ধরুন, আগামীকাল দেখতে পেলেন কল থেকে আর পানি পড়ছে না, নদী এবং স্রোতপ্রবাহ স্থির হয়ে পড়েছে এবং সমুদ্র পরিণত হয়েছে একটি শুষ্ক উপত্যকায়। এরূপ পরিস্থিতিতে আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আপনি কতদিন বেঁচে থাকবেন?
পানিশূন্যতা কীভাবে দ্রুত একজন মানুষকে ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এর কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র জানা যায়নি। কিছু ব্লগ অনুমানের ভিত্তিতে দাবি করছে যে, একজন মানুষ গড়পড়তা হিসেবে মোটামুটি সপ্তাহে দু’দিন কোনোপ্রকার তরল ব্যতীত বেঁচে থাকতে পারেন। আবহাওয়া এবং তার সাথে ব্যক্তির শারীরিক ক্রিয়াকলাপের মাত্রার উপর নির্ভর করে কতক্ষণ তিনি পানি পান করা ছাড়া টিকে থাকতে পারবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত মায়ো ক্লিনিকের ভাষ্যমতে,
“শিশু, বৃদ্ধ, দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এবং যারা বেশিরভাগ সময় কাজে বাইরে থাকেন, তাদের মধ্যে ডিহাইড্রেশন হওয়ার (পানিশূন্যতা) ঝুঁকি রয়েছে।”
ওয়াশিংটন ডি সি-তে অবস্থিত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলোজিস্ট র্যান্ডাল প্যাকারের মতে,
“মাত্রাতিরিক্ত উত্তপ্ত পরিবেশে একজন বয়স্ক ব্যাক্তির দেহ থেকে ঘণ্টায় ১ থেকে ১.৫ লিটার [২.১-৩.২ পিন্টস] ঘাম নির্গত হয় এবং কোনো শিশুকে উত্তপ্ত গাড়িতে রেখে দিলে কিংবা একজন অ্যাথলেট যদি রৌদ্রোত্তপ্ত পরিবেশে কঠোর অনুশীলন করে, তবে এদের দেহ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই অতি মাত্রায় উত্তপ্ত এবং পানিশূন্য হয়ে মারা যেতে পারে।”
সাধারণত দেখা যায়, যখন কোনো ব্যাক্তি অতিমাত্রায় তপ্ত আবহাওয়ায় পানিশূন্য হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, এর প্রকৃত অর্থ হলো ব্যক্তির দেহের ভেতরের তাপমাত্রা তখন উচ্চ থাকে।
কিন্তু একটু ভিন্নমত পোষণ করেছেন অ্যারিজোনায় অবস্থিত ব্যানার থান্ডারবার্ড মেডিক্যাল সেন্টারে মেডিসিন বিভাগে কর্মরত ডাক্তার কার্ট ডিকসন। তার বক্তব্য, সবসময় এরূপ পরিস্থিতি হবে এটা ঠিক নয়, এর কিছু ভিন্নতাও রয়েছে নির্দিষ্ট সমষ্টির ব্যক্তিদের মাঝে। যেমন- খুব ছোট বাচ্চা এবং বয়োবৃদ্ধ যারা কি না স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভোগেন, তারা না পারে পানি পান করার সময়টি স্মরণ রাখতে কিংবা না পারে কারো সাহায্য ছাড়া পানি পান করতে।
সুতরাং, একজন ব্যক্তির দেহ থেকে কী পরিমাণ পানি নিঃসরণ হলে ডিহাইড্রেশান শুরু হবে? এর যথার্থ জবাব এসেছে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হওয়া এক সরকারি জরিপে, যা কি না পরিচিত ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস গাইডলাইনস ২০০৯’ হিসেবে। সেখানে বলা হয়েছে,
“কোনো ব্যক্তির দেহ থেকে তার মোট ওজনের ১০% পানি নিঃসরিত হলে মারাত্মক ডিহাইড্রেশনের আশংকা রয়েছে। যদিও সেই নির্দিষ্ট পরিমাপটি বাস্তবিকভাবে করা অসম্ভব। তবে প্রচলিত অভিমত রয়েছে যে, রৌদ্রোত্তপ্ত আবহাওয়ায় যদি ব্যক্তির দেহ থেকে ১.৫ লিটার পর্যন্ত পানি নিঃসরিত হয়ে যায়, তবে সেক্ষেত্রে তার ডিহাইড্রেশন হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।”
