বিশ্বের প্রাচীন সব পুরাণে পাওয়া যায় শত শত পুরাকথা, হাজারো কিংবদন্তির উপাখ্যান। তবে গ্রীকদের মতো এতটা সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় পুরাকথা সম্ভবত দ্বিতীয়টি নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রিকদের বিভিন্ন দেবতা ও বীরদের গল্পগাঁথা নিয়ে স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ এই পুরাণ! ট্রয় নগরীর গল্প, অলিম্পাসের গল্প, কিউপিড ভেনাসের গল্পসহ হাজারো সব গল্প হয়তো আমাদের সকলের জানা। তবে আজ আমরা জানবো এক মানবপ্রেমী দেবতার গল্প, যিনি কি না মানুষের কল্যাণ কামনার জন্যে দেবরাজের ক্রোধানলে পতিত হতেও দ্বিতীয়বারের জন্যে চিন্তা করেননি। আজকের আয়োজন সেই দেবতা প্রমিথিউসকে নিয়ে।
সাধারণত প্রচলিত যে কোনো ধর্মে বা মিথলজিতে দেবতাদেরকেই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সৃষ্টির একমাত্র আদি সত্তা হিসেবে দেব-দেবীরাই চিরস্বীকৃত। কিন্তু গ্রীক মিথলজিতে এই দেবতাদের (অলিম্পিয়ানদের) আগেও আরো এক ধরনের সত্তা ছিলো বলে বিশ্বাস করা হয়ে, যাদের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন দেবতারা। এদের বলা হয়ে থাকে টাইটান। প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করতেন, এই টাইটানরাই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে। এই টাইটানদেরই একজন ছিলেন ক্রনোস। ক্রনোসের সন্তান ছিল জিউস, পসাইডন ও হেডিস। দেবতারা অলিম্পাস পর্বতে থাকতেন বিধায় তাদের ‘অলিম্পিয়ান’ নামে ডাকা হতো। দেবরাজ জিউস এবং অন্যান্য অলিম্পিয়ানদের সাথে হেরে যাবার আগপর্যন্ত টাইটানরা এই মহাবিশ্ব শাসন করত। ক্রোনাসের ভাইয়ের ছেলের নাম ছিল প্রমিথিউস। প্রমিথিউস ছিলেন এমনই একজন টাইটান।
পুরাণে বর্ণিত আছে, টাইটান আর অলিম্পিয়ানদের মধ্যে ভয়াবহ এক যুদ্ধ হয়েছিলো। সেই যুদ্ধকে Titanomachy বা গ্রেট কসমোলজিক্যাল যুদ্ধ বলে। সেই যুদ্ধে একজন টাইটান হওয়া সত্ত্বেও প্রমিথিউস অলিম্পিয়ানদের পক্ষ নেন। যুদ্ধে টাইটানরা হেরে গিয়েছিলো, জয়ী হয়েছিলো অলিম্পিয়ানরা। যুদ্ধের পর অনেক টাইটানকে নিশ্চিহ্ন করা হলো, কিছু টাইটানকে ছুঁড়ে ফেলা হলো টারটারাস নরকের চিরন্তন অগ্নিকুণ্ডের ভেতরে। যুদ্ধকালে প্রমিথিউস ও তার ভাই এপিমিথিউসের কর্মকান্ডে খুশি হয়ে দেবতাদের রাজা জিউস দুই ভাইকে পুরস্কার দিলেন। জিউসের ক্ষমতাবলে প্রমিথিউস ও এপিমিথিইউসের হাতে পৃথিবীর সব প্রাণী সৃষ্টির দায়িত্ব দেয়া হলো।
এই দুই টাইটানের এমন নামের পেছনে অবশ্য একটি বিশেষ কারণ ছিলো। প্রমিথিউস আগে ভাবতেন, পরে কাজ করতেন- তাই নামের আগে ‘প্রো’ বা ‘আগে’ শব্দটি যুক্ত ছিল। অপরদিকে, স্বভাব-চরিত্রে এপিমিথিউস ছিলেন তার ভাইয়ের একদম উল্টো! এপিমিথিউস হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে আগেভাগে কাজ করে ফেলতেন, পরে ভাবতেন- তাই নামের মধ্যে আছে ‘এপি’ বা ‘পরে’। বোঝাই যাচ্ছে, সিদ্ধান্তগত জায়গা থেকে এপিমিথিউসের চেয়ে প্রমিথিউস এগিয়ে আছেন।
পৃথিবীতে এসে প্রমিথিউস ও তার ভাই বিভিন্ন স্থানের মাটি দিয়ে বিভিন্ন প্রাণী বানানো শুরু করেন। আগেই বলা হয়েছে, প্রমিথিউস আগে ভাবতেন, পরে কাজ করতেন। তাই তিনি এপিমিথিউসের মতো সাধারণ পশুপাখি না বানিয়ে আরো বড় পরিকল্পনা করতে লাগলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাটি দিয়ে এবং স্বচ্ছ পানিতে সেই মাটি গলিয়ে নতুন এক প্রাণী বানাতে শুরু করলেন এবং তাদেরকে দেবতাদের আকৃতি দিলেন। প্রমিথিউস নতুন সৃষ্টির নাম দিলেন মানুষ। মানুষ বানানো হয়ে গেলে প্রমিথিউস গেলেন অলিম্পাসে। জ্ঞানের দেবী এথেনাকে অনুরোধ করলো তার নতুন সৃষ্টিতে প্রাণদান করার জন্য। প্রমিথিউসের অনুরোধে মর্ত্যে আসলেন দেবী এথেনা। এসে নির্জীব মানবদেহে ফুঁ দিয়ে তাতে প্রাণসঞ্চার করলেন। এভাবেই মানবসভ্যতার সৃষ্টি হলো।
দেবতার আকৃতিতে এই নতুন সৃষ্টিকে ভালভাবে নিতে পারেননি জিউস। কিন্তু প্রমিথিউসকে তার কাজে বাধাও দিলেন না। মানুষ তৈরির পর জিউস এবার প্রমিথিউসকে বললেন, এই সৃষ্টিরা দেবতাদের আরাধনা করবে এবং সৃষ্টির জীবদের মাঝে এরাই হবে সবচেয়ে উন্নত। তবে একটি শর্ত দিয়ে দেয়া হলো। তা হচ্ছে, মানুষ নিজেরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এমন প্রাণীদের বিভিন্ন দেবতার নামে উৎসর্গ করতে হবে এবং উৎসর্গের পর অবশিষ্টাংশটুকু শুধুমাত্র মানুষের জন্য থাকবে। মূলত এই শর্ত দিয়ে জিউস দেবতাদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন।
দেবতাদের কতটুকু উৎসর্গ করতে হবে এবং কতটুকু মানুষের ভাগে থাকবে তা নির্ধারণ করার জন্য মিসোন নামক স্থানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন প্রমিথিউস। এই অনুষ্ঠানটি গ্রিক মিথলজির অনন্য একটি ঘটনা। এটি ট্রিক এট মিসোন (Trick at Mecone) নামে পরিচিত। প্রমিথিউস মানবজাতির স্রষ্টা হিসেবে চেয়েছিল মানুষদের অধিকারটুকু যেভাবেই হোক বজায় রাখতে। তাই তিনি এক কূটকৌশলের আশ্রয় নিলেন। উৎসর্গ হিসেবে নিয়ে আসা জীর্ণ একটি গাভীর পাকস্থলীর ভেতর ষাঁড়ের উৎকৃষ্ট মাংস রেখে গাভীটিকে বিচ্ছিরিভাবে ময়লা করে, অনুৎকৃষ্ট প্রাণীদেহের অংশ দিয়ে ঢেকে রাখলেন, যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায়। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রাণীর হাড়গোড় ও চর্বি একত্রিত করে তাদের সুন্দর চামড়া দিয়ে ঢেকে খুব আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে রাখলেন প্রমিথিউস।
যথাসময়ে জিউস উৎসর্গ গ্রহণ করতে আসলেন। প্রমিথিউস তখন তাকে বলেন যেকোনো একটি বেছে নিতে। প্রমিথিউসের ধোঁকায় পড়ে জিউস চকচকে দেখতে হাড়গোড়কেই বেছে নেন। তখন থেকে এটাই নিয়ম হয় যে, মানুষ প্রাণী উৎসর্গের পর মাংস রেখে দিয়ে চর্বি ও হাড়গোড় আগুনে পুড়িয়ে দেবতাদের উৎসর্গ করবে!
