গ্রীক উপকথার অন্যতম পুরোনো আর বিখ্যাত কাহিনী আর্গোন্যাটসদের অভিযান। প্রায় ৩,০০০ বছর ধরে চলে আসা এই গল্পে স্বর্ণপশমী মেষচর্ম উদ্ধার করতে গিয়ে জ্যাসন নামে এক তরুণ গ্রীক বীরের সঙ্গী হন গ্রীক মিথোলজির সুপরিচিত কিছু চরিত্র। এর পটভূমি ট্রোজান যুদ্ধেরও প্রায় এক প্রজন্ম আগের, সম্ভবত ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সময় ঘিরে। তবে জ্যাসনের অ্যাডভেঞ্চার লিখিত আকারে আসতে আরো ছয়শো বছর লেগে যায়। আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে থেসালি অঞ্চল থেকে কবিতার ছন্দে আর্গোন্যাটসের কথা বর্ণিত হতে শুরু করে। এই কাহিনীতে মেষচর্ম উদ্ধারের সাথে কৃষ্ণসাগরে জ্যাসনের যাত্রাপথের বর্ণনাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
আমাদের চার পর্বের এই সিরিজের কাহিনী গড়ে উঠবে চমকপ্রদ এই অভিযানকে ঘিরেই। বিভিন্ন কালে নানা গ্রীক লেখক সময়ের সাথে মিলিয়ে জ্যাসনের গল্প বিবৃত করেছেন বলে স্থান আর চরিত্রের কিছুটা অসামঞ্জস্যতা তাদের লেখনীতে থেকে যায়। সবচেয়ে পঠিত লেখা বোধকরি প্রাচীন রোডসের নামজাদা লেখক অ্যাপোলোনিয়াসের হাতে রচিত, যিনি একসময় আলেক্সান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরির পরিচালক ছিলেন। মনে করা হয়, খ্রিস্টের জন্মের তিনশো বছর আগে, অ্যালেক্সান্ডার এশিয়াতে আক্রমণের পরে তিনি কবিতার আকারে এই গল্প লিপিবদ্ধ করেন। চলুন, তার সাথে ঘুরে আসি প্রাচীন গ্রীসের জাদুকরি জগত থেকে।
স্বর্ণপশমী মেষচর্ম
আর্গোন্যাটসদের উদ্দেশ্য ছিল স্বর্ণপশমী মেষচর্ম হস্তগত করা। কাজেই আগে দেখে নেয়া যাক এর উৎপত্তি হলো কোথা থেকে।
মধ্য গ্রীসের বোয়েশিয়া অঞ্চলের রাজা অ্যাথামাস ভালবেসে বিয়ে করেন দেবী নেফিলিকে। অবিনশ্বর দেবী আর নশ্বর মানবের মিলন খুব সুখের হয়নি। দেবী নেফিলি নিজের খেয়াল-খুশি মতো চলতেন। মর্ত্যের নিয়মকানুন তো আর তার জন্য প্রযোজ্য নয়। এর মধ্যেই অ্যাথামাসের ঔরসে তার দুই সন্তান ফ্রিক্সাস আর হেলের জন্ম হয়।
নেফিলির দুরন্ত স্বভাবে অতিষ্ঠ অ্যাথামাস একপর্যায়ে তাকে ত্যাগ করে অপরূপা ইনোকে বিয়ে করেন। অন্য এক গল্পে বলা হয়, তিনি নেফিলির সাথে বিবাহিত থাকাবস্থাতেই ইনোকে বিয়ে করেন। ইনো ছিলেন দেবতা ডায়ানোসিয়াসের নশ্বর মা সেমেলির বোন। তাদের বাবা থিবস নগরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ক্যাডমাস আর মা দেবী হার্মিওন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের হলে কী হবে, ইনো তার সৎ ছেলে-মেয়েকে একদমই দেখতে পারতেন না। নানাভাবে তিনি অ্যাথামাসের মন তাদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুললেন। একবার রাজ্যে ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ হলো।অনেকে বলেন, অ্যাথামাসের বিশ্বাসঘাতকতায় রাগান্বিত নেফিলিই এর কারণ ছিলেন। যেটাই হোক না কেন ইনো অ্যাথামাসকে প্ররোচনা দিলেন দেবতাদের উদ্দেশ্যে ফ্রিক্সাসকে উৎসর্গ করার। তাহলেই এই দুর্ভিক্ষের অভিশাপ কেটে যাবে।
সংসার ত্যাগ করলেও মায়ের নজর ছেলে-মেয়েদের উপর ছিল। ইনোর দুষ্টচরিত্র নেফিলি জানতেন। দেবতা হার্মিসের কাছ থেকে তিনি সংগ্রহ করলেন এক ডানাওয়ালা মেষ, যার চামড়া ছিল উজ্জ্বল স্বর্ণের। এবার ছেলে-মেয়েকে তিনি প্রাসাদ থেকে বের করে এনে তাদের সেই মেষের পিঠে চড়িয়ে দিলেন। পই পই করে বলে দিলেন উড়ন্ত অবস্থায় কিছুতেই যেন তারা নিচের দিকে না তাকায়।
