ধরা যাক, একজন ব্যক্তিকে কোনো একটি অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এই অপরাধীকে পাহারা দেয়ার জন্য একজন রক্ষী নিযুক্ত করা হলো। রক্ষীর কাজ হচ্ছে, যথাসময়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই অপরাধীকে তার দণ্ড কার্যকর করার স্থানে পৌঁছে দেয়া। স্বাভাবিকভাবেই, অপরাধী আর রক্ষীর মধ্যেকার সম্পর্ক হবে তিক্ত, নয়ত নির্বিকার। কিন্তু যদি রক্ষী আর অপরাধীর মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তাহলে কেমন হবে?
ঠিক এরকম একটি ঘটনাই রুশ চলচ্চিত্র ‘রোড টু বার্লিন’–এর (রুশ: Дорога на Берлин, ‘দারোগা না বের্লিন’) মূল বিষয়বস্তু। ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত অধিকাংশ রুশ চলচ্চিত্র যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের বীরত্ব ও বিজয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে এই চলচ্চিত্রটি ব্যতিক্রম। সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্র নিয়ে মানুষের ধারণায় বীরত্ব, সাহসিকতা, জয়-পরাজয় এগুলো এতটাই প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে যে, যুদ্ধক্ষেত্রে যারা অংশ নিচ্ছে, সেই সৈন্যদের মানবিক দৃষ্টিকোণটি প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়। এদিক থেকে ‘রোড টু বার্লিন’ একটি ব্যতিক্রমধর্মী চলচ্চিত্র, কারণ এই চলচ্চিত্রটির মূল উপজীব্য হচ্ছে যুদ্ধরত সৈন্যদের মানবিক দিকগুলো – তাদের ভয়, আনুগত্যবোধ, স্বপ্ন, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের বন্ধুত্ব।
১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গনে জার্মান সৈন্যরা তখনও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিতে অবস্থান করছে। ২০ বছর বয়সী রুশ লেফটেন্যান্ট সের্গেই ওগারকভ সবেমাত্র সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছে। নৃশংস এই যুদ্ধের ফলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা একজন সোভিয়েত সৈন্যের বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি চালানো এবং অন্য সোভিয়েত সৈন্যদের গুলিতে তার মৃত্যু– এরকম একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করার মধ্য দিয়ে ওগারকভের সৈনিক জীবনের সূচনা ঘটে।
ওগারকভকে ১১৪ তম ডিভিশনের সংযোগ কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়। সম্ভাব্য জার্মান আক্রমণ সম্পর্কে সোভিয়েত ৩৪১ তম ডিভিশনকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য ওগারকভকে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু পথিমধ্যে ওগারকভ জার্মান ও সোভিয়েত বাহিনীর গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যায় এবং ৩৪১ তম ডিভিশনকে সতর্কবার্তা প্রদান না করেই ফিরে আসে। এর ফলে জার্মান সৈন্যরা সোভিয়েত ডিভিশনটিকে ঘিরে ফেলে এবং সোভিয়েতরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ওগারকভ তার ব্যর্থতার জন্য সামরিক বিচারের সম্মুখীন হয়, এবং বিচারে সিনিয়র কর্মকর্তারা ওগারকভকে ‘কাপুরুষতা’ প্রদর্শনের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
ওগারকভের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য তাকে একটি বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং ওগারকভের ওপর নজর রাখার জন্য তার সমবয়সী একজন সৈনিককে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। জোরাবোয়েভ নামক এই সৈনিক একজন জাতিগত কাজাখ, যার রুশ ভাষাজ্ঞান খুবই অল্প। জোরাবোয়েভকে প্রাথমিক পর্যায়ে খুবই কঠোর ও গম্ভীর প্রকৃতির বলে মনে হয়। কিন্তু ওগারগভের সৌভাগ্যবশত তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগেই তাদেরকে জানানো হয় যে, তার দণ্ড স্থগিত করা হয়েছে এবং তার ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনার জন্য সোভিয়েত সামরিক সদর দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে যে গ্রামটিতে ওগারকভের সৈন্যদল অবস্থান করছিল, জার্মানরা সেই গ্রামটিতে আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেয়। জোরাবোয়েভ সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে তার দায়িত্ব অনুয়ায়ী ওগারকভকে পাহারা দিয়ে সেনা সদর দপ্তরে নিয়ে যাবে। সে ওগারকভকে নিয়ে গ্রামটি থেকে পালিয়ে যায়। পথিমধ্যে তারা দেখতে পায়, জার্মান সৈন্যরা সোভিয়েত যুদ্ধবন্দিদের খুন করছে। ওগারকভ এতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে জোরাবোয়েভ তাকে নিরস্ত করে এবং জার্মানদের দৃষ্টি এড়িয়ে সেখান থেকে সরে যায়।
কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলে জোরাবোয়েভ ওগারকভকে একটি কুঁড়েঘরের মধ্যে আটকে রেখে নিজে বাইরে থেকে তাকে পাহারা দেয়। এসময় ওগারকভ ঘরটিতে একটি ধারালো অস্ত্র দেখতে পেয়ে সেটি দিয়ে জোরাবোয়েভকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু দ্বিধা বোধ করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সেটি করে উঠতে পারে না।
