আচ্ছা বলুন তো, যদি স্কুলে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা না থাকে তাহলে কেমন হবে? যারা স্কুলজীবন পার করে এসেছেন তারাও হয়তো আনন্দের সাথে ব্যাপারটাকে স্বাগত জানাবেন। আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করবেন কেন আপনার সময় এরকম সুযোগের দেখা মিলেনি। তবে এই প্রতিযোগিতার যুগে স্কুলে এক বছরের জন্য হলেও পরীক্ষা পদ্ধতি স্থগিত করলে যে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার তা বোঝানোর মতো সচেতন লোকের অভাব নেই আমাদের সমাজে। তাদের মূল কথা হলো সভ্যতা শিখুক আর নাই শিখুক, পড়াশোনা শিখতেই হবে।
আর এই পড়াশোনা আসলে পুঁথিগত জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবন চলার পথে পুঁথিগত শিক্ষার অবদান আছে বটে। জীবনটাকে সহজ করার জন্যও এই শিক্ষার দরকার, তবে আমাদের দেশে এই পুঁথিগত শিক্ষাকেই জীবনের মূল উদ্দেশ্য করে ফেলা হয়েছে। ব্যাপারটা এমন যে, পড়াশোনার জন্যই জীবন! সম্প্রতি বাংলাদেশেও স্কুল শুরুর পরবর্তী কয় বছর পর্যন্ত পরীক্ষা পদ্ধতি স্থগিত রাখা উচিত এই বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এমনকি সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে এর পক্ষে এবং বিপক্ষে মতামতের ঝড় দেখা যায়।
সিদ্ধান্তটা শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য শুভ হবে না – এমন মন্তব্যও অনেকে করেছেন। তাহলে আসলেই কি এটি একটি ভুল পদক্ষেপ?
বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশগুলোর একটি হলো জাপান। শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং শিষ্টাচার; কোনো দিক থেকেই দেশটি পিছিয়ে নেই। তবে এই দেশেও পরীক্ষা পদ্ধতি নেই চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। পড়াশোনা এবং পরীক্ষার চাপ থাকলেই যে উন্নতি করা সম্ভব এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে শিক্ষাব্যবস্থা নির্মাণের মাধ্যমে সবার জন্য আদর্শ সৃষ্টি করেছে দেশটি। পশ্চিমা দেশগুলোতে জন্য জাপানের সংস্কৃতি এবং বৈশিষ্ট্যগুলোকে সবসময়ই বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ভাষা, খাদ্য এবং আচার-আচরণ; সব দিক থেকেই বিশেষ এবং আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী জাপানিরা। এরই ধারাবাহিকতায় জাপানের স্কুলগুলোতেও দেখা মেলে নতুনত্বের ছাপ। বিশেষ শিক্ষা পদ্ধতি দেখা যায় জাপানি স্কুলগুলোতে। এদেশে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত কোনো ধরনের পুঁথিগত বিষয়ে পরীক্ষা না নিয়ে শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক বিকাশের দিকেই বিশেষভাবে নজরদারি করা হয়।
শুধু বয়সে বড় হওয়া নয়, বরং মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য তাদের চরিত্রে যেন প্রতিফলিত হয় এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এই প্রয়াসই চালানো হয়। স্কুলকে জীবন যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার স্থান হিসেবে না দেখিয়ে জীবনকে সুন্দর করার একটি মিলনস্থান হিসেবে প্রদর্শন করার চেষ্টা করছে জাপান সরকার। ধারণাটি নিতান্তই সহজ-সরল হলেও এই বিষয়টির কারণেই জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা সব থেকে আলাদা এবং ভালোও বটে।
তবে খুব সহজ এবং কম চাপের মধ্য দিয়ে স্কুল জীবন শুরু করলেও জাপানি শিক্ষার্থীরাও দুর্দান্ত প্রতিযোগী। গণিত এবং বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোতে এরা কোনো অংশেই পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় কম নয়। জাপানের শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় এপ্রিল মাস থেকে। আর শুরুর পরপরই স্কুলজীবন পরিচালিত হয় সব বাস্তববাদী কাজ দিয়ে।
জাপানের স্কুলগুলোতে একটি শিশু ভর্তি হওয়ার পর প্রথম তিন থেকে চার বছর পর্যন্ত তাকে তার কোনো গুণ বা দোষ দিয়ে বিচার করা হয় না কিংবা কোনো মানদণ্ডের ভিত্তিতে তাকে ভালো বা খারাপের অংশে ফেলা হয় না। এই সময়ে তাকে ভালো-খারাপের ভেদাভেদ শেখানো হয়। কার সাথে কেমন ব্যবহার করা উচিত, কিভাবে কথা বলা উচিত সেগুলো সুন্দর করে শেখানোর দায়িত্বের সিংহভাগ স্কুলগুলোই গ্রহণ করে। তাছাড়া নিত্যদিনের কাজগুলো, যেমন জামাকাপড় পরা, নিজ হাতে খাওয়া, নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা বা পরিপাটি থাকার শিক্ষাগুলো স্কুল থেকেই শেখে শিশুরা।
