কলম এমন একটি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যার প্রয়োজন রয়েছে সবখানে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অফিস-আদালত বাড়িতে, দোকানে, বাজারেসহ সব জায়গাতেই কলম একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে কলমেও। প্রযুক্তির উৎকর্ষে হাতে হাতে মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ, কম্পিউটার অনেকটাই কলমের কাজ করে দিচ্ছে, তা বলে কলমের চাহিদা বা প্রয়োজন এতটুকুও কমেনি।
নিত্য প্রয়োজনীয় এই কলম কিন্তু একদিনেই আবিষ্কার হয়নি। এর আবিষ্কারের পিছনে আছে এক বিস্তৃত ইতিহাস।
কলমের ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরানো। ধারণা করা হয়, প্রাচীন মিশরীয়রা সর্বপ্রথম কলম ব্যবহার শুরু করে। সে সময় অবশ্য আজকের মত মসৃণ কোন কাগজ ছিল না। সে সময় লেখালেখি করা হত বিভিন্ন গাছের পাতা, বাকল এবং পশুর চামড়ার উপর। কলম হিসেবে তারা ব্যবহার করত নলখাগড়া, শর বা বেণু, বাঁশের কঞ্চি অথবা ফাঁপা খন্ড। এসব খন্ড কলমের মতো করে কেটে সূচালো করা হত। সূচালো অংশটি কালির মধ্যে চুবিয়ে লেখা হত। কালিও ছিল বিভিন্ন গাছের রস এবং বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক উপাদান দ্বারা প্রস্তুত।
নলখাগড়া জাতীয় কলমের ব্যবহার চলে বহুকাল। দীর্ঘকাল পর প্রায় ৫’শতকের দিকে এসে কঞ্চি বা নলখাগড়ার জায়গা দখল করে পাখির পালক। রাজহাঁসের পালক ছিল সে যুগের কলম তৈরির প্রধান উপকরণ। পালকের মাথা সূক্ষ্মভাবে সূচালো করা হত যাতে লিখতে সুবিধা হয়।
আবিষ্কারের ইতিহাস
আদিম যুগে মানুষ যখন পাহাড়ের গুহায় বসবাস করত তখন মনের ভাব প্রকাশের জন্য গুহার দেয়ালে কোন সূক্ষ্ম জিনিস দিয়ে ছবি আঁকত বা হিজিবিজি আঁকত। আবার অনেকসময় গাছের পাতার রস বা শিকারের রক্ত দিয়ে আঁকিবুকি কাটত। তার অনেক শতাব্দি পর মানুষ যখন কিছুটা সভ্য হতে শুরু করল তখন কাদা মাটির পাটায় বা নরম পাথরে লেখা শুরু করে।
ধারণা করা হয়, প্রাচীন মিসরীয়রা সর্বপ্রথম কলম আবিষ্কার করে। তারা একটি কাঠির ডগায় তামার নিবের মত বা ধাতব কিছু একটা পড়িয়ে লেখা শুরু করে। প্রায় ৪’হাজার বছর আগে রীতিমতো লেখালেখি শুরু করে দিয়েছিল গ্রীকরা। তারা কলম তৈরি করত হাতির দাঁত বা এ জাতীয় কিছু দিয়ে। যার নাম ছিল স্টাইলাস (Stylus)। সেজন্য এখনো লেখার ধরনকে স্টাইল (Style) নামে অভিহিত করা হয়। এদিকে মধ্যযুগের পর যখন কাগজ শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হল তখন পাখির পালক এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।
প্রাচীনকালের এমন অনেক কলম রয়েছে যা এখন শুধুমাত্র জাদুঘরেই শোভা পায়। চলুন জেনে নেওয়া যাক এমন কিছু কলম সম্পর্কে।
স্টাইলাস (Stylus)
স্টাইলাস ছিল এক ধরনের ব্রোঞ্জের শলাকা বিশেষ। অনেক সময় ব্রোঞ্জের শলাকাটি হাতির দাঁতের সাথে সংযুক্ত করে এই জাতীয় কলম তৈরি করা হত। ব্রোঞ্জের শলাকার পোশাকি নাম ছিল স্টাইলাস (Stylus)। সেই জন্য বর্তমানে লেখার ধরনকে স্টাইল (Style) বলা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্বয়ং জুলিয়াস সিজার এই কলম ব্যবহার করতেন। এই কলম দ্বারা তিনি কাসকাকে আঘাত করেছিলেন। প্রায় চার হাজার বছর আগে গ্রীকরা এ কলম ব্যবহার করত।
