বর্তমানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কবলে রয়েছে বিশ্বের ১৫৮টি দেশ। এই ভাইরাসে প্রায় দেড় লাখের বেশি মানুষ সংক্রমিত এবং এর ফলে এখন পর্যন্ত মারা গেছে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে মহামারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর এরপর থেকেই বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। এই ভাইরাসের দরুন এলোমেলো হয়ে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি। প্রতিটি দেশে সংক্রমণের উৎপাত না থাকলেও দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় করোনাভাইরাস ধ্বংস বয়ে নিয়ে এসেছে। মোটরগাড়ি শিল্প, শেয়ার বাজার, পর্যটন শিল্প, তেলের বাজার; সবকিছুতেই এই ভাইরাসের কারণে দেখা যাচ্ছে মন্দা।
অটোমোবাইল বা মোটরগাড়ি শিল্প
চীন বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ির বাজার। আর উহান, যেখান থেকে মূলত করোনা ভাইরাসের উৎপাত শুরু হয়, সেই শহর ‘মোটর সিটি’ নামে পরিচিত। এই শহরে জেনারেল মোটরস, হোন্ডা, নিশান, পিউগেওট গ্রুপ এবং রেনল্টের মতো বড় বড় অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠানের মোটর প্লান্ট রয়েছে। স্বভাবতই করোনা ভাইরাসের প্রকোপে মোটরগাড়ি শিল্পের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শুধুমাত্র হোন্ডার ক্ষেত্রে চিন্তা করলে দেখা যায়, এর ৫০% উৎপাদন হয় চীনে। ২০১৯ সালে উহানের রাজধানী হুবেই ছিল চীনের চতুর্থ বৃহত্তম গাড়ির বাজার এবং সেই বছর হুবেইয়ে ২.২৪ মিলিয়ন গাড়ি তৈরি করা হয়। তবে এই বছরের শুরুতেই পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে যায়। ফেব্রুয়ারির প্রথম অর্ধেকে চীনে গাড়ির বিক্রি ৯২% কমে যায়। এমন না যে শুধু চীনকেই এই ক্ষতির বোঝা বইতে হচ্ছে।
গাড়ির বাজারে রাজত্ব করার দরুন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের জন্য অন্য দেশগুলোকে এখনও চীনের শরণাপন্ন হতে হয়। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির অভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া বিশ্বজুড়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেলে নিত্যদিনের চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হয় সাধারণ জনগণকে। এরকম দুর্দিনে গাড়ির মতো বিলাস দ্রব্যের চাহিদা এবং ক্রয় করার সামর্থ্য কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন- ২০১০ সালে আইসল্যান্ডে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে পুরো মোটরগাড়ি শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিলো। এ কারণে মোটরগাড়ি শিল্পে নিকট ভবিষ্যতে যে অবস্থা আরো খারাপ হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। চায়না’স অ্যাসোসিয়েশন অব অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স (সিএএএম)-এর মতে, বছরের প্রথম অর্ধেকে গাড়ির বিক্রি ১০% এবং পুরো বছরে ৫% কমে যেতে পারে।
শেয়ার বাজার
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি বিশ্ব শেয়ার বাজারেও অবনতি দেখা যাচ্ছে। শেয়ার বাজারে তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে সব শেয়ার সূচক। জাপানের নিক্কি ইনডেক্সে ১০% বা ১৮৬৯.০৩ পয়েন্টের পতন দেখা যায় যা এই দেশের জন্য গত ৩০ বছরের শেয়ার বাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পতন। গত ১১ মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারে দরপতন ৫% পর্যন্ত দেখা যায়। এর মধ্যে ইউরোপীয় শেয়ার বাজারে, বিশেষ করে ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সে গড়ে ৬% দরপতন ঘটেছে এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ৭%।
চীনের সাংহাই কম্পোজিট ১.২৩% পতনে নেমে আসে ২৮৮৭.৪৩ পয়েন্টে। শেনঝেন কম্পোনেন্ট ১% পতনে ১০,৮৩১.১৩ পয়েন্টে এবং শেনজেন কম্পোজিট ১.০৭৬% পতনে ১৭৯৮.৯৮ পয়েন্টে নেমে আসে। চীন ইতোমধ্যে তার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পেরেছে। তবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও আতঙ্ক, কোনোটারই এখনও সমাপ্তি ঘটেনি। তাই চীন বা অন্যান্য দেশের ক্ষতি কতটা পূরণ করা সম্ভব হবে কিংবা পরবর্তী পরিস্থিতি কেমন হবে তা এখনো বলা সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, এই বিশ্ব শেয়ার বাজারের দরপতনের সময়ে বাংলাদেশও স্বস্তিতে থাকতে পারেনি। গত ৯ মার্চ ঢাকার শেয়ার বাজারে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় পতন দেখা যায়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্সে ২৭৯ পয়েন্ট কমে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বজুড়ে এরকম অবস্থা থাকলে ২০০৮ সালের মতো ভয়াবহ পতন দেখা যেতে পারে বিশ্ব শেয়ার বাজারে।
পর্যটন শিল্প
দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডব্লিউটিটিসি)-এর মতে, পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত এরকম ৫০ মিলিয়ন মানুষের চাকরি ঝুঁকিতে রয়েছে। ডব্লিউটিটিসির মতে, এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০২০ সালে ২৫% পতন ঘটবে এই পর্যটনশিল্প খাতে। চীনের এয়ারলাইন্সে গত মাসে যাত্রীদের সংখ্যা ৮৪.৫% কমে গেছে, যার কারণে এই খাতে প্রাপ্ত আয় ২১ বিলিয়ন ইউয়ান বা ২.৩৫ বিলিয়ন পাউন্ড কমে যায়। শুধু চীনের ক্ষেত্রেই নয়, সংক্রমণের ভয়ে অনেক পর্যটকই তাদের ভ্রমণের সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে দিচ্ছে। জরুরি কাজেও দেশের বাইরে যাওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখার চেষ্টা করছে সাধারণ জনগণ। আবার বিভিন্ন দেশে সরকারই বাতিল করে দিচ্ছে ফ্লাইট। দেশের বাইরে যাওয়া কিংবা বাইরে থেকে আসা ফ্লাইট বাতিল করার কারণেও ক্ষতির শিকার হচ্ছে এয়ারলাইনস এবং এগুলোর সাথে জড়িত মানুষগুলো। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পর্যটন খাতে ইতোমধ্যে ১ বিলিয়ন ইউরো বা ১.১ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি দেখা গেছে।
