২৯ জুলাই, ২০০১; হারারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টটা বেগুনী রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল। গ্যালারি ভরে গিয়েছিল বেগুনী পোশাকে মাঠে আসা চার্চিল স্কুলের বাচ্চাদের কারণে। এমন নয় যে, এই বাচ্চারা রোজ টেস্ট দেখতে মাঠে আসে। এই টেস্টে এসেছে, কারণ তাদের এক বন্ধু স্কুল পোশাক ছেড়ে সাদা পোশাকে টেস্ট খেলতে নেমে গেছে। বাচ্চাদের মাঠে আসা সার্থক, দ্বিতীয় ইনিংসে সারা বিশ্বকে হতভম্ব করে দিয়ে সেই ১৬ বছর বয়সী স্কুলছাত্রটিই টেস্ট সেঞ্চুরি করে ফেলল। দুনিয়া জানলো নতুন এক ব্যাটসম্যানের নাম, হ্যামিল্টন মাসাকাদজা।
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯; চট্টগ্রাম। গ্যালারিতে হাতে গোনা কয়েকজন জিম্বাবুয়ের দর্শক। তার মধ্যেই পিঠে ‘মুধারা’ লেখা একটা জার্সি পরে ইনিংস শুরু করতে নামলেন দুনিয়ার অভিজ্ঞতম একজন ক্রিকেটার, জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক। তাকে বিমূঢ় করে দিয়ে সতীর্থরা ব্যাট দিয়ে তোরণ বানিয়ে গার্ড অব অনার দিল। চোখ ভিজে এলো ক্রিকেটারটির। কিন্তু অশ্রু তার অভিজ্ঞ চোখকে ঝাপসা করতে পারল না, বল ঠিকই দেখলেন। ক্যারিয়ারের শেষ দফাতেও খেললেন ৭১ রানের এক অসামান্য ইনিংস। দুনিয়া জানল, আজ চলে যাচ্ছেন ছোট দেশের এক বিরাট তারকা, হ্যামিল্টন মাসাকাদজা।
এই দুটো গল্প শুনে মনে হতে পারে, মাসাকাদজার জীবনটা এমন ফুলের চাদরে ঢাকা ছিল। জীবনের শুরু ও শেষটা বড়ই সোনালী। কিন্তু এর ভেতরে ঘটে গেছে অনেক নাটক। প্রায় দুই দশকের এই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে দেখেছেন অনেক উত্থান-পতন। নিজের জীবনটা ভরে রয়েছে নানারকম নাটকীয়তায়। সেই সাথে যে দেশটির হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন, সেই দেশে দেখেছেন ক্রিকেটের কয়েকটি যুগ। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে সোনালী যুগে শুরু করেছিলেন, সাক্ষী আছেন সেই দেশের একটু একটু করে ক্রিকেট ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে। এবং নিজে বলেছেন, শেষটা এমন সময়ে করছেন, যখন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সত্যিকারের এক ত্রিকালদর্শীর নাম হ্যামিল্টন মাসাকাদজা।
হারারের দরিদ্রতম এক এলাকায় জন্ম হ্যামিলটনের। জিম্বাবুয়েতে কৃষ্ণাঙ্গদের সেভাবে ক্রিকেট খেলার প্রচলন নব্বইয়ের দশকে ছিল না। কিন্তু এর মধ্যেই স্কুলে ও পাশের ক্লাবে দেখে দেখে এই খেলাটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন হ্যামিল্টন। বলে রাখা ভালো, তাকে দেখে ও তার পথ ধরে তার আরও দুই ভাই ওয়েলিংটন ও সিঙ্গিরাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অবধি এসেছিলেন।
ভাইদের এই পর্যন্ত আসাটা কঠিন ছিল না। কারণ, সামনে হ্যামিল্টন ছিলেন। কিন্তু হ্যামিল্টনের সামনে সেরকম কোনো উদাহরণ ছিল না। বাবা-মা জানতেনই না, ক্রিকেট খেলাটা কী। দরিদ্র পরিবার, সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তারপরও ছেলের আবদার মেনে নিয়ে তাকে ক্রিকেটের খরচ জুগিয়েছেন বাবা।