খাগের কলম
খাগড়া একধরনের ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। এটিকে অনেক সময় নলখাগড়া বলা হয়ে থাকে। এই খাগড়ার একদিকে সরু করে কেটে এই কলম তৈরি করা হতো। এই কলমের দৈর্ঘ্য ছিল ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি। এর লিখন পদ্ধতি অনেকটা কুইলের (Quill) এর মত। এর মাঝের ফাঁকা অংশে কালি ভরা হত। একবার কালি ভরলে বেশ কয়েক পৃষ্টা অনায়াসেই লেখা যেত। সে সময় খাগের কলমেরও বিভিন্ন রকম প্রকার ছিল।
বন গাছের কলম
খাগড়া বা নলখাগড়া একধরনের উদ্ভিদ যার আকৃতি অনেকটা বাঁশের কঞ্চির মতই। সাধারণত একটি বনে জন্মাতো বলে একে বন খাগড়া বলা হত। আমাদের দেশে গ্রাম অঞ্চলে এখনো প্রচুর নলখাগড়া জন্মায়। একসময় বন গাছের দ্বারা তৈরি এই কলম ব্যবহার করা হতো। এই খাগড়ার মাঝে কোনো ফাকা অংশ নেই। একধরনের শোষক বস্তু দ্বারা পরিপূর্ণ থাকত।
সেজন্য বন কলম কিছুক্ষণ কালির দোয়াতে চুবিয়ে রাখলে এটি কালি শোষণ করে রাখতে পারত। এটির কাণ্ড ফাঁপা, অনেকটা এখনকার বিভিন্ন রংয়ের খাতায় দাগ টানার জন্য যে কলম আমরা ব্যবহার করি তার ভিতরের স্পঞ্জের শিষের মত বলে সহজে কালি শুষে নিত। এরপর সেটা দিয়ে লেখালেখি করা হত। কালি শেষ হয়ে গেলে পুনরায় দোয়াতে চুবিয়ে নেয়া হত।
বাঁশের কঞ্চির কলম
কলমের বিবর্তন ইতিহাসে এমন একটি সময় ছিল যখন বাঁশের কঞ্চি দিয়েও কলম তৈরি করা হত। বাঁশের কঞ্চির কলমের ব্যবহার ছিল বন কলমের সমসাময়িককালে। এর ব্যবহার অল্প কিছুকাল আগেও চোখে পড়ত। বাঁশের কঞ্চিকে ৫ থেকে ৭ ইঞ্চি লম্বা করে কেটে এর এক প্রান্ত তীক্ষ্ণভাবে সূচালো করা হত। কঞ্চির মাঝখানের ফাঁকা অংশ খালি ভরে লেখালেখি করা হত। কালি শেষ হয়ে গেলে পুনরায় কালি ভরে নেয়া হত।
কুইল বা পালকের কলম
পাখির পালক এর দ্বারা তৈরি কলমকে কুইল (Quill) বলা হয়। সাধারণত রাজহাঁস কিংবা বড়সড় পাখি ডানার পালক দ্বারা এ ধরনের কলম তৈরি করা হয়। নিব কলম এবং ঝর্না কলম আসার আগে কুইল ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। এই কলম তৈরির উদ্দেশ্যে বসন্তের সময় পাখির ডানার শেষ দিকের ৫/৬ টি পালক তুলে নেয়া হত। সাধারণত, পাখির বাম ডানার পালক বেশি ব্যবহার হত। কারণ, এগুলো বাম দিক থেকে বাইরের দিকে একটু বাঁকানো থাকে, যার কারণে ডানহাতি লেখকদের জন্য ব্যবহার করা সহজ হত। পালকের মাঝখানে যে ফাঁকা অংশ থাকে সেটা কালিদানি হিসেবে কাজ করে। কৈশিক পরিচালন প্রক্রিয়ায় কালির পরিচলন হত। কুইল বা পাখির পালকের কলম মধ্যযুগের বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মধ্যযুগে পার্চমেন্ট বা চামড়ার কাগজের উপর এ কলম দ্বারা লেখা হতো। পালকের কলম বা কুইল আসার পরে খাগড়া কলমের ব্যবহার বেশ কমে আসে। এরপর একপর্যায়ে নলখাগড়ার কলম বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কুইলের বেশ কিছু সমস্যাও ছিল। এক সপ্তাহ পর পর এই কলম পাল্টানোর প্রয়োজন হতো এবং এটি তৈরি করতে বেশ সময় এবং শ্রম লাগত। তাছাড়া, দক্ষ ব্যক্তি ছাড়া সবাই এটি তৈরি করতে পারত না। দামি রূপো বা তামার কালির পাত্রের সাথে ময়ূরের কলম শোভা পেত রাজা-বাদশাহদের দরবারে। কয়েক দশক আগেও অফিস-আদালত এবং অভিজাত শৌখিন ব্যক্তিদের ঘরে শোভা পেত এই পালকের কলম। কিন্তু এখন আর তেমনটা দেখা যায়না।
