![](https://assets.roar.media/assets/ltRt9RV8QfeThTuZ_Pari5__1619952131_203.190.13.210.jpg?w=1200)
মেঘমেদুর বর্ষণমুখর এক দিনের কথা। বিরামহীন বারিবর্ষণে ক্ষীণ হয়ে এসেছে গ্রীষ্মের তীব্রতা, প্রকৃতিকে আচ্ছাদন করেছে একরাশ শান্তিপূর্ণ সজল স্নিগ্ধতা। গুমোট সে আবহাওয়া ঠেলে পিচঢালা রাস্তা দিয়ে আপন গতিতে ছুটে চলেছে লালরঙা এক প্রাইভেট কার, তাতে বসা তিনজন যাত্রী। বয়স্ক দু’জনকে দেখে ঠাহর করা গেল, এরা চশমা পরিহিত ভদ্রলোক অর্ণবের বাবা-মা; এবং তাকে তারা ‘বাবাই’ বলে সম্বোধন করছেন। মূলত বাবাই ওরফে অর্ণব তার বাবা-মায়ের সাথে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়েছিল, আর গাড়ির মধ্যে সকল কথাবার্তা চলছে মেয়ে দেখা নিয়েই।
আবহসঙ্গীত হিসেবে পর্দার অন্তরালে বেজে যাওয়া লালনের ‘লোকে বলে’ যেন ঠাণ্ডা প্রকৃতিতে সমন্বয় সাধনের সুর বেঁধে দিয়েছে। হঠাৎই আকাশ থেকে কালো একটা বস্তু গাড়ির সামনের কাচে ধুম করে পড়ল। অতর্কিত ও অপ্রত্যাশিত বিকট এ শব্দের ভয়ে প্রাণ ফেটে যাওয়ার উপক্রম। আচমকা ব্রেক কষলেন অর্ণব। অঝোর বৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরিয়ে এলেন গাড়ির দরজা খুলে, এগিয়ে গেলেন কালো রঙের বস্তুটার দিকে। গিয়ে দেখলেন, সেটা কোনো বস্তু নয়, রক্ত-মাংসের গড়া এক মানুষ মরে পড়ে আছে!
![](https://assets.roar.media/assets/UOsu5WPlowpkOt9L_Screenshot_20210427_204715__1619952162_203.190.13.210.jpg)
ঝামেলা এড়াতে, এক মুহূর্ত দেরি না করে তারা দ্বারস্থ হলেন স্থানীয় পুলিশ অফিসে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ স্থানীয়দের বিবৃতি নেবার পর বোঝা গেল, এ লাশ আজব কিসিমের এক নারীর। যার সম্পর্কে তারা টুকিটাকি জানলেও, নামটা অজানা। একজন স্থানীয়ের বিবৃতিতে আরও পরিষ্কার হওয়া গেল, অনেক কুকুর পোষার দরুন এলাকার লোকজন তাকে ‘কুত্তেওয়ালী’ বলে ডাকত। সেই নারী আচরণ-আচরণে ভারি উদ্ভট, কারও সাথে কোনো সময় কথা বলত না। পুলিশ তার বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে লোকজন জানায়, সামনের একটা ডোবা আছে, ডোবার পেছনে জঙ্গল। সে জঙ্গলের পেছনেই তার বসত-ভিটা।
পুলিশ বাহিনী ও দিশেহারা অর্ণব একগুচ্ছ ভয় বুকে চেপে, ডোবা-জঙ্গল পেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগোতে থাকে ভারি সতর্কতার সাথে। হঠাৎ দেখা মেলে জীর্ণশীর্ণ এক কুটিরের, যেখানে ঘেউ ঘেউ করা কয়েকটা কুকুর ওখানকার পরিবেশ গরম করে ফেলেছে। সেই কুটির থেকেই সিনেমা তার মূল কাহিনীতে মোড় নেয়। একের পর এক উপহার দেয়, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাওয়া হিমশীতল ভয়ের অনুভূতি।
![](https://assets.roar.media/assets/JesZO78L9pcMNTEE_20210428191508__1619951830_203.190.13.210.jpg)
বলিউড গতানুগতিকভাবে বিভিন্ন জনরার সিনেমা নির্মাণে মুন্সিয়ানা দেখিয়ে এলেও, হরর ঘরানার ছবিতে তেমন ভিন্নতার স্বাদ পাওয়া যেত না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই মাপের কাহিনী, পুরোটা জুড়ে যৌনতা ও অশ্লীলতা, খাপছাড়া গল্প, বাজে পরিচালনা ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত বলিউডের হরর জনরা হাতেগোনা কয়েকটা সিনেমা বাদে মনে রাখার মতো কিছু উপহার দিতে পারেনি। প্রায় সময়ই হরর সিনেমার মোড়কে উপহার দেয়া হয়েছে বস্তাপচা কন্টেন্ট, যা নিয়ে সমালোচনার কোনো অন্ত ছিল না।