ইতালির পর্যটন শিল্প বেশ ভালো এবং এই দেশের আয়ের একটি বড় অংশ আসে এই খাত থেকেই। আর এই ইতালিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতা বাড়ার সাথে সাথে দেশটির পর্যটন শিল্পে একটি ভয়াবহ ধস নামতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বড়সড় লোকসানের আশঙ্কা করাটাই স্বাভাবিক। তবে এই ক্ষতি কতটা ভয়াবহ হবে সেটা সময়ই বলে দিবে। অবশ্য এই শিল্পের সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞরা জানান যে, বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মার্চ থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত ৭.৪ বিলিয়ন ইউরো বা ১২.৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত মাসে ইতালির শহর ভেনিসের একটি কার্নিভাল দুই দিন আগেই শেষ করে দেওয়া হয় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার ভয়ে। তাছাড়া দ্বিবার্ষিক চারুকলা উৎসব মে মাসে না হয়ে আগস্ট মাসে হবে বলে জানানো হয়েছে। বলা বাহুল্য, এসকল উৎসবে অনেক পর্যটকের আনাগোনা রয়েছে। বর্তমানে তাদের না আসা, অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া বা পেছানো এবং পরবর্তীতে হলেও পর্যটকদের সমাগম কেমন হবে তা নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তা রয়েছে, তেমনই ক্ষয়ক্ষতিরও সম্ভাবনা রয়েছে। যেসকল দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি দেখা যায়নি সেসব দেশের পর্যটনেও প্রভাব পড়ছে। যেমন- মিশর। মিশরে মাত্র কয়েকজনের দেহে এই ভাইরাস পাওয়ার দরুন তা প্রভাব ফেলেছে পুরো পর্যটন শিল্পে।
জ্বালানি তেলের বাজার
বিভিন্ন দেশে যাতায়াত বন্ধ, ফ্লাইট বন্ধ। এর ফলে বিশ্বজুড়ে তেলের চাহিদাও কমে গেছে। তবে তেলের বাজারে তেল চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি রয়েছে। এসব কারণে তেলের বাজার মূল্যে ২৫% পতন ঘটেছে। তেলের দাম বাড়ানোর জন্য কী করা যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনায় বসেন ওপেক ও নন-ওপেক দেশগুলো। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় সংঘটিত এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এসকল দেশ অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন দিনে ১৫ লাখ ব্যারেল কমাবে। এটি বিশ্বের মোট সরবরাহের ৩.৬%। ওপেক প্লাসের সদস্য রাশিয়াকে অনুরোধ করা হয়েছিল যেন রাশিয়া দিনে ৫ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমায়। কিন্তু এতে রাশিয়া তো রাজি হয়ইনি, বরং দিন প্রতি ২ লাখ ব্যারেল তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির কথা ভাবছে রাশিয়া।
উল্লেখ্য, এশিয়া ও ইউরোপে তেলের বাজারে মূল সরবরাহকারী রাশিয়া। অন্যদিকে, সৌদি আরব সবসময়ই রাশিয়ার কাছ থেকে তেলের বাজার নিজের দখলে নিতে চায়। তাই সৌদি আরবও এই শর্ত মানতে নারাজ। এপ্রিল থেকে ২৬ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চায় সৌদি আরব। সংযুক্ত আরব আমিরাতও তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির পক্ষে। সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে না আসতে পারায় বা না মানার কারণে গত ১৩ মার্চ থেকে তেলের বাজারে ব্যাপক দরপতন চলছে। এর মাঝে আবার সৌদি আরব তেলের দাম কমিয়ে দিচ্ছে যা অবস্থা আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এককথায় তেলের মূল্য যুদ্ধে নামছে দেশটি। যার প্রভাব পড়ছে পুরো জ্বালানি তেলের বাজারেই।
করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ধীরে ধীরে সব দেশকেই জব্দ করে ফেলছে। কিছু দেশ এ থেকে উঠে আসতে পারলেও সকলের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এখনও শেষ হয়নি। তাই পরবর্তী পরিস্থিতি কেমন হবে তা নিয়ে নেই কোনো নিশ্চয়তা। বিশ্ব খাদ্যবাজারে এখনও তেমন কোনো মন্দা দেখা যায়নি। তবে কোনো রোগের ব্যাপকতা প্রায়ই খাদ্য বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সীমাবদ্ধতা ও মন্দা খাদ্য বাজারেও যে প্রভাব ফেলবে না তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। বিলাস দ্রব্য থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় এবং একেবারেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজার যেভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে তা কিছুটা চিন্তার বিষয়ই বটে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সকলকে বাঁচানোর পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিকেও কিভাবে এর সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচানো যায় সেটাও ভাবা উচিত।
রোর বাংলা এর বই সমূহ কিনতে ক্লিক করতে পারেন এই লিঙ্কে:
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – অ্যা নাগাসাকি বম্ব সারভাইভার্স স্টোরি
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে