন্সে নেই। নিজের দিনে স্যামুয়েলস ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর সেটা ২০১২ ও ২০১৬ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালেই প্রমাণিত হয়েছে। দুবারই স্যামুয়েলস প্রায় একা হাতে খেলা বের করে এনেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তার পারফর্মেন্স ছক এতটাই নিম্নগামী যে ইংলিশদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দলেও তিনি ছিলেন না।
অন্যদিকে ক্যারিয়ারের শুরুতে লারার কার্বন কপি হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন ড্যারেন ব্রাভো, কিন্তু এই উপাধির যথার্থতা তিনি দিতে পারেননি। বোর্ডের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে শেষ দুই বছর দলে সেভাবে সুযোগও পাননি। সেই ঝামেলা মিটিয়ে ২০১৮ সালের শেষদিকে বাংলাদেশের বিপক্ষে আবারও দলে ফিরেছিলেন। সেই সিরিজে তেমন সুবিধা করতে না পারলেও ইংলিশদের বিপক্ষে সিরিজে ৪৪.৩৩ গড়ে রান করায় স্যামুয়েলসকে টপকে ব্রাভোরই স্কোয়াডে থাকার সম্ভাবনা বেশি। অবশ্য ব্যাকআপ ওপেনার না নিলে দুজনেরই স্কোয়াডে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান
পাঁচ নম্বর পজিশনে ২২ বছর বয়সী তরুণ সেনসেশন শিমরন হেটমায়ারের জায়গাটা নিশ্চিত, ২০১৭ সালে অভিষেক হওয়ার পর প্রায় ৪১ গড়ে রান করেছেন, সাথে আছে চার সেঞ্চুরি। লারার মতো নিজের দিনে একাই ম্যাচ বের করে নিতে সক্ষম এই ব্যাটসম্যান হতে পারেন বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান তারকা।
ছয় নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে রোভম্যান পাওয়েলের খেলার সম্ভাবনাই বেশি, গত দুই বছরের অধিকাংশ সময়ে তিনিই এই পজিশনে খেলেছেন। প্রতিভাবান এই হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি, তবুও বিশ্বকাপে হয়তো তার ওপরেই আস্থা রাখবে উইন্ডিজ বোর্ড। এই পজিশনে নিকোলাস পুরানের সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে, তবে সত্যি বলতে এই পজিশনের জন্য সবচেয়ে উপর্যুক্ত খেলোয়াড় কাইরন পোলার্ড। দুঃখের বিষয় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ব্যস্ততম এই ক্রিকেটার ২০১৬ সালের পর আর মেরুন জার্সিতে ওয়ানডে ম্যাচই খেলেননি। তাই বিশ্বকাপেও তাকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
অলরাউন্ডার
সাত নাম্বার ব্যাটসম্যান হিসেবে বর্তমান সময়ের সেরা হার্ডহিটার আন্দ্রে রাসেল খেলবেন তা মোটামুটি নিশ্চিত। বিশেষজ্ঞ বোলার হিসেবে অভিষেক হলেও পরবর্তীতে ব্যাটসম্যান হিসেবেই বেশি কার্যকরী হয়ে উঠেছেন তিনি। তার সাম্প্রতিক ফর্মটাও দারুণ, চলমান আইপিএলে একাই কলকাতা নাইট রাইডার্সকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। রাসেল যদি নিজের সেরাটা দিতে পারেন তাহলে যেকোনো রান তাড়া করাটা ক্যারিবিয়ানদের পক্ষে সম্ভব হবে। তাছাড়া বল হাতে দশ ওভার করে দলের ভারসাম্য রক্ষা করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারবেন তিনি।
আট নম্বরে খেলবেন অধিনায়ক জ্যাসন হোল্ডার। আজ উইন্ডিজ দলটিকে নিয়ে যতটুকু আশার আলো আছে তার পেছনে এই খেলোয়াড়টির বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণ অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। বোলার হিসেবে তো তিনি শুরু থেকেই আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন, তাছাড়া ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ব্যাটসম্যান হিসেবেও বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তবে ওয়ানডেতে এখনো নিজের ব্যাটিং সত্তাকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি তিনি। ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের জাত চেনানোর সেরা মঞ্চ হতে পারে এই বিশ্বকাপ। এই দুজন সুস্থ থাকলে আরেক অলরাউন্ডার কার্লোস ব্রাথওয়েট স্কোয়াডে জায়গা পাবেন না সেটা একপ্রকার নিশ্চিত।
