“The Ashes – The Greatest Rivalry In Sport”
এই শব্দগুলো যখন ভেসে আসছে, বুঝতে পারছেন বেজে উঠেছে অ্যাশেজের দামামা। গ্যালারিভর্তি লাখো দর্শকের গগনবিদারী চিৎকারের সঙ্গে মুহূর্মুহূ করতালিতে মুখরিত স্টেডিয়াম। কথার লড়াই, শরীরী ভাষার প্রদর্শনী, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তাড়না, এবং কিংবদন্তি হয়ে ওঠার মঞ্চ।
এত সব আলোচনার বাইরেও সর্বশেষ অ্যাশেজ সিরিজ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে অবিশ্বাস্য স্টিভেন স্মিথের জন্য। স্মরণীয় হয়ে থাকবে উইলোবাজির ঝলকানিতে দুয়োধ্বনি কীভাবে বন্দনায় পরিণত হয়, সেই শাশ্বত গল্পগাঁথার জন্য। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস (২১১), সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি (৩টি), সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক (৭৭৪), সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় (১১০.৫৭) – অ্যাশেজে স্মিথের উইলোবাজি’র ঝলকানির একটা ঝলক মাত্র!
***
এজবাস্টন, বার্মিংহাম – প্রথম টেস্ট।
স্টিভেন স্মিথ খেলতে নামবেন ইংলিশ দর্শকদের দুয়োধ্বনি শোনার প্রস্তুতি নিয়ে। ষোল মাসে আপনার স্মৃতিতে যদি ধুলো না জমে, নিশ্চয়ই মনে পড়ছে কড়া পুলিশি পাহারায় বিমানবন্দর ত্যাগের সেই দৃশ্য, প্রেস কনফারেন্সে স্মিথের কান্নার সেই দৃশ্য। কেপটাউনে বল টেম্পারিং কান্ডের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বিশ্বকাপ খেলেছেন এই ইংল্যান্ডের মাটিতেই।
অজি আর ইংলিশদের কাছে অ্যাশেজ একটা বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে বড় কিছু। সেটা জিততে যা যা করা দরকার, সব মঞ্চায়ণ করতেই প্রস্তুত থাকে দু’দল। সেখানে ইংলিশদের সমর্থক গোষ্ঠী বার্মি আর্মিরা যে স্মিথকে কেপটাউনের দৃশ্যগুলো ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেবে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ওয়ার্নার আউটের পর ড্রেসিংরুমের সিড়ি বেয়ে নামছেন স্টিভেন স্মিথ – গ্যালারির দুয়োধ্বনি যেন মুহূর্তেই ভিন্ন উচ্চতা নেয়। স্টিভেন স্মিথ নিজেকে সামলে নিয়ে ক্রিজে এসে পৌঁছালেন। নিজের সহজাত আন-অর্থোডক্স ভঙ্গিমায় স্ট্যান্স নিচ্ছেন। সাথে নিজস্ব ভঙ্গিমায় ব্যাটটাকে একবার ঝাঁকিয়ে নেন। এই ব্যাটটাই যুগে যুগে একজন ব্যাটসম্যানের সবকিছুর জবাব দেয়ার হাতিয়ার বনেছে। স্টিভ স্মিথের সম্বলও এই উইলোটাই।
প্রথম বলটা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে খেললেন। তখনো স্মিথ বোধহয় এতটুকু ভাবেননি, এই অ্যাশেজ শুধুই স্মিথ নামের বন্দনায় মুখরিত হয়ে থাকবে। ক্রিকেট দুনিয়ার পুরো আলোটা যে স্মিথ নামের উপর গিয়ে পড়বে, এটা তখনো স্মিথের জন্য বাড়াবাড়ি চিন্তা।
কাঁধ থেকে রাজ্যের চাপটা হালকা করতে করতেই নিরানব্বই রানে এসে দাঁড়ান স্টিভেন স্মিথ। চাপটা হালকা করলেন, নাকি আরেকটু বেড়ে গেল? বেন স্টোকসের বলটাকে কাভার অঞ্চল দিয়ে সীমানা-দড়ি খুঁজে পেতে সাহায্যে করে স্মিথ পোঁছে যান তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারে। সেই চারটা স্মিথের রুপকথার গল্প হয়ে যুগ থেকে যুগান্তর বয়ে চলবে, কোনো শব্দ সেটার তাৎপর্য তুলে ধরার সামর্থ্য রাখে না!