প্রমিথিউসের চালাকি বুঝতে পেরে জিউস প্রচণ্ড ক্ষেপে যান এবং মানবজাতি যাতে দেবতার কিছু উৎসর্গ করতে না পারে সেজন্য জিউস পৃথিবী থেকে সব আগুন তুলে নিয়ে যান। মানবজাতির স্রষ্টা প্রমিথিউস এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন! কারণ আগুন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে না, উৎসর্গ তো দূরে থাকুক। প্রমিথিউস সিদ্ধান্ত নেন, তিনি হেফেস্টাসের কর্মশালা থেকে আগুন চুরি করবেন। তাই তিনি অলিম্পাস পাহাড়ের চূড়ায় উঠে হেফেস্টাস ও এথেনার কারখানা থেকে আগুন চুরি করে আনলেন। তিনি একটি ফাঁপা খোলকের মধ্যে আগুনের শিখাকে লুকিয়ে নিয়ে নিরাপদে লোকালয়ের মানুষের কাছে এসে মানবজাতিকে পুনরায় আগুন সরবরাহ করলেন। এই আগুন মানুষকে দিলো শক্তি। আগুন পাওয়ার পর মানুষ নিজেদের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করা শিখলো, প্রচণ্ড শীতে নিজেদের উষ্ণ করার উপায় খুঁজে পেলো। আবার আগুনের সাহায্যে বিভিন্ন রকম ধাতু দিয়ে তৈরি করল নানা অস্ত্রশস্ত্র। প্রমিথিউসের আগুন পেয়ে মানব সভ্যতার খুব দ্রুত বিকাশ ঘটলো।
জিউস অলিম্পাস পর্বত থেকে মানুষের এ অগ্রযাত্রা প্রত্যক্ষ করলেন। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না এসবের পেছনে কার হাত রয়েছে! আরেকবার দেবতাদের ধোঁকা দেয়ার দায়ে অভিযুক্ত হলেন প্রমিথিউস। তবে এবারে জিউসের রাগটা গিয়ে পড়লো শুধুই প্রমিথিউসের উপর। প্রচণ্ড ক্রোধের বশে জিউস প্রমিথিউসকে দিলেন ভয়ানক এক শাস্তি। তাকে ককেশাসের এক খাড়া পর্বতগাত্রে অনন্তকালের জন্য শৃঙ্খলিত করে রাখার নির্দেশ দেয়া হলো। প্রতিদিন সকালে শেকলবদ্ধ প্রমিথিউসের কাছে একটি ঈগল আসত। ঈগলটি প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে ঠুকরে খেত সারাদিন। রাতে আবার প্রমিথিউসের শরীরে নতুন কলিজা প্রতিস্থাপন করা হতো, পরদিন ঈগলটি যাতে আবার এসে খেতে পারে।
এভাবেই চলছিলো প্রমিথিউসের জীবন। উপকথায় বর্ণিত, অনেক অনেক বছর পর হারকিউলিস ককেশাসের সেই পাহাড়ি রাস্তা ধরে যাচ্ছিলো। যাবার পথে সে প্রমিথিউসকে দেখতে পায়। সে জানতো না যে, প্রমিথিউস এখনও বন্দী অবস্থায় বেঁচে আছে। প্রমিথিউসকে দেখতে পেয়ে সে শেকল ভেঙে এবং কলজেখেকো ঈগলকে মেরে প্রমিথিউসকে উদ্ধার করে। শেষ হয় প্রমিথিউসের দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির!
গ্রিক মিথলজিতে বর্ণিত এই টাইটানকে ইতিহাসের অনেকেই দেবতার মর্যাদায় দেখে থাকেন। বিভিন্ন গ্রিক লেখনীতেও প্রমিথিউসকে মহান হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রমিথিউসের মাহাত্ম্য ও ত্যাগের উদাহরণ বিভিন্ন কাব্যে উল্লেখ করা হয়েছে বারবার। বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলী প্রমিথিউসের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘মুক্ত প্রমিথিউস’ নামে একটি গীতিনাট্য লিখেছিলেন। সেখানে তিনি প্রমিথিউসকে একজন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে কল্পনা করেন। যে শৃঙ্খল ভেঙে মানুষের মাঝে আবার মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে। দেবতাদের অনাচার ও প্রতিপত্তির বিপরীতে মানবপ্রেমী হিসেবে প্রমিথিউস গ্রিক পুরাণে সবসময়ই এক অনবদ্য চরিত্র!