‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ দিয়ে এসেই বাজিমাত করেছিলেন। সবার প্রশংসার সঙ্গে দুর্দান্ত ব্যবসাও করেছিল সেটি। পরের ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এ মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখতেও সময় লাগেনি। ‘মেঘনাদবধ রহস্য’ নিয়ে তিন বছর পর, ২০১৭ সালে, আবার টালিউডে ফেরেন কলকাতার গুণী পরিচালক অনীক দত্ত। সিনেমার নামে ‘রহস্য’ শব্দের মায়াজাল প্রথম দর্শনে একে থ্রিলার বলেই মনে করায়; ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ এর ‘কাব্য’ কেটে দিয়ে ‘রহস্য’ লেখা পোস্টার বা ট্রেইলার দেখলে আরো দৃঢ় হয় সেই ভাবনা।
টালিউডের বাজারে এমনিতেই থ্রিলারের রমরমা- একের পর এক হিট থ্রিলার বানাচ্ছেন পরিচালকেরা, বেরোচ্ছে তাদের সিকুয়েল। এরই মধ্যে বাধাধরা ছকে দর্শক বোকা বনবেন না- এই ভরসার নিপাট কারণ স্বয়ং পরিচালক। ভরসার পালে হাওয়া লাগায় মুক্তির আগে এই ছবিকে ঘিরে জড়ানো বিতর্কও; ছবিটিকে যে আলোর মুখ দেখতে হয়েছে এর নাম, ‘রামরাজ্য’, ‘বনধ’ ইত্যাদি শব্দের সংলাপ নিয়ে সেন্সর বোর্ডের আপত্তি সংক্রান্ত বচসার পর!
ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র, ‘সময়ের অ্যাসিমভ’ খ্যাত অসীমাভ বসু, একজন প্রখ্যাত প্রবাসী কল্পবিজ্ঞান-লেখক। তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ইন্দ্রাণী বিখ্যাত অভিনেত্রী। উদ্দাম নিও—লিবারেল জীবনে অভ্যস্ত অসীমাভের প্রথম পক্ষের ছেলে ঋক, ইন্দ্রাণীর প্রথম পক্ষের মেয়ে গুলি আর অসীমাভের সহকারী এলিনা। আছেন অসীমাভের এক আশ্রিত ভাগ্নে ধীমান। ইন্দ্রাণীর বিশেষ বন্ধু এবং পরিচালক কুণাল সেন। মূলত এদেরকে নিয়েই ছবির গল্প। এদের প্রত্যেকেরই অসীমাভের সাথে রয়েছে স্বার্থের সম্পর্ক অথবা সংঘাত।
ছবির প্রথম দৃশ্যে কলকাতায় কিছুদিনের জন্য বেড়াতে আসা অসীমাভকে দেখা যায় নিজের বইয়ের বঙ্গানুবাদ-প্রকাশ অনুষ্ঠানে। নিরিবিলিতে কাটাতে আসা সময়ে তার জীবনের নতুন মোড় ঘোরায় জন্মদিনে তার একটি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বই প্রাপ্তি, এবং তাতে চিহ্নিত একটি বিশেষ লাইন- “মারি অরি, পারি যে কৌশলে।“
কে বা কারা লন্ডনে থাকাকালেও তাকে এই বইটি পাঠায়, এবং সেখানেও একই লাইন। এমতাবস্থায় একদিন রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ হন অসীমাভ বসু। কিডন্যাপ, খুন না অন্য কিছু তা বোঝার উপায় নেই, একমাত্র ক্ষীণ সূত্র ঐ মেঘনাদবধ কাব্য। কিন্তু প্রায় দুই শতকের পুরোনো এই মহাকাব্যের সাথে তার অন্তর্ধানের সম্পর্ক কী? আদৌ কি কোনো সম্পর্ক আছে? কে তাকে এই বইটি পাঠিয়েছে? কেনই বা পাঠিয়েছে? এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই উদ্ঘাটিত হতে থাকে ছবির রহস্য।
ছবিটির নির্মাণ আর পাঁচটা থ্রিলারের মতো নয়। প্রথমার্ধের বেশ কিছুটা অংশ দেখে মনেই হবে না যে এটি একটি থ্রিলার। রহস্যের প্রথম গন্ধ পাওয়া যায় প্রথম দৃশ্যে অসীমাভ বসুর বইয়ের বঙ্গানুবাদ প্রকাশের অনুষ্ঠানে তার বন্ধু প্রাক্তন নকশাল নেতা সিরাজুল ইসলামের প্রশ্ন শুনে, ১৯৫০-এর দশকের কলকাতা আর ২০৫০-এর দশকের কাল্পনিক কলকাতা অসীমাভের উপন্যাসের বিষয় হলেও যে উত্তাল ৭০-এর প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নিজের ছাত্রজীবন কাটিয়েছে সে, তা কেন তার উপন্যাসে আসে না?
এই প্রশ্নে অসীমাভের আড়ষ্ট উত্তর ও অস্বস্তির ভেতরেই যেন লুকিয়ে থাকে এই ছবির শেষে অসীমাভের নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার এক আবছা পূর্বসূত্র। তবে এই প্রশ্ন চিন্তাশীল পাঠককে ভাবিত করে আরেকভাবে, অসীমাভ কি স্বেচ্ছায়ই আনতে চান না সেসময়ের কাহিনী? সেসময় নিয়ে কি কোনো গভীর ক্ষত রয়ে গেছে তার অন্তরে?