স্মিথের উদযাপনের মুহূর্তে ব্রডকাস্টিং ক্যামেরাগুলোর সৌজন্য আপনার দৃষ্টি যাবে অজি ড্রেসিংরুমের দিকে। সতীর্থ এবং কোচিং স্টাফদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছে, ওখানে যেন বিশ্বজয়ের বিজয়োল্লাস হচ্ছে!
এদিকে স্মিথ ব্যাট উঁচিয়ে অভিবাদনের জবাব দেয়ার পূর্বে দু’পা এগিয়ে হাঁটু গেড়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। কতটা দীর্ঘ, বুঝতে হলে আপনাকে স্টিভেন স্মিথ হতে হবে। এরপর খুব ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাট তুলে অভিবাদনের জবাব দেন। স্বভাবসুলভ উদযাপনের সাথে আরো একবার ব্যাট তোলেন গ্যালারির উদ্দেশ্যে। এই কয়েক মিনিটে তৃতীয়বার ব্যাট তুললেন তিনি।
অজিরা পাঁচবার বিশ্বজয় করেছে। প্রতিপক্ষকে দিনের পর দিন শাসন করেছে। অজিদের ইতিহাসে বিখ্যাত সব সেঞ্চুরির কাব্যগাঁথা লেখা রয়েছে। কিন্তু এই সেঞ্চুরি কি একটু ভিন্ন উচ্চতার? ক্ষণ আর মাহাত্ম্য মিলিয়ে এই সেঞ্চুরি কি স্মিথের অস্তিত্ব রক্ষার স্মারক হয়ে থাকবে? এই প্রশ্নগুলোই প্রমাণ করে, এই সেঞ্চুরির বিশেষত্ব আছে বৈকি।
প্রতিপক্ষ, দর্শকের চাপ, গ্যালারীর দুয়োধ্বনি, কেপটাউন দৃশ্যপট – সব কিছুর বিপরীতে দাঁড়িয়ে সেঞ্চুরি। সেটার প্রকাশে তাই কি না এমন বিশ্বজয়ী উল্লাসের সাথে প্রচণ্ড আবেগের সংমিশ্রণ। ইংলিশ বোলারদের কচুকাটা করে দ্বিতীয় ইনিংসেও তিন অঙ্কের পরম আরাধ্য সংখ্যাটার সাথে সাক্ষাৎ হয় স্টিভেন স্মিথের। দুই ইনিংসে স্মিথ খেলেন যথাক্রমে ১৪৪ এবং ১৪২ রানের দু’টি ম্যাচজয়ী ইনিংস।
এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে অভিজাত ফরম্যাটে এটাই ছিল স্মিথের প্রথম টেস্ট। ক্রিকেট বিধাতার নিজ হাতে লেখা চিত্রনাট্য না বলে যদি রূপকথার প্রত্যাবর্তন বলেন, দুটোর শেষেই আসবে, সম্রাটের প্রত্যাবর্তনের চিত্রনাট্য বোধহয় এমনই হয়!
***
লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড, লর্ডস – দ্বিতীয় টেস্ট।
আপনি দেখছেন, জোফরা আর্চারের হাত থেকে ধেয়ে আসা ঘন্টায় ছিয়ানব্বই মাইল গোলায় হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হন স্মিথ। উৎকণ্ঠা জমে অজি ড্রেসিংরুমে। প্রাথমিক শুশ্রূষা নিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পুনরায় খেলা শুরু করেন স্মিথ। পরক্ষণেই আপনি দেখেন, আর্চারের মুষ্টি থেকে ছুটে আসা একই বুলেট গতির আরেকটা বাউন্সার এবার আঘাত হানে স্মিথের হেলমেটে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন স্টিভেন স্মিথ। সেটা দেখে বোলার এক চিলতে হাসি দিয়ে দিব্যি হেঁটে ফিরে যাচ্ছেন। আপনার মনে পড়ে যায় সেই বডিলাইন সিরিজের কথা। ক্রিকেট এমনই, অ্যাশেজ সেখানে এক ধাপ এগিয়ে হয়ে যায় শত্রু-শত্রু খেলা।
