Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্যুরিয়ালিজম: আসুন ডালিদের হাত ধরে হারাই পরাবাস্তব চিত্রশিল্পের জগতে

পাহাড়-সমু্দ্র বেষ্টিত বিজনভূমি। সেখানে গাছের ডালে লটকে আছে গলিত ঘড়ি। মাটিতেও পড়ে আছে গলে যাওয়া নানা আকৃতি ও চেহারার ঘড়ি। একপাশে পিঁপড়া। স্যুরিয়ালিজমের প্রসঙ্গ আসলেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল সময়কে গলিত ঘড়ির পরাবাস্তব আবহে ফুটিয়ে তোলা সালভাদর ডালির অবিস্মরণীয় চিত্রকর্ম ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। অবচেতন মনের বাধাহীন চিন্তাকে ক্যানভাসে কব্জা করে অদ্ভুত সব ছবি আঁকার যে ধারা ১৯২০ এর দশকে প্যারিসে শুরু হয়েছিল, তাকে স্যুরিয়ালিজম বলা হয়। তবে স্যুরিয়ালিজম নিছক চিত্রকলার কোনো ধারা নয়, বরং এটি সাহিত্য, ফটোগ্রাফি, সিনেমা প্রভৃতি নানা জগতকে শক্তিশালীভাবে নাড়া দেয়া একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নাম। আজ থাকছে স্যুরিয়ালিজমের উৎস, প্রকৃতি প্রভৃতি নানা বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।

সালভাদর ডালির বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’; Image Source: mental floss

ইতিহাস

ইউরোপের শিল্প ও সাংস্কৃতিক জগতের উপর প্রথম বিশ্বযু্দ্ধের ব্যাপক প্রভাব ছিল। প্রথম বিশ্বযু্দ্ধ চলাকালীন সময়ে একদল শিল্পী যুদ্ধ, সহিংসতা, নিযার্তন-নিপীড়ন, জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা বিশ্বাস করতো, এনলাইটমেন্টের যুগের অতিরিক্ত যুক্তিবাদী চিন্তার কারণে সমাজে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে মহাযু্দ্ধের আবির্ভাব। তাই তারা সকল যুক্তি, বুদ্ধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এমন একধরনের শিল্প ধারা গড়ে তোলে যা ছিল প্রচলিত শিল্পের একেবারে বিপরীত বা এন্টিআর্ট। তারা অযৌক্তিক বিষয় লিখতে শুরু করে, অর্থহীন ছবি আঁকা শুরু করে। ইতিহাসে তাদের এই আন্দোলন ‘দাদা আন্দোলন’ নামে পরিচিত। দাদা আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলেন ফরাসী কবি আঁন্দ্রে ব্রেটন।

স্যুরিয়ালিজমের প্রবক্তা আঁন্দ্রে ব্রেটন; Image Source: exploring your mind

ব্রেটন পড়াশোনা করেছিলেন মেডিসিন ও সাইকিয়াট্রিতে। মানসিক অসুস্থতার ব্যাপারে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। যু্দ্ধের সময় তিনি একটি নিউরোবায়োলিক্যাল ওয়ার্ডে কর্মরত ছিলেন। তার এই অভিজ্ঞতা তাকে অবচেতন মন সম্পর্কে ধারণা যুগিয়েছিল। এছাড়া তিনি ছিল সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সাইকোঅ্যানালিটিক্যাল লেখার বেশ ভক্ত। যুদ্ধের শেষে ব্রেটন প্যারিসে ফিরে আসেন এবং ল্যুইস এরাগন ও ফিলিপ সপাল্টকে সাথে নিয়ে ‘লিটারেচার’ নামক একটি জার্নাল প্রকাশ করেন। এই জার্নালে তারা বিশেষ এক পদ্ধতিতে লিখতে শুরু করেন যাকে ‘অটোমেটিক রাইটিং’ বলা হতো। এই পদ্ধতিতে লেখক তার অবচেতন মনের চিন্তা-ভাবনাকে সচেতন মনের প্রভাব এড়িয়ে, কোনো কাটছাট না করে প্রকাশ করতেন। তাদের লক্ষ্য ছিল যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনার আধিপত্যের কারণে অচেতন মনোজগতের যেসব সুকুমারবৃত্তি অবদমিত হয়ে পড়েছিল তা অবমুক্ত করে দেয়া। চিন্তা, ভাষা এবং মানবীয় যাবতীয় অভিজ্ঞতাকে যুক্তিবাদের দৌরাত্ম্য থেকে রক্ষা করা।

