একটি কাল্পনিক দৃশ্যের কথা ভাবা যাক। আপনার অফিসের কয়েকবছর পুরনো একজন কর্মচারি আশফাক, তাকে প্রোমোশন দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে এবং সে তার জন্যে আবেদনও করেছে। তার রেকর্ড বেশ ভালো, এমনকি পারফরম্যান্সের তালিকায় সে তার ডিপার্টমেন্টের প্রথম কয়েকজনের মধ্যে রয়েছে। তবে তার প্রথম বছরে সে একটি ভুল করেছিল, যার ফলে কোম্পানিকে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল। ভুলক্রমে কোম্পানির সার্ভার থেকে সে একটি প্রজেক্টের সবগুলো ফাইল মুছে দিয়েছিল, সবার মনে যার স্মৃতি এখনো বেশ প্রখরভাবে রয়ে গেছে। আপনার সিদ্ধান্ত কী হবে? আপনি কি তাকে প্রোমোশন দিবেন?
পরিসংখ্যান বলে, আশফাকের প্রোমোশন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, প্রথম বছরে তার ভুলের কারণে আপনাকে যে ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল, সেটির প্রগাড় স্মৃতি আপনার ভাবনায় জেঁকে বসবে। ফলে, কোম্পানিতে তার অবদান যতোটুকুই হোক না কেন তা ম্লান হয়ে যাবে। শেষে, আপনি তার পারফরম্যান্স মোটাদাগে বিবেচনা করবেন শুধুমাত্র সেই ভুলটি দিয়ে। এর পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে ‘অ্যাভেলেবিলিটি বায়াস’ নামের একটি ভ্রান্তি, যার ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ে, প্রগাড় কোনো স্মৃতির প্রভাব অন্য স্মৃতিগুলোকে ম্লান করে দেয়।
অন্যভাবে বলা যায়, যে তথ্য বা স্মৃতিগুলো আমাদের ভাবনায় সবচেয়ে দ্রুত এবং সহজে চলে আসে আমরা তার প্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। এভাবে সিদ্ধান্তটি তার নিরপেক্ষতা হারায়।
অ্যাভেলেবিলিটি বায়াস বাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঠেলে দিতে পারে, কারণ যে স্মৃতিগুলো সহজে মাথায় আসে সেগুলো বেশিরভাগ সময়েই অপর্যাপ্ত। ফলে, নিম্নমানের তথ্য প্রক্রিয়া করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, যা বেশিরভাগ সময়েই বাস্তব পৃথিবীকে অনুসরণ করে না এবং খারাপ পরিণতি বয়ে আনে।
বিভিন্নরকম অ্যাকাডেমিক ও পেশাদার ব্যাপারগুলোতেও অ্যাভেলেবিলিটি বায়াস বাজে সিদ্ধান্তের পেছনে ঠেলে দেয়। তথ্য বিশ্লেষণের সময় যদি আমরা শুধুমাত্র স্মৃতিশক্তির উপরে নির্ভর করি, তাহলে যেসব ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি সেখানে ক্ষতির মাত্রাও বাড়াবাড়ি রকমের হতে পারে। এরকম একটি জায়গা হচ্ছে অর্থনীতি। ব্যক্তিক্ষেত্রে চিন্তা করলেই দেখা যাবে, আমরা যারা বাজে খরচ কমাতে চাই, তাদের ব্যর্থতার পেছনে একটি বড় কারণ অনেকগুলো ছোট ছোট ভুল সিদ্ধান্ত যেখানে অ্যাভেলেবিলিটি বায়াস আমাদেরকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করে। তবে এটি আবার মিডিয়া ও ব্যবসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোতে ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে, কারণ বেশিরভাগ মানুষই অ্যাভেলেবিলিটি বায়াসে আক্রান্ত। মিডিয়া ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত এই বায়াসটি তাদের অনুকূলে ব্যবহারও করছে।
আমাদের মস্তিষ্ক অনেকগুলো মানসিক শর্টকাট অনুসরণ করে, যা আমাদেরকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। অ্যাভেলেবিলিটি বায়াস এভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে সহজতর করে তোলে। তবে কোনোকিছুর সম্ভাবনা বিচার করতে গেলে এটা আমাদেরকে ভুলপথে পরিচালিত করে। কারণ আমাদের স্মৃতি সত্যিকারের কোনো মডেল না, যার উপরে ভিত্তি করে আমরা ভবিষ্যতের কোনো পূর্বাভাস দিতে পারব। সত্যি বলতে, বেশিরভাগ মানুষই পরিসংখ্যানগতভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারে না। উদাহরণ দেওয়া যাক।