অন্যদিকে দ্য ইউনিভার্সিটি অভ রচেস্টার মেডিক্যাল সেন্টার থেকে বলা হয়েছে,
“ব্যক্তির দেহ থেকে যখন পানির পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রা থেকে কমে আসে, সেই মুহূর্তে আচরণের প্রকৃতিগত কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন- তৃষ্ণার্ত হওয়া, শুষ্ক ত্বক, ক্লান্তিবোধ হওয়া, হালকা মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বিভ্রম হওয়া, শুষ্ক মুখ, দ্রুত নাড়ি এবং শ্বাসপ্রশ্বাস সঞ্চালন হওয়া।
যেসব শিশু পানিশূন্যতায় ভোগে, এরা যখন কান্না করে, তখন এদের চোখ থেকে পানি পড়ে না। এদের চোখ কোটরাগত হয়, গাল এবং পেট প্রায় ভেতরে ঢুকে যায়। এমনকি এদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি স্তিমিত হয়ে থাকে, আর যখন ত্বকে আলতো করে চাপ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন ত্বকের ভাব অসমতল থেকে যায়।”
থান্ডারবার্ড মেডিক্যাল সেন্টারের ডাক্তার কার্ট ডিকসন’ও এক্ষেত্রে লাইভ সায়েন্সকে তার মত দিয়েছেন, জরুরি বিভাগে আগত রোগীদের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন- অবসাদ, ক্লান্তি; যখন দাঁড়াতে যায় তখন প্রচুর ক্লান্তিভাব আচ্ছন্ন করে থাকে, এরূপ সময়ে কদাচিৎ বমিও করতে দেখা যায়। উপরন্তু, এরা এতটাই অসুস্থ থাকে যে, এদের রোগের পেছনে যে ডিহাইড্রেশনই দায়ী, তা শুনেও মুখে আলাদা ভীতির কোনো ছাপ দেখা যায় না।
আরো অন্য যেকোনো কারণেও এসব অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ডিহাইড্রেশনকে নিশ্চিতভাবে দায়ী করাটা ঠিক নয়। আপনি এক্ষেত্রে বাদবাকি কারণগুলোকে একেবারে বাদ দিতে পারেন না। তবে অনেকটা সম্ভাবনা থেকে যায়, যদি উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি নির্মাণশ্রমিক হয় এবং তখন যদি জুলাই মাস বিরাজ করে ফিনিক্সে।
দ্য ন্যাশনাল কিডনী ফাউন্ডেশনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ড. জেফ্রি বার্নস তার মত প্রকাশ করেছেন ২০১৪ সালে প্রকাশিত দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে। তিনি বলেছেন, দেহের অভ্যন্তরে পানির স্বাভাবিক মাত্রা যখন নিচে নেমে যায়, তখন দেহের তরল পদার্থগুলো রক্তের সাথে মিশ্রিত হয়ে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে রক্ষা করে। কারণ দেহের অঙ্গগুলো সর্বত্র তখন কুঞ্চিত হয়ে পড়ে। পানির মাধ্যমে যেমন মস্তিষ্কের কোষগুলো পরিশ্রুত হয়, আবার এর ঘাটতি হলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হারিয়ে রক্তনালীগুলো আক্রান্ত হয়ে মাথার খুলি তার সক্রিয়তা হারাতে পারে।
সর্বপ্রথম অঙ্গ হিসেবে কিডনী তার সক্রিয়তা হারাবে, রক্ত পরিশ্রুতকরণ কার্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে এবং সেই মুহূর্ত থেকে অন্যান্য অঙ্গ থেকে টক্সিক পদার্থ নিঃসরণও স্তিমিত হয়ে পড়বে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বেশ পীড়াদায়ক, কিন্তু এর চিকিৎসা করা সম্ভব বটে। আর, এসব ঝুঁকির মাত্রা নেমে আসবে পানি এবং ইলেক্ট্রলাইটের ভারসাম্যতায়, যা কি না আপনার সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে পরিপূরক ভূমিকা রাখে বলে অভিমত দিয়েছেন ড. বার্নাস।