ধরুন আপনার আদরের পোষা প্রাণীটি মারা গেল। মৃত্যু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম হলেও মন মানতে নারাজ। ভাবলেন কোনো উপায় কি নেই যার সাহায্যে প্রাণীটিকে সারাজীবন চোখের সামনে রেখে দেওয়া সম্ভব? আছে, এর নাম ট্যাক্সিডার্মি। মৃত প্রাণীর শরীরকে (প্রধাণত চামড়াকে) কেমিক্যাল ও ট্যানিংয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রক্রিয়া ও তাকে জীবন্তের ন্যায় দেখানোর উপায়কেই বলা হয় ট্যাক্সিডার্মি।
সাধারণত গবেষণা বা পাঠদানের উদ্দেশ্যে এটা করা হয়ে থাকে। ট্যাক্সিডার্মি শব্দের উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘ট্যাক্সি’ ও ‘ডার্মা’ থেকে। ট্যাক্সি মানে সংরক্ষণ আর ডার্মা মানে চামড়া। তাহলে ট্যাক্সিডার্মির মানে দাঁড়ায় চামড়ার সংরক্ষণ। স্তন্যপয়ী, পাখি, মাছ, সরিসৃপ সহ অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর উপর ট্যাক্সিডার্মি প্রয়োগ করা হয়। এদের পাশাপাশি বড় আকৃ্তির কীট-পতঙ্গের উপরও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
জাদুঘরগুলোতে ট্যাক্সিডার্মিকৃত প্রাণীগুলো মূলত বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তথ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত। তবে আজকাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোষা প্রাণীর স্মৃতি সংরক্ষণেও ব্যবহৃত হয় এ প্রক্রিয়া।
উৎপত্তি
সর্বপ্রথম ১৭৪৮ সালে ফ্রান্সের রিয়াউমুর পাখির দেহ সংরক্ষণের মাধ্যমে ট্যাক্সিডার্মির আবির্ভাব ঘটান। এরপর ১৯৫২ সালে এম. বি. স্টলাস ট্যাক্সিডার্মির আরো কিছু পদ্ধতি আবিস্কার করেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে ফ্রান্স, জার্মানি, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ডসহ আরো কয়েকটি দেশের অগ্রদূতদের আবির্ভাব ঘটে। ঊনিশ শতকের শুরুতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রায় সব শহরেই চামড়ার ব্যাবসা শুরু হয়। সে সময় শিকারীরা তাদের শিকার করা পশুপাখি গৃহসজ্জাসামগ্রীর দোকানগুলোতে দিয়ে আসতো। তারা সেগুলো চামড়া ছাড়িয়ে ভিতরে খড় ও তুলা দিয়ে ভরে সেলাই করতো।পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে এতে বিভিন্ন কেমিক্যালের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।
চর্মসংস্কার ও প্রাণীদেহ প্রস্তুতি
ট্যাক্সিডার্মিস্টরা বর্তমানে গড়ে বছরে ৬০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছেন। ট্যাক্সিডার্মির প্রক্রিয়াগুলো যুগের সাথে সাথে আরো উন্নত ও আধুনিক হচ্ছে। শুরুতে মৃত পশুর চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। এরপর চামড়ার মানের উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয়। চামড়া ও লোমকে পোকামাকড় থেকে সুরক্ষিত রাখতে বোরাক্স পাউডার অথবা সোডিয়াম বোরাট ব্যবহৃত হয়।
পরবর্তীতে এটিকে কাঠ অথবা তার এর সাহায্য ম্যানিকুইন বানিয়ে রাখা হয়। এই ম্যানিকুইনকে বলা হয় Voodoo doll। চোখের আকৃ্তির জন্য সাধারণত চীনামাটি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ছোট আকৃতির প্রাণীর ট্যাক্সিডার্মি তৈরিতে ৩-৫ ঘণ্টা সময় লাগে। তুলনামূলক বড় আকৃতির প্রাণীর ক্ষেত্রে ৫-৭ দিন সময় লেগে যায়। ট্যাক্সিডার্মিস্টরা দক্ষতা ও অভিনবত্বের মাধ্যমে তাদের কাজকে আরো সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।
ট্যাক্সিডার্মির অতীত ও বর্তমান
ট্যাক্সিডার্মির স্বর্ণযুগ বলা হয় ভিক্টোরিয়ান যুগকে। তখন এমন জীবন্তের ন্যায় দেখানো প্রাণীগুলোকে অন্দরমহলের শোপিস হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যেত। পরবর্তীতে অবশ্য এসব ট্যাক্সিডার্মিগুলোকে অন্দরমহলে ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয় এবং শুধুমাত্র গবেষণার কাজেই ব্যবহার করা হতো। ইংরেজি পক্ষীবিজ্ঞানী জন হ্যানককে আধুনিক ট্যাক্সিডার্মির জনক বলা হয়। তিনি নিজে পাখি শিকার করতেন এবং পরবর্তীতে সেগুলোকে কাদামাটি ও প্লাস্টারের সাহায্য আকৃতি দিতেন। তিনি ১৮৫১ সালে লন্ডনে এক এক্সিবিশনের আয়োজন করেন যেখানে নিজের হাতে তৈরি ট্যাক্সিডার্মি পাখি প্রদর্শিত করেন। স্বয়ং রানি ভিক্টোরিয়া সেগুলো দেখে অভিভূত হয়েছিলেন।
বর্তমানে ট্যাক্সিডার্মির জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন দেশের তরুণেরা ট্যাক্সিডার্মিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে। ট্যাক্সিডার্মিস্ট হতে গেলে আলাদা করে কোনো ডিগ্রী লাগে না তবে কিছু নিদিষ্ট ডিপ্লোমা ও কোর্স করতে হয়। এছাড়া যে স্টেট বা শহরে কাজ করতে আগ্রহী সেখানকার লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক। মোটকথা ট্যাক্সিডার্মি হলো আর্ট ও বিজ্ঞানের এক অনন্য সংমিশ্রণ যা বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীকুলের পরিচিতি ও তথ্য সম্পর্কে জানতে সাহায্য করছে।