পরীক্ষার পর পরীক্ষা নিয়ে জীবনটাকে দুর্বিষহ করে না তুলে শুধুমাত্র কয়েকটি কুইজ নেওয়া হয় যার জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতি নেওয়ার বা চিন্তা করার প্রয়োজন হয় না। এসময় স্কুলগুলোর মূল উদ্দেশ্য থাকে শিক্ষার্থীদের সঠিক আচার-ব্যবহার শেখানো, এমনকি প্রকৃতি এবং পশুপাখির প্রতি কেমন আচরণ করা উচিত তা বুঝতে শেখানো। শিক্ষার্থীরা উদারতা, দানশীলতা এবং সহানুভূতিশীলতার মতো বৈশিষ্ট্যও স্কুল থেকে অর্জন করে। তাদেরকে যেকোনো পরিস্থিতিতে আত্মসংযম এবং সঠিক বিচার করতেও শেখানো হয়।
কম বয়সী শিশুদের জন্য এমন সামাজিকতার শিক্ষা নেওয়াটা অবশ্যই সহজ নয়। আর এরকম বিচক্ষণতা তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে দেখাতে পারবে তা আশা করাও উচিত নয়। তবে জাপানবাসী বিশ্বাস করেন যে, শিশুকাল থেকে সঠিকভাবে শিক্ষা দিলে এই শিশুরা একসময় আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। আরেকটি বিষয় হলো তারা চান যে, তাদের পরবর্তী বংশধরেরা পরীক্ষার ঝুট-ঝামেলায় পড়ার আগে কিছু নৈতিক শিক্ষাও গ্রহণ করুক। অর্থাৎ আমাদের দেশের পরীক্ষার হলে এক-দুটা প্রশ্নের উত্তর আশেপাশে জিজ্ঞেস করাকে খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় মনে হলেও জাপানের জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ধরনের কাজকে ভুল নয়, বরং গুনাহ হিসেবেই দেখা হয় যা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না বাবা মায়েরা।
এপ্রিলের শুরুতে ‘চেরি ব্লুজম‘ এর একটি সুন্দর মৌসুমে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়। গ্রীষ্মের ছুটির পর প্রকৃতি এবং স্কুলজীবন দুটোই একসাথে নতুন করে শুরু হয়। সাধারণত স্কুল আরম্ভের পূর্বে শিক্ষার্থীরা পাঁচ সপ্তাহের একটি ছুটি পায়। তবে এই বন্ধের মধ্যেও তারা বিভিন্ন ক্লাব সম্পর্কিত কাজের জন্য স্কুলে আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকে।
বৃক্ষরোপণ করা, পশু-পাখি পালন করার মতো বাস্তবিক কাজগুলোই করতে দেওয়া হয় তাদের। এছাড়া অনেকে শনিবারেও স্কুলে সময় কাটায় এবং পাঠ্যক্রমের বাইরের বিভিন্ন কার্যকলাপের সাথে যুক্ত হয়। আর এসব কাজের মাধ্যমেই তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশুরা পরবর্তী শ্রেণিতে যাওয়ার যোগ্য নাকি তা বিবেচনা করা হয়। তবে এখানে ভালো ফলাফলের কোনো বিষয় নেই। বাচ্চাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ এবং অন্যান্য নৈতিক গুণাবলির বিকাশ ঘটছে নাকি সেটাই আলোচ্য বিষয়। তবে এই সময়ে নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তকের উপর ভিত্তি করে পড়াশোনা নিয়মিতই চলে।
জাপানি স্কুলগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এখানে শিক্ষার্থীদের একদম ছোটবেলা থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সচেতন করা হয় এবং যথাযথ শিক্ষাও দেওয়া হয়। এসব স্কুল পরিষ্কার করার জন্য আলাদা করে কোনো ঝাড়ুদার বা পরিষ্কারক থাকে না। সারা বছর পর্যায়ক্রমে সব শিক্ষার্থীই এই কাজে অংশগ্রহণ করে। স্কুলের ক্লাসরুম, হল, টয়লেট, মাঠ সবকিছু ধুয়েমুছে পরিপাটি রাখার দায়িত্ব শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের। তাছাড়া এ ধরনের কাজকর্ম দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার এবং পরস্পরকে সাহায্য করার মতো মানসিকতাও গড়ে তুলতে সহায়তা করে।
কোনো কাজই যে ছোট নয় এবং সব পেশার মানুষকেই যে শ্রদ্ধা করা উচিত তথা সব মানুষই যে সমান শ্রদ্ধা পাওয়ার অধিকারী তা বাস্তব জীবনে কাগজ-কলমে বোঝানো হয় এসব স্কুলে। শিক্ষার্থীরাও বেশ সচেতন থাকে যাতে তারা কোনোকিছু নষ্ট না করে কিংবা নোংরা না করে। কারণ দিনশেষে পরিষ্কার করার কাজটা নিজেদেরই করতে হবে। এই পরিষ্কার করার কার্যক্রমকে ‘সোউজি’ বলে। একে ‘অনারেবল ক্লিনিং’ বা ‘সম্মানজনক পরিষ্করণ’ বলা হয়।
‘শোডো’ বা জাপানি ক্যালিগ্রাফিও শেখানো হয় জাপানের স্কুলগুলোতে। ‘শোডো’ জাপানের একটি সংস্কৃতি। রাইস পেপারে বাঁশের কঞ্চি এবং কালি দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করা হয়। জাপানের ‘হাইকু’ও বেশ পরিচিত সংস্কৃতি। এটাও এক ধরনের শিল্প। এগুলো বাদেও আরো অনেক সংস্কৃতিই স্কুলে থাকতে শেখানো হয়।
এমন শিক্ষা ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এত নিয়ম-কানুন, স্কুল ব্যবস্থা সবকিছুরই মূল উদ্দেশ্য হলো আদর্শ একটি জাতি গড়ে তোলা। তবে পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতায় এই ফরজ কাজটিই বাদ পড়ে যায়। অবশ্য জাপানে একবার এই ফরজ কাজটা পূরণ হয়ে গেলে কিন্তু পড়াশোনার বেশ চাপ প্রদান করা হয় যা অন্যান্য দেশের তুলনায়ও বেশি। অনেক সময় এই কারণেই উচ্চশিক্ষা নিতে জাপানি শিক্ষার্থীদের ধৈর্য থাকে না। অবশ্য প্রাথমিকে নেওয়া পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয় বটে।