ফ্রিক্সাস আর হেলের গন্তব্য কলচিস নগরী। কৃষ্ণসাগরের তীরে বিশাল নগরী কলচিসের অবস্থান এখনকার জর্জিয়াতে। সেখানকার রাজা এইটেস ছিলেন দেবতা অ্যাপোলোর মানব সন্তান। সাগ্রহে তিনি অপেক্ষা করছিলেন দেবীর সন্তানদের জন্য। ফ্রিক্সাস আর হেলেকে নিয়ে মেষ তাই ডানা মেলল কলচিসের দিকে। সাগরের উপর দিয়ে যেতে যেতে একপর্যায়ে হেলের মাথা ঘুরতে থাকলে সে মায়ের উপদেশ ভুলে নিচে তাকায়। সাথে সাথেই মেষের পিঠ থেকে হেলে পড়ে গেল সাগরে। এই স্থান ছিল এশিয়া আর ইউরোপকে আলাদা করা এক প্রণালী, যার নাম তখন থেকে হয়ে গেল হেলেস্পন্ট (হেলের সাগর)। বর্তমানে এই প্রণালীর নাম দার্দানেলিস (Dardanelles)।
এদিকে ফ্রিক্সাস বাকিপথ নিরাপদেই অতিক্রম করে কলচিসে পৌঁছলেন। এইটিস তাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং মেয়ে চ্যালসিওপিকে তার হাতে তুলে দিতে চাইলেন। তবে তার আগে ফ্রিক্সাস তাকে রক্ষার জন্য দেবরাজ জিউসের উদ্দেশ্যে স্বর্ণচামড়ার সেই মেষটি উৎসর্গ করেন। এরপর তিনি এর চামড়াটি দিয়ে দেন হবু শ্বশুর এইটিসের কাছে। এক ভবিষ্যতদ্রষ্টা এইটিসকে জানালেন, তার সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা নির্ভর করছে এই স্বর্ণপশমী মেষচর্ম তার ভূখণ্ডে রাখার ওপর। ফলে এইটিস অত্যন্ত সতর্ক হলেন। যুদ্ধের দেবতা এরিসের বাগানের এক সুউচ্চ ওক গাছের উপর মেষচর্মটি টাঙিয়ে দেয়া হলো। বাগানের প্রহরায় নিযুক্ত হলো সদাজাগ্রত এক ড্রাগন।
আয়োল্কোসের রাজপরিবার
থেসালির অন্তর্গত সমৃদ্ধ এক রাজ্য আয়োল্কোস। ন্যায়পরায়ণতার সাথে এই সাম্রাজ্য শাসন করছিলেন রাজা এসন। তার উত্তরাধিকারী ছেলে জ্যাসন। ছেলের বয়স যখন দশ তখন এসনের ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের মেঘ ঘনিয়ে এলো। তার ছোট ভাই পেলিয়াস চক্রান্ত করে তাকে সিংহাসন থেকে হটিয়ে দিলেন। এসন কোনোমতে জ্যাসনকে বাঁচাতে সক্ষম হন। নিরাপত্তার স্বার্থে সন্তানকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন নামকরা শিক্ষক চিরনের কাছে। চিরন ছিলেন একজন সেন্টর, অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক অশ্ব। তার আস্তানাতে আরো অনেক তরুণ ছাত্রের সাথে জ্যাসন অস্ত্রসহ অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে। যৌবনে উপনীত হয়ে জ্যাসন অনুভব করল তার উত্তরাধিকার বুঝে নেবার সময় হয়েছে। আয়োল্কোসের বৈধ রাজা সে-ই। কাজেই জ্যাসন ঠিক করল এবার চাচার কাছে গিয়ে রাজ্য তার হাতে বুঝিয়ে দেয়ার দাবী করতে হবে। যে-ই কথা সেই কাজ। চিরন আর বহুদিনের পড়ালেখার সাথীদের ছেড়ে জ্যাসন রওনা দিল উত্তরাধিকার আদায় করতে। এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে আরো দশ বছর। জ্যাসন এখন বিশ বছরের এক টগবগে যুবক।
দেবীর সাক্ষাৎ
জ্যাসন দ্রুতবেগে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলছিল। এমন সময় সে দেখতে পেল সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক নদী। খুব বেশি গভীর না হলেও এই নদী যথেষ্ট চওড়া, আর স্রোতও বেশ। সুতরাং হেঁটে পার হতে কষ্ট পোহাতে হবে। জ্যাসন প্রস্ততি নিল সাবধানে নদী পার হবার। এমন সময় নদীর পাড়ে এক বৃদ্ধা তার দৃষ্টিগোচর হলো। বৃদ্ধা নদী পার হতে পারছিলেন না, তাই তিনি কাতর কণ্ঠে জ্যাসনকে অনুরোধ করলেন তাকে একটু নদীটি পার করে দিতে। স্রোতের দিকে তাকিয়ে জ্যাসন কিছুটা দ্বিধা করল। তার একার পক্ষে পার হওয়াই ঝুঁকিপূর্ণ, আর সাথে বৃদ্ধা থাকলে ঝুঁকি আরো বাড়বে। তবে শেষপর্যন্ত বৃদ্ধাকে সাহায্য করতে সে মনস্থ করল। দু’হাতে তাকে তুলে নিয়ে স্রোত ঠেলে জ্যাসন পার হতে লাগল পাহাড়ি নদী। তীব্র স্রোতে তার এক পায়ের জুতা ভেসে গেলেও সে নিরাপদে অপর পাড়ে এসে পৌঁছল।