মনে করুন, আপনি কোনো বিমানে উঠেছেন। বিমানটির দূর্ঘটনায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা কতোটুকু বলে আপনার মনে হয়? আপনার ফ্লাইটটির নিরাপত্তা অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের উপরে নির্ভর করছে এবং মানব মস্তিষ্কে সবগুলোর হিসেব করা বেশি কঠিন। পরিসংখ্যানের উপরে কোনো প্রশিক্ষণ না থাকলে আপনার মস্তিষ্ক এই প্রশ্নের উত্তরের জন্যে ভিন্ন একটি পন্থা অবলম্বন করবে। অতীতে বিমান দূর্ঘটনার যতোগুলো ভয়াবহ সংবাদ আপনি পড়েছিলেন, সেগুলোর সাথে বিধ্বস্ত বিমানগুলোর ছবি আপনার মনে ভেসে উঠবে। কারণ এইরকম সংবাদগুলো আপনার মস্তিষ্কে একটা গভীর ছাপ রেখে যায়। এবং এর ফলেই এরকম একটি দূর্ঘটনার সম্ভাবনাকে আপনি অতিরিক্ত মূল্যায়ন করবেন। এভাবেই অ্যাভেলেবিলিটি বায়াস কাজ করে।
কিছু স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধরা দেয় এবং অন্য স্মৃতিগুলোর জন্যে বাড়তি মনোযোগ ও চেষ্টার প্রয়োজন হয়। যে স্মৃতিগুলো সহজেই ধরা দেয় তার পেছনে প্রধানত দুইটি কারণ কাজ করে, সে ঘটনাগুলো অনেক বেশি ঘটে অথবা তারা আমাদের মনে একটি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যায়।
যেসব ঘটনা অনেক বেশি ঘটে, সেগুলো সাধারণত আমাদের মস্তিষ্কের অন্যান্য শর্টকাটের সাথে কাজ করে, যার মাধ্যমে আমরা নিজেদের পৃথিবীকে বুঝার চেষ্টা করি। অ্যামোস টিভার্স্কি ও ড্যানিয়েল কাহনেম্যান, আচরণগত মনোবিজ্ঞানের দুইজন পথিকৃৎ, ১৯৭৩ সালে এই ব্যাপারে একটি গবেষণায় করেছিলেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘k’ বর্ণটি প্রথমে অবস্থান করে এমন শব্দের সংখ্যা বেশি (kitche, kangaroo, kale ইত্যাদি) নাকি তৃতীয় বর্ণ হিসেবে অবস্থান করে এমন শব্দের (ask, cake, bike ইত্যাদি) সংখ্যা বেশি? সাধারণ যেকোনো রচনায় ‘k’ তৃতীয় বর্ণ হিসেবে থাকে এমন শব্দ দ্বিগুণ সংখ্যক বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু ৭০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী উত্তর দিয়েছিল, প্রথমে ‘k’ বসে এমন শব্দের সংখ্যা বেশি। এর কারণ হচ্ছে, প্রথম বর্ণ ‘k’ এমন শব্দগুলো চিন্তা করতে বেশি সুবিধা হয়। এই শব্দগুলোই মাথায় বেশি আসে, তাই মনে হয় এদের সংখ্যাই বেশি।
যে ঘটনাগুলো আমাদের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে যায়, সেগুলো নিয়েও কাহনেম্যান ও টিভার্স্কি গবেষণা করেছেন। তাদের ১৯৮৩ সালের একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, উত্তর আমেরিকায় বিশাল ধরনের কোনো বন্যার সম্ভাবনা কতোটুকু। বাকি অর্ধেকদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ক্যালিফোর্নিয়াতে ভূমিকম্পের ফলে বিশালাকারের কোনো বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা কতোটুকু। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশে বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা পুরো উত্তর আমেরিকা মহাদেশে বন্যা হওয়ার তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমাণ কম। অংশগ্রহণকারীরা অবশ্য ভূমিকম্পের ফলে ক্যালিফোর্নিয়াতে বন্যা হওয়ার সম্ভাবনাকেই এগিয়ে রেখেছিলেন। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, ক্যালিফোর্নিয়া একটি ভূমিকম্প প্রবণ প্রদেশ। আর ভূমিকম্পের ফলে বন্যা হওয়ার ঘটনাটি বেশ সংলগ্ন, তাই উভয়ে মিলে চিন্তায় একটি প্রাণবন্ত ছবি এঁকে ফেলতে পারে। অন্যদিকে, উত্তর আমেরিকা মহাদেশটি চিন্তার জগতে বিশাল ও অনির্দিষ্ট হওয়ায় এভাবে পরিষ্কার কোনো ছবি তৈরি করা তুলনামূলক অনেক কঠিন।