অনীক দত্তের স্বাতন্ত্র্য এখানেই। নির্মাণের মতোই ছবির প্লট আর পাঁচটা থ্রিলারের মতো থাকে না, এর মধ্য দিয়ে অনীক ছুঁতে চেষ্টা করেন সত্তরের নকশাল আন্দোলনের অন্তরকে। অসীমভ তার অতীত ভুলতে চাইলেও অতীত তাকে ভোলেনি।
গল্পের প্রবহমানতায় দর্শক আবিষ্কার করেন সত্তরের অসীমাভকে, সাম্যবাদ আর দিনবদলের ডাক অন্য অনেক মেধাবী ছাত্রের মতো যাকে সম্পৃক্ত করেছিল নকশালপন্থী রাজনীতির সঙ্গে। কিন্তু টর্চার সেলে পুলিশি নির্যাতনের অসহনীয়তা আদর্শের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছিল তার জীবনকে। অসীমাভ এরপর বিলেত চলে যান তার ব্যুরোক্রেট বাবার সরকারি ক্ষমতা ও অর্থের জোরে- দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হারিয়ে যায় ভুরভুরে ফরাসি সুগন্ধ, বিদেশী স্কচ-ভদকা, হাভানার তামাকের ধোঁয়ায়; কিন্তু সেই সময়ের কোনো এক স্মৃতি তাকে তাড়িত করে সবার অলক্ষ্যে-তীব্র অনুতাপ আর মনস্তাত্ত্বিক সংকট তাকে দগ্ধ করে চলে অনুক্ষণ। নকশাল আন্দোলনের টুকরো টুকরো ছবি আর ভুলতে না পারা কোনো গ্লানি তিনি বয়ে বেড়ান। তারপরের গল্পে রহস্য ঘনায় এবং তা উদ্ধারও হয় গল্পের নিজের আঙ্গিকে।
গল্প বলার একটু মন্থর ভঙ্গি, প্লটের ভেতরে আরো অনেক সাবপ্লট, টান টান থ্রিলারের তুলনায় সিরিয়াস বিষয়বস্তুর সঙ্গে একধরনের ধ্রুপদী রহস্য-ঘরানাকে জুড়ে দেওয়া- সব মিলিয়ে ‘মেঘনাদবধ রহস্য’ দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখার মতোই।
এ ছবিতে হালের বেশ বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সমাগম ঘটেছে। অসীমাভ চরিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তী, কুণালের চরিত্রে আবীর চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী চরিত্রে গার্গী রায়চৌধুরীর নিটোল অভিনয় পুরো ছবি জুড়েই চোখ জুড়িয়েছে। এছাড়া বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, সায়নি ঘোষ, কল্যাণ রায়চৌধুরী, অনিন্দ্য পুলক, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়রা ছিলেন অসাধারণ। ঝকঝকে ছবির পাশাপাশি ভালো লেগেছে দেবজ্যোতি মিশ্রের সংগীত পরিচালনা। বিশেষত শেষ গানটা পাল্টে দিয়েছে ছবির আবহটাই, পরিস্থিতির প্রয়োজনে যেটা খুবই দরকারি ছিল!
শেষ কথা বলতে গেলে বলতে হয়, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’কে অনীক দত্ত থ্রিলারের পরিচিত পথ থেকে সরিয়ে স্থাপন করেন ইতিহাসের এক তাৎপর্যময় গলি-ঘুঁপচিতে। দর্শকের কাছে ছুঁড়ে দেন অনেক প্রশ্ন, অনেক ভাবনাও। এই ছবি থ্রিলার থেকেও বেশি করে হয়ে উঠেছে এক পালিয়ে যাওয়া-আত্মরতিপরায়ণ-ভীতু-তথাকথিত ‘সফল’ প্রজন্মের স্বীকারোক্তি। ‘ঘৃণা-রাগ-অভিমান-ঝগড়া-আপোসে’র জীবনে দানবিক সিস্টেমের কাছে আমাদের অসহায় আত্মসমর্পণ, দাক্ষিণ্যলোভী জীবনের মার্জিনে ‘বিপ্লব’- এর প্রেতাত্মার আনাগোনা, ফেলে যাওয়া দীর্ঘশ্বাস, যার সাথে মিশে যায় সুবিধাভোগী শ্রেণীর কাছে পরাজিত খেটে খাওয়া মানুষদের অভিমান- এর মধ্যেই থাকেন সিরাজুলরা, এঁদো গলিতে, বারো ঘর এক উঠোন পেরিয়ে, স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল আর খুপরি ঘরে কিছুটা বীতশ্রদ্ধ আর খানিক ভঙ্গুর স্বপ্ন নিয়ে। বাদল বিশ্বাসেরা ফেরারি হন, সংগঠিত করেন মুখে গামছা বাঁধা-হাতে রাইফেল মাওবাদী গেরিলাদের স্কোয়াডকে আর কাহিনীর শীর্ষবিন্দু থেকে আরো একবার বিবেকের যন্ত্রণায় অদৃশ্য হয়ে এস্কেপ রুট খুঁজে নেন অসীমাভ বোসের মতো ট্র্যাজিক চরিত্ররা। প্রচুর চমক, আলো-আঁধারির অনুপস্থিতি উচ্চমানের থ্রিলারে পরিণত করে না ঠিকই, তবে এ ছবির বার্তা দর্শকের মনোসরোবরে ঢেউ তোলার মতোই!