অপর পাড়ে এসে এবার জ্যাসন বৃদ্ধাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। কিন্তু এ কী! বৃদ্ধার পা মাটি ছোঁয়ার সাথে সাথে বয়স্ক মহিলা কর্পূরের মতো উবে গেল। সেই জায়গা দখল করলেন এক অপরূপা নারী। জ্যাসন চোখ কচলে নিল। ভুল দেখছে নাকি? নাহ, সত্যি সত্যি এক সুন্দরী নারী তার সামনে দণ্ডায়মান। সেই নারী স্মিত হেসে জানালেন, তিনিই হেরা। জিউসের স্ত্রী, অলিম্পিয়ান প্রধান দেবী। তিনি জ্যাসনকে আশ্বাস দিলেন, এখন থেকে তার জীবনে হেরার আশীর্বাদ আর সহায়তা থাকবে সবসময়।
নিজ রাজ্যে জ্যাসন
হেরার শক্তিতে বলিয়ান জ্যাসন আয়োল্কাসে প্রবেশ করলেন। এখানকার বাজারে দেখা পেলেন চাচা পেলিয়াসের, সমুদ্রদেব পোসাইডনের সম্মানে আচার-অনুষ্ঠান পালন করছেন। বলিষ্ঠ আর সুদর্শন জ্যাসন উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। পেলিয়াসও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি আচার শেষ করে আগন্তুকের পরিচয় জানতে চাইলেন। যুবক এসনের ছেলে জানতে পেরে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তার শঙ্কা ভয়ে পরিণত হলো যখন জ্যাসনের পায়ের দিকে নজর গেল। একপায়ে জুতা দেখে তার স্মরণ হলো বহুকাল আগে এক ভবিষ্যতদ্রষ্টার কথা। সেই লোক তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল যে, একপায়ে জুতা পরা কারো কাছেই তার সিংহাসন হারাতে হবে। কিন্তু তিনি জ্যাসনকে কিছু বুঝতে দিলেন না। সমাদর করে তাকে নিয়ে এলেন রাজপ্রাসাদে। এখানেই পাঁচদিন ধরে জাঁকজমকের সাথে জ্যাসনকে আপ্যায়ন করা হলো। ষষ্ঠ দিন জ্যাসন চাচাকে অনুরোধ করল এবার তার হাতে রাজদণ্ড তুলে দেবার জন্য, কারণ আইনানুসারে সে-ই আয়োল্কাসের সত্যিকারের শাসক।
পেলিয়াস জানতেন এরকম হবে। কূট স্বভাবের রাজা তাই আগেই এক পরিকল্পনা ফেঁদেছিলেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে জানালেন, অবশ্যই তিনি জ্যাসনকে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, কিন্তু তার একটা অসমাপ্ত কাজ শেষ করা দরকার, বয়সের কারণে যা তিনি সম্পন্ন করতে পারছেন না।
জ্যাসন কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। কী এমন জরুরি কাজ পেলিয়াসের? যুবকের আগ্রহ জাগিয়ে তোলা গেছে বুঝতে পেরে পেলিয়াস এবার এক মনগড়া কাহিনী সাজালেন। ফ্রিক্সাস নাকি স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাকে আদেশ করেছেন কলচিস থেকে স্বর্ণপশমী চামড়া আয়োল্কাসে নিয়ে আসতে। জ্যাসন যদি তার এই উপকারটুকু করে দিতে পারে তাহলে তিনি রাজদণ্ড সাথে সাথেই তার হাতে ছেড়ে দেবেন। জ্যাসন রাজি হয়ে গেলেন। পেলিয়াস খুশিতে বাগ বাগ! তিনি নিশ্চিত, এই ভয়ঙ্কর অভিযান থেকে জ্যাসন কখনোই বেঁচে ফিরতে পারবেন না। নিজ বংশের রক্তে হাত রাঙাতে হলো না, আবার উত্তরাধিকারির বিনাশও হলো। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না!