বৃষ্টি থামার পর তারা আরো কিছুদূর অগ্রসর হয় এবং একটি ছোট ছেলের দেখা পায়। ছেলেটি তাদের একজন গুরুতরভাবে আহত বৈমানিককে দেখায়, যার বিমান জার্মানরা ভূপাতিত করেছে। জোরাবোয়েভ ও ওগারকভ বৈমানিককে তাদের সাথে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় তাদের একটি নদী পেরোতে হয়। জোরাবোয়েভ সাঁতার জানে না, তাই ওগারকভ প্রস্তাব দেয়, একটি ভেলায় করে প্রথমে আহত বৈমানিককে নদী পার করাবে, তারপর ফিরে এসে জোরাবোয়েভকে নদীর ওপারে নিয়ে যাবে। জোরাবোয়েভ ‘আসামী’ ওগারকভকে একা ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওগারকভকে বিশ্বাস করে তার প্রস্তাবে রাজি হয়।
নদী পার হওয়ার পর তারা আরেকটি সোভিয়েত ইউনিটের দেখা পায়। সেখানে আহত বৈমানিকের চিকিৎসা করা হয়, কিন্তু গ্যাংগ্রিনের কারণে তার পা কেটে ফেলা হয়েছে, এটা জানতে পেরে বৈমানিক আত্মহত্যা করে। এই পরিস্থিতিতে জোরাবোয়েভ ইউনিটটির কমান্ডারকে জানায় যে, তার দায়িত্ব অনুযায়ী তাকে ওগারকভকে বিচারের জন্য সদর দপ্তরে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু কমান্ডার জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এবং তিনি দুজনকে তার ইউনিটে থেকে যুদ্ধ করার আদেশ দেন।
এদিকে ওগারকভ দেখছিল জোরাবোয়েভের পুরনো বুটজোড়া ক্ষয়ে গেছে, এজন্য সে জোরাবোয়েভের অজান্তে নিজের প্রিয় ঘড়ির বিনিময়ে তার জন্য একজোড়া বুটজুতো সংগ্রহ করে। ক্রমশ ওগারকভ ও জোরাবোয়েভের মধ্যে এক ধরনের সখ্য গড়ে ওঠে। ইতোমধ্যে জার্মানদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন জার্মান স্নাইপারের জন্য সোভিয়েতরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছিল। ওগারকভ নিজেকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে ঐ জার্মান স্নাইপারের অবস্থান ফাঁস করে দেয়, আর জোরাবোয়েভ স্নাইপারকে খুন করে।
যুদ্ধ শেষে এই বীরত্বের জন্য তাদেরকে পুরস্কার দেয়ার আলোচনা চলে। কিন্তু জোরাবোয়েভ ওগারকভকে জানায় যে, তাকে তার বিচারের জন্য সেনা সদর দপ্তরে প্রেরণের সময় হয়েছে!
এভাবেই এগিয়ে চলে ‘রোড টু বার্লিনে’র ঘটনাচক্র। ওগারকভ এবং জোরাবোয়েভ উভয়েই দায়িত্বশীল, আর এই দায়িত্বশীলতাই তাদেরকে পরস্পরের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু তাদের উভয়ের লক্ষ্যই এক – সেটা হলো বার্লিন। বস্তুত ওগারকভের সাহসিকতা, জোরাবোয়েভের নিয়মতান্ত্রিকতা, এসব কিছুরই চূড়ান্ত লক্ষ্য একটাই – জার্মান হানাদারদের হারিয়ে তাদেরকে বার্লিনে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু বার্লিনের পথ কণ্টকাকীর্ণ, তাই ভাগ্যের বিধান এই যে, দুই বন্ধু একসাথে বার্লিনে পৌঁছাতে পারবে না, দুজনের কোনো একজনের যাত্রা তার আগেই চির সমাপ্ত হবে…
রুশ চলচ্চিত্রকার সের্গেই পোপোভ কর্তৃক পরিচালিত ১ ঘণ্টা ২২ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি ২০১৫ সালে মসফিল্ম থেকে মুক্তি লাভ করে। রুশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং রুশ সামরিক–ঐতিহাসিক সভার সহায়তায় নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি মূলত ১৯৬২ সালে নির্মিত একই নামের চলচ্চিত্রের পুনর্নির্মাণ। চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে এমানুয়েল কাজাকেভিচ কর্তৃক লিখিত ‘স্তেপে দুজন’ গল্প এবং কনস্তান্তিন সিমোনভের যুদ্ধকালীন ডায়েরিতে বর্ণিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কাজাকেভিচ ছিলেন একজন প্রখ্যাত সোভিয়েত ইহুদি লেখক, কবি ও অনুবাদক। অনুরূপভাবে, সিমোনভও ছিলেন একজন খ্যাতিমান লেখক ও কবি, এবং তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
‘রোড টু বার্লিন’ চলচ্চিত্রে লেফটেন্যান্ট সের্গেই ওগারকভের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুশ অভিনেতা ইউরি বোরিসভ। আর সৈনিক জোরাবোয়েভের চরিত্রে অভিনয় করেছেন কাজাখ অভিনেতা আমির আব্দিকালভ। চলচ্চিত্রটিতে একজন রুশ ও একজন কাজাখ সৈন্যের যে বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে, সেটির রাজনৈতিক তাৎপর্য ভুলে গেলে অবশ্য চলবে না। রাশিয়া ও কাজাখস্তান উভয়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, এবং বর্তমানেও রাশিয়া ও কাজাখস্তানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। সোভিয়েত শাসনামলে রুশ–কাজাখ ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কয়েক দশক পরেও ‘রোড টু বার্লিন’ চলচ্চিত্রে সেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এক্ষেত্রে কাজাখস্তানে প্রভাব বিস্তারের জন্য চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায় কি?