উনিশশো একাত্তর সাল চলছে তখন, আমাদের গৌরবময় একাত্তর সাল।
মিরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র দেলোয়ার হোসেন মিথু ততদিনে বিশ বছরে পা রেখেছে। মার্চ মাসে এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেলো তার। স্বপ্ন ভালো একটা ফলাফলের।
তবে মেধাবী শিক্ষার্থী মিথু কেবল পড়াশোনা নিয়েই পড়ে থাকতো না, তার দখল ছিল রাজনীতির নানা বিষয়াদির উপরও। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার তুমুল বিবাদপূর্ণ, উত্তেজনাময় সেই দিনগুলোতে এই তরুণও বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিত স্বতঃস্ফূর্তভাবে, স্বপ্ন দেখতো স্বাধীন-সার্বভৌম এক বাংলাদেশের। আর, এসব কর্মকাণ্ডের ফলেই স্থানীয় বিহারীদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিল সে। বাঙালিদের কোনোভাবেই সহ্য করতে না পারা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর আশির্বাদপুষ্ট বিহারীরা তাই তক্কে তক্কে ছিল কীভাবে এই আগুনকে যত দ্রুত সম্ভব নিভিয়ে ফেলা যায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে উজ্জীবিত মিথু তার মাকে মাঝে মাঝেই বলতো, “সংগ্রাম আর প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে।” একবার তো উর্দু ভাষায় লেখা বিহারীদের একটা সাইনবোর্ড ভেঙে দিয়ে সে তাদের আক্রমণের শিকারও হয়েছিল। বিহারীরা সেদিন কোপ দিয়েছিল তার পায়ে।
তবুও দমে যায়নি মিথু। বরং আরও সাহস নিয়েই মাকে সে বলেছিল, “ভয় পেও না, পাকিস্তানীরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না।” দেশের তরে প্রাণ উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত ছিল সে। এ উদ্দেশ্যে অংশ নিত বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডে। এহেন তেজী তরুণের প্রতি তাই পশ্চিম পাকিস্তানীদের দোসর বিহারীদের ক্ষোভও দিন দিন বেড়েই চলেছিল।
এরই মাঝে চলে এলো ২৫ মার্চের ভয়াবহ সেই কালরাত। পৃথিবীর বুকে উচ্চারিত হলো বাংলাদেশ নামক আরেকটি দেশের স্বাধীনতার দৃপ্ত ঘোষণা। দেশজুড়ে চলা অশান্ত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে পরদিন সকাল থেকে মিরপুরেও শুরু হয়ে গেল নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড ও লুন্ঠনের মহাযজ্ঞ। মিরপুরে এসবের নেতৃত্বে ছিল বিহারীরাই।
২৬ মার্চ সকালের কথা, যে দিনটিকে আজ আমরা মহা সমারোহে ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে উদযাপন করি, সেদিন সকালেই মিথুদের বাড়িতে হানা দিল একদল বিহারী। টেনেহিঁচড়ে ওকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায় তারা। সাহায্যের আশায় “মা, আমাকে বাঁচাও” বলে চিৎকার করে উঠেছিল মিথু। কিন্তু অসহায় মা সেদিন ঐ মানবপশুদের হাত থেকে তার সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি। তার সামনে দিয়েই মারতে মারতে মিথুকে নিয়ে যায় বিহারীরা। পরে জানা যায়, বিহারীরা জবাই করে হত্যা করেছিল মিথুকে। আর, হতভাগা মিথুর লাশটা পরে ফেলে দিয়েছিল ড্রেনে।
একসময় এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। না, মিথু চিরতরে পরপারে পাড়ি জমালেও তার স্বপ্ন ঠিকই বাস্তব রুপ লাভ করেছিল। প্রথম বিভাগে পাস করেছিল সে। ব্যক্তিগত স্বপ্নের বাইরে দেশবাসীকে নিয়ে যে স্বপ্ন শহীদ মিথু দেখেছিল, সেটাও ন’মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাস্তবায়িত হয়েছিল।
কিন্তু, যে স্বপ্ন নিয়ে মিথুরা এ দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেবার শপথ নিয়েছিল, সেই দেশই কি হতে পেরেছে আজকের এই বাংলাদেশ?
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে পড়ে নিতে পারেন এই বইটি: