শরীরে মেদ জমলে, বা ভুঁড়ি হলেই চিন্তায় পড়ে যাই আমরা অনেকে। রুক্ষ-শুষ্ক ত্বক নিয়েও আমাদের মধ্যে এরকমই একধরনের হীনমন্যতা কাজ করে।
ত্বকের শুষ্কতা এমন একটি সমস্যা, যাতে আমরা প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময় ভুগেছি। বিশেষ করে শীত আসলেই চামড়াতে বিভিন্ন রকমের ক্রিম লাগানোর প্রবণতার মূল কারণই তো একটা- শুষ্ক ত্বককে সজীব ও সতেজ রাখা।
আত্ম ও স্বাস্থ্যসচেতন সকলেই চেষ্টা করেন, যতটা সম্ভব ত্বকের মধ্যে ময়েশ্চার বা আর্দ্রতা ধরে রাখতে। স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছাড়াও সৌন্দর্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রভাবক। কেননা ত্বকের শুষ্কতা আমাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের হানি করে। সুতরাং এর থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে চাওয়ার আকুলতাও অমূলক নয় মোটেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কখন বলতে পারব আমাদের ত্বক শুষ্ক কিনা? সাধারণভাবে বলা যায় যে, যখন আমাদের চামড়াতে পানির পরিমাণ কমে যায়, তখনই শুষ্কতার শুরু হয়। কারো ত্বক শুষ্ক হলে সে নিজেই কিছু লক্ষণ দেখে তা বুঝতে পারে।
এছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায়, ড্রাই স্কিন বা ত্বকের শুষ্কতার একটি মাপকাঠি নির্ধারণ করা আছে। আমরা যে চামড়া বা ত্বক বাইরে থেকে দেখি, এর দু’টি প্রধান স্তর রয়েছে। একদম বাইরের স্তর, যা আমরা দেখতে পারি, তার নাম এপিডার্মিস। এর নিচের স্তরটির নাম ডার্মিস।
এপিডার্মিসের মধ্যে আবার পাঁচটি উপস্তর আছে, যার সবচেয়ে ওপরের স্তরটির নাম স্ট্র্যাটাম করনিয়াম। এটিই মূলত আমাদের ত্বকের বহিরাবরণ তৈরি করে। এর অনেক কাজের মধ্যে একটি কাজ হচ্ছে ত্বকের মধ্যে আর্দ্রতার যথাযথ পরিমাণ রক্ষা করা।
সাধারণত আমাদের শরীরে যে পরিমাণ পানি আছে, তার ১৫-২০ শতাংশ এই স্ট্র্যাটাম করনিয়ামে থাকে। কোনো কারণে পানির পরিমাণ যদি ১০ শতাংশের নিচে নেমে যায়, তাহলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় যে, ত্বক শুষ্ক হয়ে গেছে।
পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে শুষ্কতার নানারকম লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। কারো ক্ষেত্রে শুধুমাত্র চামড়া শুষ্ক রুক্ষ হয়ে কুঁচকে যায়। অনেকের চামড়াতে চুলকানিও হতে পারে।
আবার শুষ্কতার পরিমাণ বাড়লে ফেটে যেতে পারে ত্বক। খুব চরম পর্যায়ে ত্বকের ফাটা অংশ অনেক গভীরে ডার্মিস অবধি চলে যায় এবং সেখানে অবস্থিত রক্তনালিতে ক্ষত তৈরি করে। এর ফলে ত্বক থেকে রক্তপাত পর্যন্ত হতে পারে।
এবারে আসা যাক, ঠিক কী কী কারণে ত্বকের এই সমস্যা হতে পারে। মোটাদাগে এর কার্যকারণকে আমরা দু’টি ভাগে ভাগ করতে পারি- ফিজিওলজিক্যাল বা শারীরবৃত্তীয় এবং প্যাথলজিক্যাল বা রোগসম্বন্ধীয়।
ফিজিলজিক্যাল কারণটি আমাদের শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, পরিবেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিবর্তন। বিশেষ করে শীতকালে অথবা মরুভূমিতে যখন বাতাসে আর্দ্রতা কমে যায়, তখন প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের ত্বকের পানি পরিবেশে চলে যায়, ফলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়।
এছাড়াও বয়সের সাথে সাথে আমাদের ত্বকে কিছু পরিবর্তন আসে, যার পরিপ্রেক্ষিতে চামড়া শুষ্ক হতে থাকে। এর কারণ হলো, স্ট্র্যাটাম করনিয়াম আসলে আমাদের ত্বকে একটি ব্যারিয়ার বা দেয়াল রূপে কাজ করে, যা এপিডার্মিস থেকে পানি বের হয়ে যেতে বাধা দেয়। এই দেয়ালের মূল উপাদান হিসেবে আছে কিছু লিপিড বা চর্বিজাতীয় পদার্থ, যা ভেদ করে সাধারণত পানি যেতে পারে না। বয়সের সাথে সাথে এই পদার্থের পরিমাণ চামড়াতে কমতে থাকে, ফলে এই দেয়াল দুর্বল হয়ে যায় এবং আর্দ্রতাকে যথাযথভাবে ধরে রাখতে পারে না। সাধারণত পঞ্চাশ পেরোনোর পর এরকমটা বেশি দেখা যায়।
দিনে একাধিকবার গোসল করলে, খুব ঠাণ্ডা বা গরম পানি ব্যবহার করলে অথবা কড়া ক্ষার সম্বলিত সাবান দিয়ে শরীর পরিষ্কার করলেও স্ট্র্যাটাম করনিয়ামের লিপিড ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর ফলস্বরূপ অতিরিক্ত পানি চামড়া থেকে বের হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় এয়ারকন্ডিশনের মধ্যে থাকলেও ত্বকের আর্দ্রতা কমে শুষ্ক হয়ে যেতে পারে।