আমরা প্রতিদিনই অনেকরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। যৌক্তিক চিন্তাভাবনার তুলনায় মিডিয়া, নিজেদের সংবেদনশীলতা কিংবা প্রগাড় স্মৃতিগুলো এই সিদ্ধান্তগুলোতে বেশি প্রভাব ফেলে থাকে। ভ্রান্তিগুলোর ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞান এরকম ভুল ধরনের যুক্তিপ্রয়োগের বিরুদ্ধে বেষ্টনী হিসেবে কাজ করতে পারে। আমাদের মস্তিষ্কে যে তথ্যগুলো রয়েছে, সেসব প্রক্রিয়া করতে মস্তিষ্ক যে অসংখ্য শর্টকাট ব্যবহার করে তার ফলেই অ্যাভেলেবিলিটি বায়াসের জন্ম। সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিটি ধাপে এই ভ্রান্তির ব্যাপারে মস্তিষ্ককে সচেতন করে তুলতে হবে।
কাহনেম্যান ও টিভার্স্কি আমাদের মস্তিষ্কে চিন্তাভাবনার দুইটি আলাদা পদ্ধতির কথা বর্ণনা করেছেন। কাহনেম্যানের বই ‘থিংকিং, ফ্যাস্ট অ্যান্ড স্লো’তে তিনি এই দুটোকে ‘সিস্টেম ১’ ও ‘সিস্টেম ২’ নামকরণ করেছেন। সিস্টেম ১ সিদ্ধান্ত নেয় দ্রুত এবং তার কাজ করার পদ্ধতি হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়। সাধারণ মানুষ জীবনের বেশিরভাগ সময়েই সিস্টেম ১ এর উপরে নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু চিন্তাগত ভ্রান্তিগুলো থেকে রক্ষা পেতে হলে সিস্টেম ২ প্রয়োজন। কারণ, সিস্টেম ২ সুচিন্তিত ও যৌক্তিক চিন্তা করে। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় না হওয়ায় এইভাবে চিন্তা করতে মানসিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন এবং মানুষ সাধারণভাবে একটি অলস প্রাণী। সিস্টেম ১ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে শর্টকাট খুঁজে এবং ভ্রান্তির শিকার হয়। অপরদিকে, সিস্টেম ২ দিয়ে চিন্তা করতে গেলে মানুষ বুঝতে পারে যে, তাদের দ্রুত চিন্তার যে ফল তা ভুলপ্রবণ।
তবে অ্যাভেলেবিলিটি বায়াস এড়ানোর সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল হচ্ছে ‘রেড টিমিং’। রেড টিমিং প্রক্রিয়াতে, গ্রুপ থেকে একজন সদস্যকে নির্বাচিত করা হয় বেশিরভাগের মতামতকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যে। এক্ষেত্রে নির্বাচিত ব্যক্তির ব্যক্তিগত মতামত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার কাজ থাকে সবার মতামতের ভুলটি বের করা। গুরুত্বপূর্ণ বড় সিদ্ধান্ত তৈরির সময়ে এই পদ্ধতিটি খুবই কার্যকর। আচরণগত বিজ্ঞানের ব্যাপারে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে বায়াসগুলো চিহ্নিত করা সহজ হয়। তার সাথে যুক্তিপ্রবণ কাউকে সবার সিদ্ধান্তের ভুল বের করতে দিলে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
আমাদের সাধারণ জীবনযাপনে কনজ্যুমার মার্কেট ও মিডিয়ার প্রভাব কীরকম এবং তার পেছনে অ্যাভেলেবিলিটি বায়াসের ভূমিকা নিয়ে ১৯৯৩ সালে একটি গবেষণা হয়েছিল। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক সেবনের ব্যবহার বাড়ছে নাকি কমছে সে ব্যাপারে তাদের মতামত জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তাদের বেশিরভাগেরই উত্তর ছিল, এটা বাড়ছে। কিন্তু ‘ন্যাশনাল হাউজহোল্ড সার্ভে অন ড্রাগ এবিউজে’র রিপোর্ট ভিন্ন কথা বলছিল। কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে মিডিয়াতে যদি নিয়মিত সম্প্রচার করা হয়, তাহলে সে ব্যাপারে সত্যিকারের পৃথিবীর তুলনায় ভিন্ন একটি উপলদ্ধি তৈরি হয়। যেকোনো ব্যাপারে এভাবে মানুষের জ্ঞান ও আচরণকে প্রভাবিত করা যায়। আপনি কোথা থেকে তথ্য নিচ্ছেন, তার উপরে নির্ভর করে আপনার আচরণে পক্ষপাত দেখা যাবে। আপনার কমন সেন্স বা সাধারণ বোধ সেভাবে গড়ে উঠবে। তাই, চিন্তাগত ভ্রান্তিগুলো এড়িয়ে আমাদের নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।