ক্লাব ক্রিকেটেই অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের মতো কিংবদন্তিকে পেয়ে গিয়েছিলেন। হ্যামিল্টন নিজের ব্যাটিংয়ে উন্নতির জন্য অনেক কৃতিত্ব দেন কিংবদন্তি অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে। ক্রিকেটে আসতে না আসতেই, বলা চলে শৈশবেই, নাম ডাক করে ফেললেন।
১৬ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে নেমে সেঞ্চুরি করে ফেললেন। সেটা ছিল এক বিষ্ময়কর ঘটনা। এত কম বয়সে প্রথম শ্রেণির সেঞ্চুরি তো অবশ্যই আলোচ্য। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এটা ছিল জিম্বাবুয়েতে কৃষ্ণাঙ্গ কোনো ক্রিকেটারের করা প্রথম সেঞ্চুরি।
এই ধারাবাহিকতায় টেস্ট অভিষেক হয়ে গেল ২০০১ সালে। আর বিশ্ব যেমনটা জানে, এক অসাধারণ সেঞ্চুরি দিয়ে শুরু হলো। পরের টেস্টেই ৮৫ রানের একটা ইনিংস খেললেন। ওই বছর ওয়ানডে অভিষেকও হলো। কিন্তু স্বপ্নের এই সময়টাকে নিজেই থামিয়ে দিলেন হ্যামিল্টন। বাসার চাপ ছিল, এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। তাই ক্রিকেট রেখে পড়াশোনা করতে গেলেন।
হ্যামিল্টন নিজে বলেছেন, জিম্বাবুয়েতে তখন এই নিশ্চয়তা ছিল না যে, ক্রিকেট খেলেই জীবন কাটানো যাবে; কার্যত এখনও সে নিশ্চয়তা নেই। তাই স্কুলপর্ব শেষ করে শুধু ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকার সাহস হয়নি। মার্কেটিং বিষয়ে পড়াশোনার জন্য চলে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। তিন বছরের একটা বিরতি পড়লো ক্যারিয়ারে। আর এই সময়ে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে ঘটে গেলো এক প্রতিবিপ্লব।
মুগাবে সরকারের নীতির বিরোধিতা করতে ২০০৩ বিশ্বকাপে হাতে কালো ব্যান্ড পরে ক্রিকেট খেলতে নামলেন কয়েকজন ক্রিকেটার। এর জের ধরে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট হারাল অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, হেনরি ওলোঙ্গা থেকে শুরু করে সোনালী প্রজন্মের সব তারকাকে। এরপরও হিথ স্ট্রিকরা দাঁতে দাঁত চেপে ক্রিকেটটা ধরে রেখেছিলেন।
সেই সময়ে, ২০০৪ সালে আবার ক্রিকেটে ফিরলেন হ্যামিল্টন। ফিরেই দেখলেন একটার পর একটা অস্থিরতা। কখনো বেতনের দাবিতে, কখনো প্রশিক্ষণের দাবিতে, কখনো স্বচ্ছ প্রশাসনের দাবিতে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা একটার পর একটা ধর্মঘটে যান। একঝাঁক ক্রিকেটার হারায় দেশটি। মিটমিট করে জ্বলতে থাকে দেশটির ক্রিকেট-প্রদীপ। আর এর মধ্যেও মশাল জ্বালিয়ে রাখেন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা।
ফর্মহীনতার জন্য ২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপ দলে ঠাঁই হলো না। এটা এখনও জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এবং হ্যামিল্টনের জন্য অন্ধকার এক অধ্যায়। সেই ধাক্কাও শেষ করতে পারেনি মাসাকাদজাকে। তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন, ২০১৫ সালে এসে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নপূরণ হলো। কিন্তু ২০১৯ বিশ্বকাপে দলই সুযোগ পেল না।