২০১৮ সালে মুক্তি প্রাপ্ত দুই সিনেমা ‘পরী’ ও ‘তুম্বাড়’ একশো আশি ডিগ্রি পাল্টে দিয়েছিল বলিউডের হরর ঘরানার চিরাচরিত চিত্রপট। পরী সিনেমার টিজার বের হবার পরই অনেকে আন্দাজ করতে পেরেছিল, এ ছবির গল্প অতিপ্রাকৃত রূপকথার আদলে আর দশটা হরর মুভির মতো সাজানো নয়। নতুন কিছু আসতে যাচ্ছে, নতুনত্বের স্বাদ পেতে যাচ্ছে সিনেপ্রেমীরা।
![](https://assets.roar.media/assets/8hkfxEGFHd30ZFsC_pari-poster-2.jpg)
আনুশকা শর্মা সবে তার ভাই কার্নেশ শর্মাকে সাথে নিয়ে ‘ক্লিন স্লেট ফ্লিমজ’ নামক এক ফিল্ম প্রোডাকশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি দাঁড় করিয়েছেন। সর্বপ্রথম ‘এন এইচ টেন’ নামক এক ক্রাইম থ্রিলার মুক্তি দেবার পর, তারা প্রোডাকশনের দ্বিতীয় সিনেমা হিসেবে ফ্যান্টাসি কমেডি ফিল্ম ‘ফিল্লাউরি’ উপহার দেন। সে সিনেমায় আনশাই লালের পাশাপাশি সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বাঙালি পরিচালক প্রসিত রায়। সহকারী পরিচালক হিসেবে প্রসিত রায়ের অভিষেক ঘটেছিল ‘জানে তু ইয়া জানে না’ সিনেমায়।
তখন ছিল ২০০৮ সাল। এরপর নিজেকে একটু একটু করে গড়ে তুলছিলেন প্রসিত। এগিয়েছেন অল্প করে, কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে। কারণ সামনে অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। নিরলস পরিশ্রমী এই বাঙালির উপর ভরসা রেখেছিলেন আনুশকা। নিজ প্রোডাকশন হাউজের তৃতীয় সিনেমা ‘পরী’তে পরিচালক হিসেবে প্রসিত রায়কে নেবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ফলে পুরো সিনেমা টেনে নেবার গুরুভার পড়ে যায় প্রসিতের ঘাড়ে। ‘পরী’র মাধ্যমেই তিনি আসীন হন মূল পরিচালনার মসনদে।
প্রথম সিনেমা হিসেবে এখানে কলকাতার এই ছেলের পরিচালনার মুন্সিয়ানা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য দাবিদার। প্রথম ছবিতে গতানুগতিকতাকে ভাঙার চেষ্টাটুকুর জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য প্রসিতের। অভিষেক ব্যানার্জিকে সাথে নিয়ে গেঁথেছেন গল্পমালা, সেটা একটু একটু করে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বচ্ছতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন সেলুলয়েড ফিতায়। পুরো সিনেমায় একটা থমথমে আবহাওয়া বজায় ছিল, যা হরর সিনেমার মূল উপজীব্য।
আর এই উপজীব্যের কাঁধে ভর দিয়েই এগিয়ে গেছে জিষ্ণু ভট্টাচার্যের বোনা চিত্রনাট্য। কখনো লাশবহুল মর্গের গা ছমছমে আবহমণ্ডল, কখনোবা পুরনো কলকাতার হালচাল- সবকিছুতে যেন নিখুঁত শৈলী ও মননশীলতার স্পষ্ট ছাপ। বৃষ্টিস্নাত স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের সাথে আলো-আঁধারির দুরূহ লুকোচুরি খেলা দর্শক মনোযোগ হরণ করতে বাধ্য। নিজের শহরকে ‘সেকেলে কলকাতা’য় সাজানোর এক নতুন সুযোগ দেয়া হয়েছিল প্রসিত রায়কে। তাই, একে একে মজুদ করেছেন শিল্পীসত্ত্বার সকল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
রূপালি পর্দায় তিনি উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন অন্য রূপের এক কলকাতাকে, যেখানে পুরাতনের সাথে তাল মিলিয়ে বিষণ্ণতা ছুটে যায় সমান্তরালভাবে। যেখানে বিমর্ষতাপূর্ণ বৃষ্টিস্নাত বিকেলে ঘটে যায় এক অপ্রার্থিত দুর্ঘটনা। ঘটনার আঙ্গিকে পরিচালক তুলে আনেন রুখসানাকে, বদলে দেন অর্ণবের সাধারণ জীবন।
আগরবাতির গন্ধে জবুথবু হয়ে পড়া ভীতু রুখসানা, আজানের সময় এলে বালতিতে মুখ ডোবানো, প্রফেসর আর কালাপরীর পরস্পর স্ফীত-স্বরে মন্ত্র বিনিময়, বা বাথরুমে গুড়ুম গুড়ুম শ্বাসের ভয়াল শব্দের শটগুলো নিয়ে পরিচালকের মহিমাকীর্তন করলে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। পরিচালক এ সিনেমায় বাস্তব কাহিনী (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ) তুলে ধরার পাশাপাশি, লোকাচারবিদ্যা ও পৌরাণিক আখ্যানের আশ্রয় নিয়েছেন। তুলে ধরেছেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। অনেক জিনিসকে উপস্থাপন করা হয়েছে রূপকের আভাসে, যা ভালোভাবে খেয়াল করলে আঁচ পাওয়া যায়, সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে।
![](https://assets.roar.media/assets/boxO2uJ9hNnWxfhD_79817952.jpg)
অভিনয়ের দিক থেকে সকল অগ্নিপরীক্ষাতেই সহজে উতরে গেছে ‘পরী’। কুশীলবদের অভিনয় দক্ষতা ও নিজেদের সর্বোচ্চটা ঢেলে দেবার ক্ষমতা সিনেমার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক, যার তারিফ করা যায় বিনা সংকোচে। অর্ণব, রুখসানা, পিয়লি, কাসিম আলী- কেন্দ্রীয় এই চার চরিত্রে চতুর্ভুজের চার বাহুর মতো কাহিনী এপাশ থেকে ওপাশে ক্রমশ ঘুরপাক খেয়েছে। পরোপকারী, ভীরু, ও শহুরে অর্ণব চরিত্রটি চিত্রায়ন করেছেন বর্তমান টালিউড হার্টথ্রব পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। একরাশ প্রতিভার সমুজ্জ্বল বিচ্ছুরণে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে আলোকিত করে আসা প্রতিভাবান এই মানুষটি প্রতিবারই অভিনয়গুণে নতুন করে মহিমান্বিত হন। এ সিনেমাতেও তিনি সাবলীল ভঙ্গিমায় অভিনয় করে গেছেন। বরাবরের মতোই উপহার দিয়েছেন সেই চিরচেনা পরমব্রতকে।
কলকাতার এক দৈনিক পত্রিকায় কাজ করা অর্ণব চরিত্রটি ছিল অতি সাধারণ গোছের। নিজ অন্তর্মুখিতাকে পুঁজি করে, নিজের মধ্যেই মিশে থাকতে পছন্দ করেন। যাতায়াত বলতে, কর্মস্থল থেকে ভাড়া করা বাড়ি- এটুকুতেই সীমাবদ্ধ। প্রসিত রয় পরমব্রতকে বলেছিলেন, চরিত্রের রঙে নিজের মনকে রাঙিয়ে নিতে হবে, গা ভাসিয়ে দিতে অভিনয় সাগরে। লক্ষ্মী ছেলের মতো অভিনয়পটু মানুষটি প্রতিটা নির্দেশ পালন করলেন অক্ষরে অক্ষরে। ভয়ের সময় থেমে থেমে বুলি আওড়ানো, হিন্দি ভাষাকে ভীষণভাবে নিজের সাথে মানিয়ে নেওয়া, কিংবা রক্তমাখা কাপড় নিয়ে বাড়িতে নিঃসাড় হয়ে আসা- সবকিছুতেই ছিলেন নিখুঁত। এর আগে অবশ্য বলিউডের ‘কাহানি’ (২০১২) সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি, সেজন্য ভাষা নিয়ে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি।
![](https://assets.roar.media/assets/HA9NIncgQR4v4Qpn_Tamil-Scraps__1619952181_203.190.13.210.jpg)
‘যব হ্যারি মেট সেজাল’ সিনেমায় প্রাণবন্ত, চঞ্চল ও উচ্ছল আনুশকা শর্মা ‘পরী’তে হাজির হয়েছেন একেবারে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের পসরা সাজিয়ে। নিজেকে পুরোপুরি ভাঙলেন, চঞ্চলতার খোলস ভেঙে দর্শকদের উপহার দিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত ও প্রতিশোধ-পরায়ণ চরিত্র হিসেবে। ক্রিকেটার ভিরাট কোহলির সাথে বিয়ের হবার পর এটাই তার প্রথম সিনেমা।
![](https://assets.roar.media/assets/asFl9vLkTHh1liyt_Pari-1__1619952116_203.190.13.210.jpg)
