গণমাধ্যম একটি বিশাল শক্তির নাম। এই শক্তি সম্পর্কে জানা নেই, এমন মানুষ নেই বললেই চলে। গণমাধ্যমই একমাত্র শক্তি যা পারে সত্যকে মিথ্যা করে দিতে, আবার মিথ্যাকে অনায়াসে সত্যের রূপ দিয়ে জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে। এটি এমনই এক শক্তি যা যেকোনো আন্দোলনকে এক নতুন বেগে ত্বরান্বিত করতে অথবা কোনো ত্বরান্বিত শক্তিকে নিমিষেই পিষে ফেলতে ফেলার ক্ষমতা রাখে। তাই যেকোনো বিপ্লবে গণমাধ্যমের একটি বিশেষ কার্যকারিতা থেকেই যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও গণমাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তবে তা কতটা গুরুত্ব বহন করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তা জানা যাবে এই আলোচনা থেকে।
রেডিও ও আন্তর্জাতিক পত্রিকা
১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু একচ্ছত্র রায় পাওয়ায় পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে, ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আওয়ামী লিগ সরকার গঠন করবে এবং সংসদ অধিবেশনে বসবে। কিন্তু শেষমুহুর্তে বাতিল করা হয় এই অধিবেশন; যার ফলে বাঙ্গালীর মনে দানা বাঁধে একটা বিশাল বিপদের শঙ্কা। তারা আগে থেকেই আঁচ করতে পারে মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাবনা।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের এই হুঁশিয়ারি মেনে নেননি, বরং তিনি বলেন,
গণরায়ে আমরা আসন পেয়েছি, তাই আমাকে অতিসত্বর সংসদ অধিবেশনে বসতে দেওয়া হোক, সেই সাথে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা আওয়ামী লিগের হাতে হস্তান্তর করা হোক। কেননা এমনটাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার।
কিন্তু পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান মেনে নেয়নি। তাই তিনি সকল বিরোধীদলীয় নেতাকে ডাক দেন, সংলাপের আয়োজন করেন এবং সকল অফিস-আদালত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট কার্যদিবস ও সময় নির্ধারণ করে দেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর নির্ধারিত কার্যদিবসেই চলছিল সকল প্রতিষ্ঠান। এভাবেই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন জাতির পিতা। কেননা, শুধু সংসদ অধিবেশন নিয়েই নয়, বরং ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বিভিন্নভাবে নিপীড়ন করে চলেছিল বাঙালীকে। এত অন্যায় আর মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি তার পক্ষে।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালীকে আহ্বান করেন, “যার কাছে যা আছে, তা নিয়ে নেমে পড়ো” এবং তিনি এটাও বলেন, “আমাদের দাবী না মানা পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন বহাল থাকবে।” কিন্তু এসব আন্দোলনের ডাক পুরো দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল কীভাবে! হ্যাঁ, আমরা অনেকেই জানি, ঢাকা বেতার থেকে প্রচার করা হয়েছিল এই মুক্তির ডাক, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। কিন্তু এর পেছনের ঘটনা কি আমরা জানি?
সাধারণত ঢাকা বেতার কেন্দ্র (বর্তমানে বাংলাদেশ বেতার) থেকে যেকোনো প্রচারণা করা হত সেই সময়, কিন্তু তা সরাসরি দেশবাসীর নিকট পৌঁছাত না। তাহলে কীভাবে পৌঁছেছিল ৭ মার্চের ভাষণ?
সেই সময় রেডিওর প্রচলন থাকলেও খুব একটা প্রচলন ছিল না। শুধু গ্রামে তো নয়ই, এমনকি মফস্বলেরও সব ঘরে ছিল না রেডিও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অফিস-আদালতেই দেখা যেত রেডিও। তাহলে দেশবাসী কীভাবে রেডিওর মাধ্যমে খবর পেলেন!
তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর যেকোনো কর্মসূচী বা ভাষণ প্রথমে প্রচারিত হত রেডিওতে। পরে বিশ্ব গণমাধ্যম তথা আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকার সাহায্যে তা পৌঁছে যেত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে। তবে ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত ভাষণ ঢাকা বেতার থেকে সম্প্রচার করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাকে। পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে এই ভাষণ প্রচার করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না। পরবর্তীতে আওয়ামী লিগ সমর্থকদের চাপের মুখে ঢাকা বেতার এই ভাষণ প্রচার করতে বাধ্য হয়।
ডেইলি টেলিগ্রাফ
২৫ মার্চ রাতে এ দেশের অধিবাসীদের উপর কাপুরুষের মতো হামলা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই সময় তারা বঙ্গবন্ধুকেও ধরে নিয়ে যায় এবং কারাবন্দী করে। যেহেতু তিনি ওয়ালী খানের মাধ্যমে গোপনে খবর পেয়েছিলেন পাকবাহিনীরা তাকে ধরে নিয়ে যেতে আসছে, তাই যাওয়ার আগে একটি ঘোষণাপত্র লিখে রেখে যান যা সেই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে জিয়াউর রহমান পাঠ করেন। এই ভাষণটি চট্টগ্রাম বেতার থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
কিন্তু এরপর পাকবাহিনী যেন সবটাই নিজেদের হাতে তুলে নেয়। বাঙালিকে পঙ্গু করে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, নজর রাখে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের উপর। তবুও পারেনি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে ২৫ মার্চে তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তথ্য গোপন করতে।
দুই ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ও ফটোসাংবাদিক মাইকেল লরেন্ট তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে একটি প্রতিবেদন পাঠান; যার শিরোনাম ছিল ‘ট্যাঙ্কস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’।