ব্রেটন ঘোষিত স্যুরিয়ালিজমের মেনিফেস্টো; Image Source: Abe books

অবশেষে ব্রেটন ১৯২৪ সালে ‘দ্য স্যুরিয়ালিস্ট মেনিফেস্টো’ প্রকাশ করেন। তিনি স্যুরিয়ালিজমকে সজ্ঞায়িত করেন এভাবে, 

স্যুরিয়ালিজম হচ্ছে অবচেতন মনের অনৈচ্ছিক চিন্তা যা কেউ কথার মাধ্যমে, লেখার মাধ্যমে বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে। সেই চিন্তা যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত হবে না, নৈতিকতা বা সৌন্দর্যবোধের উর্ধ্বে হবে।

‘স্যুরিয়ালিজম’ শব্দটি অবশ্য প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ফরাসি লেখক গিয়োম এপোলোনেয়ার, ১৯১৭ সালে। ব্রেটন ভিজ্যুয়াল আর্টকে খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না, কারণ তার ধারণা ছিল ছবি আঁকার মতো জটিল বিষয়ে অবেচেতন চিন্তার প্রয়োগ ঠিক সম্ভব নয়। পরে চিত্রশিল্পীরা স্যুরিয়ালিস্ট ছবি আঁকতে শুরু করলে তার চিন্তায় পরিবর্তন আসে এবং তিনি চিত্রশিল্পীদের দলভুক্ত করেন। প্রথমদিকে ম্যাক্স আর্নস্ট, রেনে মাগ্রিত, জোয়ান মিরো, আঁন্দ্রে ম্যাসন প্রমুখ শিল্পীরা স্যুরিয়ালিজম আন্দেলনে যোগ দেন। ব্রেটন ছিলেন মনেপ্রাণে একজন মার্ক্সবাদী। তাই দ্রুতই স্যুরিয়ালিজম একটি রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৩০ সালে ব্রেটন দ্বিতীয় মেনিফেস্টো ঘোষণা করেন।

স্যুরিয়ালিমে আঁকা ছবির বৈশিষ্ট্য

ব্রেটনের মতো স্যুরিয়ালিজমের শিল্পীরাও দাদা আন্দোলন ও ফ্রয়েডের ড্রিম থিওরি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। স্বপ্ন অবদমিত আশা-আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ- এটি ছিল স্যুরিয়ালিজমের তাত্ত্বিক ভিত্তি। ইমপ্রেশনিস্টদের অনুপ্রেরণা যেমন ছিল প্রকৃতি, স্যুরিয়ালিস্টদের অনুপ্রেরণা তেমনই স্বপ্ন ও কল্পনা। এছাড়া জর্জদে কিরিকোর মেটাফিজিক্যাল চিত্রকর্ম স্যুরিয়ালিজমের দার্শনিক ভাবধারা ও ভিজ্যুয়াল আর্টকে প্রভাবিত করেছিল। তার আঁকা ‘দ্য রেড টাওয়ার’ ছবির কালার কনট্রাস্ট ও আঁকার ভঙ্গি স্যুরিয়ালিস্টরা গ্রহণ করেন।

কিরিকোর আঁকা ‘দ্য রেড টাওয়ার’; Image Source: wiki art

যৌক্তিক চিন্তার গোড়ায় আঘাত করা ছিল স্যুরিয়ালিস্টদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই তারা অবচেতন মানসের ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ছবিতে এমন একটা জগত সৃষ্টি করতেন যা বাস্তবে চিন্তা করা যায় না। স্যুরিয়ালিস্টিক চিত্রকর্মে বিস্ময়কর সব উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। শিল্পীরা ছবিতে এমন সব বিষয়কে পাশাপাশি উপস্থাপন করতে থাকেন যা বাস্তব জগতে নেই। এসব অবাস্তব বিষয়কে তারা প্রচন্ড নিখুঁতভাবে আঁকতেন।

একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আপনি কোনো এক ‘হল অব মিররে’ আছেন। কেউ নেই আশেপাশে, আপনি একা। জায়গাটি থেকে বের হবার কোনো পথ নেই, স্রেফ আটকা পড়েছেন আপনি। এমন অবস্থায় আপনার অবচেতন মনে যে তীব্র ভয়, যে অনুভূতি তৈরি হবে তা-ই আপনি যদি স্বাপ্নিক কোনো জগত তৈরি করে,অদ্ভুত চিত্রকল্পের সাহায্যে ছবিতে প্রকাশ করেন, তাহলে সেই ছবিটিকে স্যুরিয়ালিস্ট ছবি বলা হবে।

স্যুরিয়ালিজমে দুই ধরনের ছবি লক্ষ্য করা যায়। প্রথম ধরনের ছবিগুলোতে অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য সব বিষয়বস্তু আঁকা হয়েছে তবে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে ছবিগুলোতে। দর্শক যখন ছবিগুলো দেখে তখন অবচেতনভাবে চিত্রকল্পগুলো নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। এভাবে তার কল্পনার জগত খুলে যায়। ম্যাক্স আর্নস্ট, ম্যাসন, জেয়ান মিরো এই ধরনের ছবি এঁকেছেন। অন্যদিকে দ্বিতীয় ধরনের ছবিগুলো খুবই স্পষ্ট ও নিখুঁতভাবে আঁকা। কিন্তু এগুলোতে বিষয়বস্তু এমনভাবে সাজানো হয়েছে যা রীতিমতো হতবুদ্ধিকর, চোয়াল ঝুলে পড়ার মতো। রেনে মাগ্রতি এরকম সাধারণ উপাদান দিয়ে অসাধারণ ছবি এঁকেছেন। যেমন- টেবিলে একটুকরো হ্যাম পড়ে আছে, তার মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে মানুষের চোখ। সালভাদর ডালির ছবিতেও এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করা যায়।

প্রধান প্রধান শিল্পী

দাদা আন্দোন দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দাদা শিল্পী স্যুরিয়ালিজমে অংশ নেন। অবশ্য এখানে শুধু স্যুরিয়ালিজমের সেরা শিল্পীদের আলোচনাই করা হবে।

সালভাদর ডালি

নিঃসন্দেহে ডালি ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত স্যুরিয়ালিস্ট ছবিগুলো এঁকে গেছেন। তিনি ছিলেন কল্পনাপ্রবণ ও খেয়ালি। তার আচরণেই সেটা শুধু প্রকাশ পেয়েছে এমন নয়, প্রকাশ পেয়েছে তার ছবিগুলোতেও। আঁকার ক্ষেত্রে তিনি এক বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, যাকে ‘Paranoiac critical method’ বলে। স্বেচ্ছা প্যারানয়া এবং হ্যালুসিনেশনের মাধ্যমে মনে যে চিন্তা আসত সেটাই তিনি ক্যানভাসে আঁকতেন।

সালভাদর ডালির পরাবাস্তব সেল্ফ পোর্ট্রেট; Image Source: 1zoom.me

যেমন- ‘সফট সেল্ফ পোর্ট্রট উইথ গ্রিলড বেকন’ ছবিটি। ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ ছবিটির জন্যই তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত।