ওদিকে অজি ড্রেসিংরুমের মাঝে এবার চাপা একটা দুশ্চিন্তার ঘন মেঘ জমেছে। সবাই ভাবতে শুরু করেছে, স্মিথের অ্যাশেজটা বোধহয় শেষ। অন্তত এই টেস্ট যে শেষ, সেটা সবাই নিশ্চিত হিসেবে ধরেই নিয়েছে। ধারাভাষ্যকক্ষ থেকেও ভেসে আসছে একই আশঙ্কা। আজীবনের লড়াকু মানসিকতা নিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্মিথ উঠে দাঁড়ান। খেলে যেতে চাইলেও এবারের মতো তাকে ফিরতে হয় সাজঘরে।
আপনাকে আরেকবার অবাক হবার উপক্রম করে দিয়ে মাঠে ফিরে আসেন স্মিথ। এবার ফিরে খেলেন অজিদের চিরাচরিত হার না মানা মানসিকতার মতোই। ৯২ রানের ইনিংসটি সংখ্যার বিচারে দুই অঙ্কের হলেও মাহাত্ম্য বিবেচনায় এই ইনিংস আরো বড় কিছু। অ্যাশেজের উপর নির্মিত অ্যামাজন প্রাইমের ডকুমেন্টারিটা আপনাকে দেখায় আউট হওয়ার পর ড্রেসিংরুমে স্মিথের অভিব্যক্তি। সেটা দেখে আপনি মোহাচ্ছন্ন হন, আবার ক্রিকেটের জগতে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন।
আমরা মাঝেমাঝে শুনে কিংবা পড়ে উপলব্ধি করি, আউটের পর ড্রেসিংরুমে গিয়ে একজন ব্যাটসম্যান কতটা হতাশা ঝাড়েন। অ্যামাজনের ডকুমেন্টারির বদৌলতে স্টিভেন স্মিথের কল্যাণে আপনি দেখেন, হতাশার মাত্রা কতটুকু ছাড়িয়ে যায়। দলের প্রতি একনিষ্ঠতা আর একাগ্রতার একটা নিদর্শন দেখা যায় সেখানে। খেলাটার প্রতি ভালোবাসা কোথায় গিয়ে ঠেকলে এরকম অভিব্যক্তি আসতে পারে, সেই প্রশ্ন তোলাটাই বাতুলতা বৈকি। ইনজুরির কারণে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামা হয়নি স্টিভেন স্মিথের। তার বদলে ইতিহাসের প্রথম ‘কনকাশন সাবস্টিটিউট’ হিসেবে ব্যাট করেন মার্নাস ল্যাবুশেন। ক্রিকেটে ‘লাইক-বাই-লাইক’ যে টার্মটা চালু হয়েছে ইদানিং, সেটার সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ বোধহয় ল্যাবুশেনের মাঠে নামার মাধ্যমেই দেখে ফেলে গোটা বিশ্ব। তবে সেটা ভিন্নদিনের গল্প।
***
হেডিংলি, লিডস – তৃতীয় টেস্ট।
কোচ-সতীর্থদের বদৌলতে এই জিনিস আর অজানা নয়, মাঠে খেলতে স্মিথ কতটা মুখিয়ে থাকেন। খেতে গেলে, ঘুমোতে গেলে, প্র্যাকটিসে সারাক্ষণ ব্যাট নিয়ে কতটা চটপট করেন স্মিথ, এই গল্পগুলো ততদিনে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই স্টিভেন স্মিথকে এবার একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটা তৃতীয় টেস্টের আগে তার ইনজুরি নিয়ে। তবে খেলা কিংবা না খেলার পুরো সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে, সে সুযোগ স্মিথের রয়েছে। উড়ন্ত ফর্ম, দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য – সব কিছু বিবেচনায় স্মিথ চাইলেই খেলতে নেমে যেতে পারেন।
হাফ-ফিট থেকেও দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়ায় স্টিভেন স্মিথের জুড়ি মেলা ভার। সেটার একটা ঝলক তো আগের ম্যাচেই দেখা গিয়েছে। কিন্তু তিনি, স্টিভ স্মিথ আসলে কী চাচ্ছেন?