২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট চলাকালে পাকবাহিনী বিদেশি সাংবাদিকদের (প্রায় ২০০ জন) একত্র করেন এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাখেন, যা বর্তমানে রূপসী বাংলা নামে পরিচিত। সবাইকে একত্র করার পর বন্দুকের মুখে রেখে তাদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার বাইরে, যেন তারা এই গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করতে না পারেন এবং বিশ্ব গণমাধ্যমে কোনো তথ্যও প্রচার করতে না পারেন।
কিন্তু সাইমন ড্রিং ও মাইকেল লরেন্ট হোটেলের কর্মীদের সহায়তায় লবি, রান্নাঘর ও ছাদে লুকিয়ে থেকে পাকবাহিনীর চোখে ধুলো দিতে সক্ষম হন। ২৭ তারিখে কারফিউ উঠে গেলে তারা হোটেল থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নৃশংস গণহত্যার তথ্য-চিত্র ধারণ করেন। ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে তারা একটি প্রতিবেদন পাঠান।
জয়বাংলা
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা আসলে জয়বাংলার কথা মোটেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। এই পত্রিকাটি যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরম বন্ধু হয়ে ছিল আমাদের সাথে। এবং এটিই ছিল সেসময়ের একমাত্র স্বাধীন পত্রিকা। কেননা দৈনিক সংবাদ ও ইত্তেফাকের মতো বড় বড় পত্রিকার অফিস তারা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবুও দমানো যায়নি বাঙালিকে। প্রতিটি জেলা থেকে প্রকাশিত হত পত্রিকা, যেগুলো জয়বাংলা পত্রিকার তথ্যগুলো পৌঁছে দিত বাংলার জনগণের কাছে।
জয়বাংলার সম্পাদক ছিলেন আহমদ রফিক এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলের মতিন আহমদ চৌধুরী। পত্রিকাটির অফিস ছিলো মুজিবনগরে। ৩১ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পত্রিকাটি মোট ২২টি প্রতিবেদন বের করে। পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে গাজীউল হক কলকাতায় ফেরি করে বিক্রি করতেন জয়বাংলা।
সানডে টাইমস
সাইমন ড্রিংয়ের প্রতিবেদনে পাকবাহিনী আরও বেশি সতর্ক হয়ে যায়। এবং কয়েকজন আন্তর্জাতিক সাংবাদিককে অনুমতি দেয় মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রচার করতে, কিন্তু দেয় শর্ত- তাদের তত্ত্বাবধানে লেখা হবে সকল প্রতিবেদন। এবং তা-ই হচ্ছিল। ফলে বিশ্ব গণমাধ্যম মাসের পর মাস তাদের অরাজকতার ব্যাপার অজ্ঞই থেকে যাচ্ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের এই অনৈতিকতা ও নৃশংসতা সহ্য করতে না পেরে সাহস দেখান অ্যান্থনি মাসকারেনহাস।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস এই নির্মমতা দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে, কিন্তু পাকবাহিনীর কড়া নজরদারি এড়িয়ে কীভাবে সাহায্য করবেন সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বুদ্ধি আটলেন তিনি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে বললেন, তার বোন খুব অসুস্থ এবং তিনি তাকে দেখতে যেতে চান। অনুমতি পেয়ে অ্যান্থনি সরাসরি লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার হেড অফিসে যান এবং তাদেরকে পাকবাহিনীর গণহত্যা নিয়ে তার লেখা একটি প্রতিবেদন প্রচারের অনুরোধ করেন।
মাসকারেনহাস জানতেন, এই প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে বর্বর পাকবাহিনী তার পরিবারকে ছাড়বে না, মেরে ফেলবে সবাইকে। তাই তিনি সানডে টাইমসের কাছে আরও একটি অনুরোধ করেন, এই প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে যেন তার পরিবারকে লন্ডনে নিয়ে আসা হয়। সানডে টাইমস তার শর্ত মেনে ১৩ জুন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে; যার শিরোনাম ছিল ‘জেনোসাইড’ অর্থাৎ গণহত্যা।
পাক হানাদার বাহিনী এত মাস বিশ্বের চোখ আড়াল করে যে নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছিল তা নিমিষেই আত্মপ্রকাশ করে ‘জেনোসাইড’-এর মাধ্যমে। মাসকারেনহাসের এই প্রতিবেদন বিশ্ববাসীর টনক নড়ায় এবং অনেক দেশ বাংলাদেশের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে। এই প্রতিবেদন পড়েই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেননি। এবং এই কারণেই এই মানবতাবাদী সাংবাদিককে পাকিস্তানীরা আখ্যায়িত করে ‘রাজাকার’ হিসেবে। কিন্তু তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই, কারণ তিনি সত্য প্রচার করেছেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।
তারকা
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তারকাদের ভূমিকাও কিন্তু কম নয়। নিউ ইয়র্কে ম্যাডিসন স্কয়ারে গায়ক জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান এবং কবি পণ্ডিত রবিশঙ্কর একটি কনসার্টের আয়োজন করেন- ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের জন্য অর্থ যোগাড় করা ও এদেশের পক্ষে জনমত গঠন করাই ছিলো কনসার্টটির উদ্দেশ্য।
৭০ বছর বয়সী ফরাসি দার্শনিক আন্দ্রে মালরো মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার ঘোষণা দেন যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে এক বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
এছাড়াও কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি প্রভৃতি দেশের সাংবাদিকরা বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাদের মধ্যে মার্টিন অ্যাডনি (যার তিনটি প্রতিবেদন ২৬ মার্চে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ছাপা হয়), ফরাসি সাংবাদিক বার্নার্ড হেনরি লেভি, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সিডনি শ্যানবাগ, ইতালির সাংবাদিক ওরিয়ানাফেলাচি প্রমুখ সাংবাদিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিবাচক প্রচারণায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।