এবারে আসা যাক প্যাথোলজিক্যাল কারণ প্রসঙ্গে। বেশ কিছু রোগের কারণেও ত্বকে শুষ্কতা দেখা দেয়। যেমন- অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস ও সরিয়াসিস।
অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস মূলত শিশু অবস্থায় শুরু হয় এবং এতে শুষ্কতার সাথে প্রচণ্ড চুলকুনি থাকে, চামড়া পাতলা ও লালচে হয় এবং চুলকুনির তীব্রতার জন্য রাতে ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটে।
সরিয়াসিস সাধারণত কৈশোর বা মধ্যবয়সে প্রকাশ প্রায়। এ রোগে চামড়া বিক্ষিপ্তভাবে পুরু ও মোটা হয়ে যায়, বড় বড় ফাটল দেখা দেয় এবং অনেক সময় ত্বক থেকে রক্তপাত হয়।
অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস ও সরিয়াসিস একবার হলে সারাজীবন থাকে। এসব রোগী কিছু সময় ভালো থাকে এবং অন্যান্য সময় রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়, যা ফ্লেয়ার নামে পরিচিত। এসব রোগে ত্বকের শুষ্কতার ভয়াবহতা অনেক বেশি।
চর্মরোগ ছাড়াও অন্যান্য কিছু রোগে ত্বকের শুষ্কতা অন্যতম উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে, যেমন- ডায়াবেটিস। প্রায় সব ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রেই ত্বকের শুষ্কতা একটি বড় সমস্যা এবং অধুনা এই সমস্যার ব্যাপারে চিকিৎসকরাও অনেক সচেতন হচ্ছেন। কিডনি জটিলতার লক্ষণ হিসেবেও অনেকসময় ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে।
আমরা তাহলে শুষ্ক ত্বকের থেকে বাঁচার জন্য কী করতে পারি? কথায় বলে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের পথে হাঁটা শ্রেয়। দৈনন্দিন জীবনযাপনে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে ত্বকের শুষ্কতার ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমন-
- দৈনিক একবারের বেশি গোসল না করা;
- গোসলের জন্য কুসুম গরম পানি ব্যবহার;
- সাবান বা কসমেটিক এমন ধরনের ব্যবহার করা- যা ত্বকের কোনো ক্ষতি করে না;
- গোসল করার পরে একদম শুকনো করে গা না মোছা (একটু ভেজা ভেজা রাখা);
- শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে দীর্ঘ সময় অবস্থান না করা এবং
- শীতকালে ত্বকের আর্দ্রতা রক্ষায় উপযুক্ত ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা।
ক্রিম বা লোশন ব্যবহারের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, এগুলো ব্যবহারের সর্বোত্তম সময় হলো, গোসলের ঠিক পরপর, কারণ এই ক্রিম বা লোশন ত্বকের উপর একটি আলাদা আবরণ তৈরি করে, যা চামড়াতে থাকা পানি ধরে রাখতে সহায়তা করে। সুতরাং গোসলের জন্য ত্বকে যে পানি জমা হয়, তা ধরে রাখা যায়। আরও একটি ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে যে, ক্রিম ব্যবহার করা উচিত অল্প জায়গার জন্য, আর বড় জায়গার জন্য লোশন।
এ তো গেলো এমন সব পদক্ষেপের কথা, যা আমরা নিজেরাই নিতে পারি। কিন্তু অবস্থা কিছুটা জটিল মনে হলেই নিজে নিজে বাহাদুরি করবার বদলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বিশেষ করে যদি শিশুর চামড়া সবসময় শুষ্ক রয়ে যায় এবং কোনোভাবেই উন্নতি না হয়, সেই সঙ্গে চুলকুনি হয়, চামড়া লাল হয়ে যায়, পুরু ও মোটা চাকা দেখা যায়, অথবা চামড়া থেকে রক্তপাত হয়- তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেকে কিছু করা যাবে না।
এছাড়াও বংশে যাদের অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস বা সরিয়াসিসের ঘটনা আছে, তাদের শুষ্ক চামড়া থাকলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা ভালো। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অবশ্যই কোনো ওষুধ ত্বকে প্রয়োগ করা উচিত নয়।
যে কারণেই হোক না কেন, শুষ্ক ত্বক এমন একটি সমস্যা, যা উপেক্ষা করা সম্ভব নয় এবং উচিতও নয়। আমরা যদি উপরোল্লিখিত কিছু সাধারণ নিয়ম, তাহলে এর ঝুঁকি বহুলাংশে কমে যাবে। রোগের কারণে হলে বর্তমানে বিভিন্ন ওষুধ আছে যার মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা এবং ত্বকের শুষ্কতাকে কমিয়ে আনা যায়। প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা ও প্রয়োজনমতো চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।