দল যে তার কাছে অন্য সবকিছুর আগে, তাই নিজেকে ফিট ঘোষণার সময় মাঠের মতোই সাহসিকতার পরিচয় দেন স্মিথ। দলের স্বার্থে হাফ-ফিট নিজেকে সরিয়ে নেন হেডিংলি টেস্ট থেকে। অজিদের ছোট ছোট মুহূর্তের ভুলে বেন স্টোকসের এক মহাকাব্যিক ইনিংসে এই টেস্ট জিতে নেয় ইংলিশরা।
***
ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, ম্যানচেস্টার – চতুর্থ টেস্ট।
ইনজুরি কাটিয়ে এই টেস্টে দলে ফিরলেন স্টিভেন স্মিথ। কতটা অবিশ্বাস্য হতে পারে ফেরাটা? আপনার চিন্তার সীমা-পরিসীমা কতটা ডালপালা মেললে স্মিথ এই টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেন? যে ইংলিশ সমর্থকরা দুয়োধ্বনিতে বরণ করেছিল স্মিথকে, আজকে সেই গ্যালারি থেকে স্মিথের জন্য কড়া করতালি যেন পুরো ম্যানচেস্টার শহরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম ইনিংসে ২১১ রানের ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও ৮২ রানের মহাগুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন স্মিথ।
স্মিথ-বীরত্বে আরেকবার জয়ের উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হয় অজিরা। সেখানে বাড়তি মাত্রা যোগ হয় অ্যাশেজ শিরোপা ধরে রাখার উৎসব। এই ইংলিশ খেলোয়াড়দের দেখে কে বলবে, এই দলটাই কিছুদিন আগে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে একইরকম উল্লাসে ফেটে পড়েছিল? এই শহরে না হলেও নিজেদের দেশের ভিন্ন শহরে সেই উদযাপন হয়েছিল। স্টিভেন স্মিথ যেন সব সমীকরণ পাল্টিয়ে দেন। সব চেহারাগুলো পাল্টিয়ে দেন। সব আলোচনা-সমালোচনা থামিয়ে দেন বাইশ গজের উইলোবাজি দিয়ে। আরেকবার বার্তা দেন, লাল বলের ক্রিকেটে ব্যাগি গ্রিন মাথায় চাপিয়ে তিনি মাঠে নামেন স্রেফ রাজত্ব করার জন্য।
কোনো বৃষ্টিস্নাত আকাশের মতো ক্ষণে ক্ষণে রং পাল্টিয়েছে এই ম্যাচ। অষ্টম উইকেটে শেষ সেশনে উইকেটে দাঁড়িয়ে গেছেন ক্রেইগ ওভারটন আর জ্যাক লিচ, দু’জন মিলে খেলে ফেলেছেন ১৫ ওভার। খেলা গড়িয়েছে শেষ আধঘন্টায়। ওই মুহূর্তে জ্যাক লিচকে সিলি পয়েন্টে ম্যাথু ওয়েডের ক্যাচে পরিণত করে ৯০ বল স্থায়ী এই জুটি ভাঙেন মার্নাস ল্যাবুশেন। ইংল্যান্ডের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়ে ‘অ্যাশেজ রিটেইন’-এর শুরুর মতো শেষ দৃশ্যটা স্মিথের হাতেই মঞ্চায়ণ হোক, তাই কি না ক্রিকইনফোতে দেখাচ্ছিল,
“Give the people what they want!!! BRING ON STEVE SMITH!!!”
আপনাকে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করিয়ে সেই হ্যাজলউড লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেললেন ক্রেইগ ওভারটনকে। মর্যাদার অ্যাশেজ শিরোপা রিটেইন করার উদযাপন আর উল্লাসে ফেটে পড়ে অজিরা। স্টিভেন স্মিথের উদযাপন কি খানিকটা বেশি ঔজ্জ্বল্য ছড়ালো? ছড়ানোরই কথা। এক বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষ করে বিশ্বকাপটা মনমতো যায়নি স্মিথের। সবকিছু যেন জমিয়ে রেখেছিলেন অ্যাশেজের জন্য। সেটারই প্রতিফলন যেন এই উদযাপনে।
উদযাপনে খানিক বাঁধা সৃষ্টি করতেই কি না – সেই মুহূর্তে রিভিউ নিলেন ব্যাটসম্যান! হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে ড্রেসিরুম থেকে কাঁধে হাত রেখে সারিবদ্ধ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের মাঝে। যতই আধুনিক প্রযুক্তি আর শতশত ক্যামেরা তাক করা থাক, সেই মুহূর্তের উৎকণ্ঠার পুরোপুরি চিত্র আপনার সামনে আসে না। অ্যামাজন প্রাইমের ডকুমেন্টারির সৌজন্যে আপনি দেখছেন সেই চিত্র। শব্দগুলো আপনার কানে বাজছে ঠিক এভাবে,
C’mon….That’s out..that’s out..that’s out, please.