নিব কলম
সাধারণত একটি ধাতব নিব কাঠের হাতলের সাথে লাগিয়ে এই কলম তৈরি করা হত। এর নিবটি দেখতে ঝর্ণা কলমের মতই, তবে এতে কালি জমা রাখার কোন ব্যবস্থা ছিল না। কালদানি না থাকার কারণে প্রতিবার লেখার পূর্বে এটি কালির পাত্রে চুবিয়ে নিতে হত। ঝর্না কলমের তুলনায় এই কলমের সুবিধা হলো, এই কলম দিয়ে ঘন কালি এবং ধাতব কালি ব্যবহার করা যায়। ঝর্ণা কলমে ঘন কালি ব্যবহার করলে জমে গিয়ে আটকে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনও নিব কলমের ব্যবহার দেখা যায়। প্রধানত ক্যালিওগ্রাফি, অলংকরণ ও কমিকস আঁকার ক্ষেত্রে এই কলম ব্যবহার করা হয়।
কালির কলম
সাধারণত এশীয় লিপিবিদদের মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে এই কলম ব্যবহার করার প্রচলন দেখা গিয়েছে। এ ধরনের কলমকে ব্রাশ বা বুরুশ বলা হয়। কলমের মূল অংশটি সাধারণত বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হত। এছাড়া বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে দুর্লভ উপকরণ যেমন লাল চন্দন গাছ, হাতির দাঁত, সোনা, রূপা ইত্যাদিও ব্যবহার করা হতো। কলমের শীর্ষ ভাগের ব্রাশটি তৈরি করা হত বিভিন্ন পাখির পালক বা বিভিন্ন পশুর লোম দ্বারা। এককালে চীন এবং জাপানের নতুন জন্ম নেওয়া শিশুদের মাথার চুল দ্বারা এই বুরুশ তৈরি করা হতো।
আধুনিক কলমের ইতিহাস
আধুনিক কলম তৈরির এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আধুনিককালে সর্বপ্রথম ১৭৮০ সালে ইংল্যান্ডে কলম আবিষ্কৃত হয়। এরপর ১৮৮৪ সালে ওয়াটারম্যান আবিষ্কার করেন ফাউন্টেনপেন। তখন এর নিব তৈরি করা হতো ১৪ ক্যারেট সোনা এবং ডগা তৈরিতে লাগত ইরিডিয়াম। এরপর ইংল্যান্ড ছাড়াও বিভিন্ন দেশে ফাউন্টেনপেন তৈরি হতে শুরু করে। বিংশ শতাব্দীতে এসে তৈরি হয় বলপয়েন্ট পেন বা বলপেন। সর্বপ্রথম বলপেন আবিষ্কার হয় ১৯৮৮ সালের ৩০ অক্টোবর। জন লাউড নামক একজন পত্রিকার সম্পাদক সর্বপ্রথম এই কলম আবিষ্কার করেন। তবে তার এ আবিষ্কার স্বীকৃতি পায়। ১৯৪৩ সালে লেডিসলাস বিরো এবং তার ভাই জর্জের হাত ধরে বলপয়েন্ট পেন বাজারকৃত হয় এবং আবিষ্কারের স্বীকৃতি পায়।
ঝর্না কলম বা ফাউন্টেন পেন
বিশ্বে প্রথম ঝর্না কলম আবিষ্কৃত হয় ৯৫৩ সালে। হাত এবং কাপড় যাতে কালি লেগে নষ্ট না হয়ে যায়, সেই জন্য মিশরের সম্রাট মা’দ আল-মুয়িজ একটি কলম আবিষ্কারের কথা চিন্তা করলেন। সেই সময়ই এই কলম তৈরি হয়। অনেকে মনে করেন ফাউন্টেন পেন থেকে ঝর্না কলমের বাংলা অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এই কলমের পানি ভিত্তিক তরল পদার্থ দ্বারা নিবের সাহায্যে লেখা হয়। কলমের ভেতরে কালিদানিতে থাকা কালি কৈশিক পরিচালন প্রক্রিয়ায় এবং অভিকর্ষের সাহায্যে নিবের মাধ্যমে বাইরে বের হয়ে আসে। একটা চিকন ফাটল দিয়ে কালি বাইরে বেরিয়ে আসে। ভেতরের কালিদানিতে কালি শেষ হয়ে গেলে দোয়াত থেকে পুনরায় কালি ভরা যায়।