জোয়ান মিরো

মিরো দুর্বোধ্য সব বিষয়বস্তুর সমন্বয়ে বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন। নিত্যদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, প্রাকৃতিক পরিবেশ তার বেশ কিছু ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড গঠন করেছে। তার জন্মভূমি স্পেনের কাতালুনিয়ার প্রতি বিশেষ টান তার ছবিতে ফুটে ওঠে। দ্য হান্টার, দ্য হার্লিক্যুইন কার্নিভাল প্রভৃতি তার বিখ্যাত ছবি।

জোয়ান মিরোর মাস্টারপিস ‘দ্য হান্টার’; Image Source: the new york times

রেনে মাগ্রিত 

মেঘ, আপেল, বাউলার হ্যাট, পাইপ- রেনে মাগ্রিতের নাম শুনলে এই জিনিসগুলোই কল্পনায় ভেসে আসে। সাধারণ কোনো জিনিসকে অস্বাভাবিক কোনো দৃশ্যে বসিয়ে উদ্ভট আবহ সৃষ্টি করাই রেনের ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য। দ্য সন অব ম্যান, দ্য ট্রেচারি অব ইমেজেস তার বিখ্যাত ছবি।

রেনে মাগ্রিতের আঁকা ‘দ্য সন অব ম্যান’; Image Source: forbes

‘দ্য সন অব ম্যান’ ছবিতে দেখা যায় বাউলার হ্যাট পরা এক লোকের চেহারা ঢেকে আছে একটি সবুজ আপেল দিয়ে। এই ছবিটি সম্পর্কে রেনে বলেন, “আমরা যা দেখি তা আসলে অন্যকিছুকে আড়াল করে রাখে। আমরা যদিও আড়ালে থাকা জিনিসটাই দেখতে চাই।

ম্যাক্স আর্নস্ট

চিত্রশিল্পে ম্যাক্স আর্নস্টের সবচেয়ে বড় অবদান ফ্রটাজের আবিষ্কার। এটি একটি ছবি আঁকার পদ্ধতি যাতে কোনো একটা খসখসে পৃষ্ঠের উপর কাগজ রেখে তাতে পেন্সিল দিয়ে ঘষা হয় যেন কাগজে দাগ তৈরি হয়। ‘দ্য এলিফ্যান্ট সেলেবেস’ তার বিখ্যাত ছবি। ছবিটিতে সুদানি একটি শস্যের বিনকে হাতি হিসেবে দেখানো হয়েছে।

ফ্রটাজে আঁকা ছবি; Image Source: kunst nerd

ইভ তঙ্গি

ডালি এবং মিরোর সাথে অঙ্কনশৈলীর মিল থাকলেও তিনি মূলত কিরিকে দ্বারা বেশি প্রভাবিত। তার লাইন ও কালারের ব্যবহারে ফটোরিয়েলিজমের সাথে বেশ মিল লক্ষ্য করা যায়। শৈশবের স্মৃতি ও হ্যালুসিনেশন ছিল তার ছবি আঁকার প্রেরণা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে স্যুরিয়ালিজমের শিল্পীরা ইউরোপ ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। অনেকেই আশ্রয় নেন আমেরিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায়।

মেক্সিকান শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর আঁকা ‘দ্য টু ফ্রিদা’; Image Source: basil green pencil

ল্যাটিন আমেরিকান শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর ছবির সাথে স্যুরিয়ালিস্ট ছবির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও তিনি কখনোই সরাসরি স্যুরিয়ালিজমের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

স্যুরিয়ালিজম আজও পৃথিবীর চিত্রশিল্পীদের কাছে জনপ্রিয় একটি ধারা। এখনও বিশ্বের নানা প্রান্তের শিল্পীরা রহস্যময়, কুহেলিকাপূর্ণ স্যুরিয়ালিস্ট ছবির চর্চা করে যাচ্ছেন।

This is a Bangla article on surrealism. History, influence of this cultural movement are disscussed inside the article. All the informations are hyperlinked inside the article.

Feature Image - Mental Floss

Related Articles