পেসার
রাসেল ও হোল্ডারের মতো পেস অলরাউন্ডার দলে থাকায় অন্য দলের তুলনায় উইন্ডিজে পুরোদস্তুর পেসার হয়তো একজন কম থাকবে। ক্যারিবিয়ানদের পেস আক্রমণে মূল ভরসা হয়ে থাকবেন কেমার রোচ। ২০১৮ সালে দীর্ঘ তিন বছর পর ওয়ানডে ক্রিকেটে ফিরে ৩০ বছর বয়সী এই ডানহাতি পেসার বেশ ভালো পারফর্ম করছেন। প্রত্যাবর্তনের পর এই ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়ের যুগে তার ইকোনমি রেট ৫.১৫, ১৩ ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন ১৫টি।
পেস আক্রমণে রোচের সঙ্গী হবেন শেল্ডন কর্টেল এবং ওশান থমাস। এ বছর ইংলিশদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে দারুণ পারফর্ম করে দলে নিজেদের জায়গা পাকা করে ফেলেছেন এই দুই পেসার। ওই সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করেছিলেন বাঁহাতি পেসার কর্টেল। অন্যদিকে সিরিজের শেষ ম্যাচে মাত্র ২১ রানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপকে একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন ২২ বছর বয়সী ওশান থমাস। এই দুজনকে টপকে কিমো পল কিংবা আলজারি জোশেফের সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম, যদি ক্যারিবিয়ানরা চারজন পুরোদস্তুর পেসার নিতে চায় তবেই এই দুজনের মধ্যে একজনের ভাগ্য খুলতে পারে।
স্পিনার
বর্তমান উইন্ডিজ দলে দুর্বল জায়গা বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা একজন বিশ্বমানের স্পিনারের অভাব। অথচ স্পিনার হিসেবে উইন্ডিজ তো বটেই, বিশ্বের যেকোনো দলের প্রথম পছন্দ হবেন সুনিল নারিন। তবে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে অতি বেশি ব্যস্ত থাকার কারণে ২০১৬ সালের পর ক্যারিবিয়ানদের হয়ে কোনো ওয়ানডে ম্যাচে তাকে দেখা যায়নি! বিশ্বকাপে বড় কিছু করতে চাইলে বোর্ডের উচিত যেকোনো মূল্যে নারিনকে দলে ফিরিয়ে আনা। দুর্দান্ত অফ স্পিনের সাথে নারিনের ব্যাটিংটাও দলকে বাড়তি কিছু দিতে পারবে।
যদি নারিনকে ফেরানো সম্ভব না হয় তাহলে অ্যাশলে নার্স আর দেবেন্দ্র বিশুকেই বিশেষজ্ঞ স্পিনার হিসেবে দলে নেবে উইন্ডিজ। দুজনই নিজেদের সেরাটা দিয়ে দলকে কিছু ম্যাচ জিতিয়েছেন। তবে দুজনের কেউই খুব একটা ধারাবাহিক না। সেক্ষেত্রে নারিন ফিরে না আসলে ডার্ক হর্স হিসেবে ক্যারিবিয়ানদের বড় কিছু করার সম্ভাবনাটাও অনেক ক্ষীণ হয়ে যাবে।
সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বোর্ডের সাথে খেলোয়াড়দের বিভিন্ন সমস্যার কারণে উইন্ডিজ দল ঠিক কেমন হবে সেটা নিশ্চিতভাবে বলা কিছুটা মুশকিল। তবে যত যা-ই হোক, ক্যারিবিয়ানদের ১৫ সদস্যের দলে উপরে উল্লেখিত নামগুলোর মধ্য থেকেই খেলোয়াড়েরা থাকবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। উইন্ডিজ তাদের সেরা দলটা নিয়ে বিশ্বকাপে আসতে পারলে এবারের আসরে যেকোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলার সম্ভাবনা তাদের আছে। ঝামেলা মিটিয়ে ক্যারিবিয়ানরা নিজেদের সেরা দল ঘোষণা করতে পারে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।