২০১৯ সালেই ক্রিকেট জিম্বাবুয়ে ঘোষণা করলো, এখন থেকে সব ফরম্যাটের অধিনায়ক আবার হ্যামিল্টন। কিন্তু তিনি ততদিনে নিজের শেষ দেখে ফেলেছেন। আর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা টেনে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হলো না।
ইচ্ছে ছিল, আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে অবসরে যাবেন। কিন্তু এর মধ্যে জিম্বাবুয়ের নির্বাচিত ক্রিকেট বোর্ড ভেঙে দিল দেশটির সরকার। ফলে আইসিসি নিষিদ্ধ করলো জিম্বাবুয়েকে। ফলে ২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে পারছে না তারা। হ্যামিল্টন বলেছেন, যেহেতু এই আসরটাই খেলা হচ্ছে না, এবং পরের ওয়ানডে বিশ্বকাপ আরও দূরে, তাই তিনি আর চালিয়ে যাওয়ার কারণ দেখেন না। বলে দিলেন, বাংলাদেশে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট খেলেই শেষ করবেন নিজের ক্যারিয়ার।
বাংলাদেশে এই শেষ করায় একটা আবেগের ছোঁয়াও পেলেন হ্যামিল্টন। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
‘এত এত সময় এই দেশে কাটিয়েছি। জিম্বাবুয়ের বাইরে দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশেই আমি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি। অনেক স্মৃতি বাংলাদেশে। এই দেশ আমার দ্বিতীয় ঘরের মতো। এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি। এত এত লোকের সঙ্গে পরিচয়, অনেক বন্ধু… বাংলাদেশে আমি সবসময়ই উপভোগ করেছি। আমাদের থেকে পুরো ভিন্ন একটি সংস্কৃতিকে এত কাছ থেকে দেখা ও জানতে পারাও ছিল উপভোগ্য। এত ঘন ঘন এখানে এসেছি, আমার ক্যারিয়ারের বড় অংশজুড়ে এই দেশ। যেটা বললাম, বাংলাদেশ আসলেই আমার দ্বিতীয় বাড়ির মতো।’
অবশেষে সেই বিদায়ের ক্ষণটা এলো।
৩৮ টেস্ট, ২০৯ ওয়ানডে ও ৬৬ টি-টোয়েন্টির ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল। টেস্টে ৩০.০৪ গড়ে ২,২২৩ রান করেছেন। ওয়ানডেতে ২৭.৭৩ গড়ে ৫,৬৫৮ রান করেছেন এবং টি-টোয়েন্টিতে ১,৬৬২ রান করেছেন। নিজেই বলেছেন, ক্যারিয়ারে অনেক কিছু অর্জন করলেও এই ক্যারিয়ার নিয়ে সন্তুষ্ট নন তিনি। আরও অনেক কিছু করার ছিল। এই না করতে পারার অতৃপ্তি নিয়েই বিদায় বললেন মাসাকাদজাদের বড় ভাই।
তবে সব অতৃপ্তি ঢাকা পড়ে গেল চোখে পানি ও ভালোবাসায়। শেষ বেলায় সতীর্থদের কাছ থেকে যে সম্মান পেলেন, তা কল্পনা করেননি। আবেগটা ধরে রাখতেই কষ্ট হচ্ছিল। শেষ সংবাদ সম্মেলনে বললেন,
‘ছেলেরা আমাকে যে ‘গার্ড অফ অনার’ দিয়েছে, সেটির মাঝ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ছিল বিশেষ অনুভূতি। আমি ভেবেছিলাম, ম্যাচশেষে কিছু করা হতে পারে। আবেগ অনেকটাই স্পর্শ করেছিল। পরে মাঠ ছাড়ার সময় আমি বেশ খুশি ছিলাম। কারণ দলকে ভালো অবস্থানে নিতে যা করার প্রয়োজন ছিল, তার অনেকটাই করতে পেরেছি। আজকের পারফরম্যান্সে আমি তৃপ্ত।’
সব অতৃপ্তি ছাপিয়ে এই পাওয়ার তৃপ্তি নিয়ে গেলেন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। শেষ হলো ক্রিকেটের একটা অধ্যায়।