কলমের বিবর্তনের ইতিহাসে ঝর্ণা কলমের আবিষ্কার এক অভূতপূর্ব সফলতা। কারণ ইতোপূর্বে যতগুলো কলম আবিষ্কৃত হয়েছে কোনটাই ফাউন্টেনপেনের মত ফলপ্রসূ ছিল না। এই কলমে একবার কালি ভরে নিলে ৮ থেকে ১০ পৃষ্ঠা একটানা লেখা যেত। বর্তমানে ঝর্না কলম বা ফাউনটেনপেনগুলো আরো বেশি আধুনিক। এর কালি ভর্তি প্রকোষ্ঠ গুলো আলাদাভাবে কিনতে পাওয়া যায়। আর একটি প্রকোষ্ঠ দিয়ে লেখা যায় দীর্ঘদিন। ঝর্না কলম দিয়ে লিখতে বেশি চাপ প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়না। খুব সহজে আলতো চাপে এই কলম দিয়ে লেখা সম্ভব।
ফেল্ট টিপ কলম বা মার্কার কলম
এই কলমে আঁশ জাতীয় পদার্থের তৈরি স্পঞ্জের মতো ডগা থাকে। চিকন এবং সূক্ষ্ম ডগার কলমগুলো দিয়ে কাগজের উপর লেখা যায়। মাঝারি আকারের ডগা বিশিষ্ট কলম দ্বারা বাচ্চাদের আঁকিবুকির কাজে ব্যবহার হয়। আর বড় আকারের ডগা বিশিষ্ট কলম দ্বারা হোয়াইটবোর্ড কিংবা কাঠবোর্ডে লেখালেখি করা হয়। বাচ্চাদের এবং হোয়াইট বোর্ডে লেখার জন্য সাধারণত যে সমস্ত মার্কার পেন ব্যবহার হয় সেগুলোর কালি অস্থায়ী হয়ে থাকে। কিছু মার্কার ব্যবহার হয় প্যাকেজিং এবং চালানের বাক্সের গায়ে লেখার জন্য।
বলপয়েন্ট পেন এর ইতিহাস
বলপয়েন্ট কলমের আবিষ্কার উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। এ সময় ১৯৮৮ সালে আমেরিকান উদ্ভাবক জন লাউড তৈরি করে ফেললেন এক বিশেষ ধরনের বলপেন। কলমের নিবের মুখে লাগালেন এক ঘূর্ণিগোলক যা লেখার সময় অনবরত ঘুরতে থাকত এবং কালি বের হয়ে আসত। এই কলমের একটি ছোট খোপে তরল কালি রাখা হত। সেখান থেকে কালি কলম এর মাথায় নেমে আসত। মাথায় লাগানো ছিল রোলার বল টিপ। ওটা ঘূর্ণনের মাধ্যমে কালি সরবরাহ করত। বলা চলে জন লাউডের হাত ধরেই প্রথমবারের মতো বলপয়েন্ট কলমের ধারণা পায় মানুষ। স্রেফ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের দিকে মনোযোগ না দেওয়ায় বিশ্ব তার এ আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিল না।
জন লাউডের আবিষ্কারের পর পরবর্তী ৩০ বছরে প্রায় ৩৫০টি কলমের প্যাটেন্ট আবেদন গৃহীত হলেও সেগুলো খুব বেশি জনপ্রিয় হলো না। কারণ, প্রতিবারই সমস্যা ছিল কালি নিয়ে। কালি বেশি তরল হলে বলের ফাঁক দিয়ে তা চুইয়ে বাইরে বেরিয়ে আসত, আবার বেশি ঘন হলে লেখার সময় প্রয়োজনীয় পরিমাণে কালি নেমে আসত না।
তারও প্রায় ৫০ বছর পর একই প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হলেন হাঙ্গেরীয়ান দুই ভাই। লেডিসলাস বিরো ছিলেন একজন হাঙ্গেরীয়ান পত্রিকার সম্পাদক। যিনি তার ভাই জর্জের এর সাহায্যে এই কলম তৈরি করে ফেললেন। জর্জ ছিল একজন রসায়নবিদ। সে সময় আবহ তৈরি হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ফলে তাদের আবিষ্কৃত বলপেন বাজারজাত করার আগেই তারা দেশছাড়া হলেন। পালিয়ে চলে এলেন ল্যাটিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায়। সেখানে প্যাটেন্ট নেওয়া হয়ে গেল আর বিরো ও তার ভাই ফ্রান্সের বিখ্যাত ব্যবসায়ী বিক’কে চড়া দামে সেই প্রযুক্তি বাজারজাত করার লাইসেন্সও বিক্রি করে দিলেন।