পরক্ষণে থার্ড আম্পায়ারের ভয়েস শোনা যাচ্ছে,
Impact in line, wickets hitting। My decision is out.
আবার বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ে অজিরা। উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে স্টিভেন স্মিথ। ক্যামেরার লেন্স বারবার খুঁজে নিচ্ছে সেই মুখাবয়ব। ষোল মাস আগের প্রেস কনফারেন্সের দৃশ্যটা এখানে বসিয়ে চিন্তা করলে আপনার কাছে নির্ঘাত ভীতিকর ঠেকবে। উদযাপনের জটলার মাঝে স্মিথের জায়গাটা সামান্য ফাঁকা, দেখে যে কারো মনে হবে স্মিথ বুঝি একা একা উদযাপনে ব্যস্ত! নাহ, এই ব্যাপারটা অন্য। স্মিথ যে ততক্ষণে নিজের অবস্থান কিঞ্চিৎ আলাদা করে নিয়েছেন। এটা বোধহয় প্রকৃতির ঠিক করে দেয়া সেরকমই কোনো কাকতাল! স্টিভেন স্মিথ কাঁদেন একা, স্টিভেন স্মিথ হাসেন, আর সেই হাসি ছড়িয়ে দেন পুরো দলের মাঝে।
***
ওভালে শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে স্মিথ করেন ৮০ রান। দ্বিতীয় এবং শেষ ইনিংসে মাত্র ২৩ রানে আউট হওয়ার মাধ্যমে স্মিথের ২০১৯ অ্যাশেজ যাত্রার সমাপ্তি ঘটে। স্মিথের অবিশ্বাস্য অ্যাশেজের স্কোরগুলো একসাথে করলে দেখা যায় – ১৪৪, ১৪২, ৯০, ২১১, ৮২, ৮০, ২৩। ঠিক কতটা অবিশ্বাস্য ছিলেন স্মিথ? দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩ রানে আউট হওয়ার পর ক্রিকইনফোর কমেন্ট্রিতে এক দর্শকের কমেন্টটা দেখে সেটা কিছুটা আঁচ করা যাবে,
“Wait. What? Smith is out before 80? Seriously? Is this a dream? I need to wake up, don’t I?”
দ্বিতীয় ইনিংসে স্টিভেন স্মিথ যখন আউট হয়ে সাজঘরে ফিরছেন, ওভালের গ্যালারি তখন স্মিথ বন্দনায় করতালিতে মুখরিত হয়ে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাচ্ছে। এই দাঁড়িয়ে সম্মান জানানোর মুহূর্তটা স্মিথ আদায় করে নিয়েছেন। নিজের জন্য, নিজের মতো করে।
অ্যাশেজের উপর নির্মিত ডকুমেন্টারিতে হার্শা ভোগলের ভাষায় সেটি হয়ে যায় এরকম,
“All those boos have turned into wow”
পুরো অ্যাশেজজুড়ে স্টিভেন স্মিথের ব্যাটিং গড় ছিল আকাশচুম্বী। ইনজুরির কারণে সিরিজে মোট তিনটি ইনিংস মিস করেন স্মিথ; বাকি থাকা সাত ইনিংসে করেন ৭৭৪ রান, যা অ্যাশেজের এক সিরিজে পঞ্চম সর্বাধিক সংগ্রহ। গড় ১১০.৫৭! গড় দেখে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের নামটা যে কারো মাথায় আসতে বাধ্য। অ্যাশেজের এক সিরিজে যে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক সেই ব্র্যাডম্যানই। রানসংখ্যা ৯৭৪, গড় ১৩৯.১৪!
আজ থেকে ২০০ বছর বাদে ইংলিশদের কোনো আসরে যদি এই অ্যাশেজ নিয়ে আলোচনা হয়, নিশ্চিতভাবেই স্মৃতির পাতার মলাট খুলতেই ইতিহাস খুঁজে নেবে স্টিভেন স্মিথকে। স্মিথের রূপকথার অ্যাশেজ স্মৃতিচারণ হবে ফিরে আসার গল্প হিসেবে। আলোচনার পরতে পরতে থাকবে উইলো দিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্যে স্টিভেন স্মিথের এক অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের গল্প। এই অ্যাশেজ এবং স্টিভেন স্মিথ আপনার জন্য জীবনের একটা চিত্র হয়ে গাইবে,
“আঘাতে মচকে যেও,
তবুও ভেঙে যেও না।”