১৯৪৩ সালে তারা আর্জেন্টিনায় একটি বলপয়েন্ট পেন এর কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও এই কলমে থেকে যাওয়া কিছু ত্রুটি সারিয়ে সত্যিকারের কর্মক্ষম বলপয়েন্ট আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমেরিকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিকাগোর একজন নাবিক মিল্টন রেনল্ডস আর্জেন্টিনা থেকে কয়েক ধরনের বিরোর বলপয়েন্ট পেন আমেরিকায় নিয়ে আসেন এবং তার হাত ধরেই বিরো ভাইদের বানানো বলপয়েন্ট কলমের অবশিষ্ট ত্রুটিগুলো দূর হয়।
সেই থেকে পুরোদমে চালু হয়ে গেল বল পয়েন্ট পেন এর উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ। খুব দ্রুতই এই কলম ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বব্যাপী। যদিও সেই সময় একটি বলপয়েন্ট পেনের জন্য ক্রেতাদের খরচ করতে হতো সাড়ে ১২ ডলারের উচ্চমূল্য। ১৯৪৩ সালের ১০ জুন ইউরোপিয়ান প্যাটেন্ট অফিসে তারা প্যাটেন্টের আবেদনপত্র পূরণ করেন বলে বর্তমানে এই দিনকে সারাবিশ্বব্যাপী বলপয়েন্ট দিবস হিসেবে পালন করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যে কলমকে বলপয়েন্ট পেন নামে চিনি, ইংল্যান্ডে সেই কলম এখনোও বিরো পেন নামে পরিচিত।
যেভাবে কাজ করে আধুনিক বলপেন
কলম নির্মাণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগটা বেশ লক্ষণীয়। অনবরত একই ধারায় কালি বেরোনোর প্রযুক্তি কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত। আর এই ব্যবস্থা দিন দিন উন্নত হচ্ছে বলে এর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। রিফিলের কালি সাধারণ কালির মত পাতলা নয়, বরং এটি আঠালো। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে উপরের বস্তু নিচের দিকে নেমে আসে, ঠিক সেই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে রিফিলের চটচটে আঠালো কালি লেখার সময় নিচের দিকে নেমে আসে। কিন্তু বাইরের দিকে বেরিয়ে আসতে বাধা দেয় একটি বলের মত গোল ধাতব পদার্থ যা থাকে সকেট এর মধ্যে।
লেখার সময় কলম চলতে থাকলে বলটা সকেটের মধ্যে ঘুরতে থাকে। বলের ভেতরের যে অংশে কালি থাকে লেখার সময় তা কালি মেখে চলে আসে বাইরে। কাগজে চাপ দিলেই লেখা ফুটে ওঠে, শব্দের পর শব্দ লেখা হচ্ছে। কলম এগিয়ে চলছে, কাগজের উপরে বলের যে দিক কালি লাগানো নয় সেই অংশ ভিতরে এলে পুনরায় কালি মেখে বাইরে চলে আসে। এভাবে কোনরূপ বাধা ছাড়াই অনবরত ঘুরতে থাকে। এর ফলে বলের মুখে মাখানো কালি শুকিয়ে যায় না। লেখা শেষ হলে এর কর্মপদ্ধতিও সমাপ্ত হল। অর্থাৎ, বলের ঘূর্ণন থেমে গেলে বাইরে কালি আসাও বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে রিফিলের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কালি শুকিয়ে যাওয়ার কোন ভয় নেই। বর্তমানের আধুনিক বল পয়েন্টপেনগুলো ঠিক এই প্রক্রিয়ায় কাজ করে।