বিয়ের পিঁড়িতে যে পরীকে সাত পাঁকে বেঁধেছিলেন স্বামী, সে পরীই ভিন্ন পরী হয়ে ফিরেছেন সিনে জগতে, সম্পূর্ণ নতুন রূপে। কারণ, তিনি জানতেন দর্শকদের প্রমিজিং কিছু উপহার দিতে হলে ঝেড়ে ফেলতে হবে সকল গ্ল্যামার। সিনেমাকে প্রাণবন্ত করায় তাঁ অভিনয়ের কোনো জুড়ি ছিল না। এ সিনেমার প্রাণ ছিলেন তিনি এবং সেদিক থেকে তিনি পুরোপুরি সফল। কখনও ভীরু, কখনোবা ভয়ঙ্কর হিংস্র। সব্যসাচীর মতো এক চরিত্রে দ্বৈতভাব ফুটিয়ে তোলাটা ছিল তার মসৃণ অভিনয়ের যথার্থ প্রতিফলন। পরমব্রতের সঙ্গে ধ্রুপদী রসায়নও ছিল চমৎকার।
![](https://assets.roar.media/assets/AwEyc42l02swtOT7_Pari1__1619952101_203.190.13.210.jpg)
চন্দ্রবদনা ঋতাভরী চক্রবর্তীকে নিয়ে যেন কিছু না বললেই নয়। তার দীপ্তিময় বর্ণিলতা পুরো সিনেমার প্রতি আলাদা একটা মোহময় আকর্ষণ তৈরি করে রাখে। স্নিগ্ধোজ্জ্বল চাহনি বিশেষ ভাবাবেগ সৃষ্টিতে অনুকূল আবহ তৈরি করে। তিনিও বাঙালি এবং হিন্দি ভাষাটাকে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন একদম স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মেধা ও লাবণ্যে ঋতাভরী ছাড়িয়ে গেছেন আগের সকল চরিত্রকে।
![](https://assets.roar.media/assets/HNURHIgUuhfUiNuS_nwdn_file_temp_1619616932661__1619952036_203.190.13.210.jpg)
কাশিম আলীর ভূমিকায় রজত কাপুরও মানানসই। মেকআপের আদলে তৈরি হওয়া রজত কাপুরকে স্বভাবসিদ্ধ একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কখন, কীভাবে, কী করতে হবে- তা এই অভিনেতার আগে থেকেই জানা। তাই চরিত্র অলংকরণে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি তাকে। মর্গের দায়িত্বে থাকা দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য সাহো চরিত্রটাকে এমনভাবে প্রকাশ করেছেন, যেন চরিত্রটা তার জন্যই। বাদবাকি সবাই তাদের জায়গায় ছিলেন ঠিকঠাক।
![](https://assets.roar.media/assets/s4NTu2GimE7yQ3ut_nwdn_file_temp_1619617197884__1619952066_203.190.13.210.jpg)
অনভিতা দত্তের বোনা গীতিকাব্যে প্রাণ জুড়েছেন অনুপম রায়। সিনেমায় ঈশান মিত্রের গলায় ‘মেরি খামোশি হ্যায়’, আর রেখা ভারদ্বাজের ‘সো জা সো জা’; এই দু’টি গানই জি মিউজিক কোম্পানির লেবেল থেকে উঠে এসেছে। আবহসঙ্গীত সামলেছেন বিখ্যাত ফিল্ম স্কোর কম্পোজার কেতন সুধা। এক্ষেত্রে তিনি একপ্রকার বাজিমাত করে দিয়েছেন। হরর সিনেমায় আকর্ষণ ধরে রাখতে হলে, আবহসঙ্গীত হওয়া চাই দুর্দান্ত গোছের, যার সারাটা জুড়ে থাকবে গা ছমছমে অভিশঙ্কার ভাব। পুরোটা সময় ধরে মাতিয়ে রেখেছেন কেতন সুধা। মাঝে-মধ্যে কিছু গ্লিচ, জাম্প স্কেয়ার ও হরর এলিমেন্ট আবহের সাথে এমন খাপ গেয়ে গেছে, যার ফলে মস্তিষ্ককোণে তৈরি হয়েছে অজানা এক শঙ্কা।
হরর সিনেমায় আধিভৌতিক জিনিসগুলো বাস্তবতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যত বেশি ফুটিয়ে তোলা যায়, দর্শক সিনেমায় একাত্মতা প্রকাশ করতে পারে তত বেশি। সেদিক বিবেচনা করলে, সাজসজ্জার আয়োজন নিখুঁত হওয়াটা অতীব জরুরি। দর্শক ভূত দেখল, অথচ মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের স্রোত নামলো না, তাহলে অর্থ ও সময় ঢালা দুটোই ব্যর্থ। সিনেমার কলাকুশলীদের প্রত্যেকের মেকআপ ছিল সমালোচনার অতীত, সর্বতোভাবে প্রশংসনীয় ও সম্পূর্ণরূপে সন্তোষজনক। হোক সেই রক্তমাখা রুখসানার প্রতিকৃতি, প্রেতবৎ কালাপরী, লাশঘরের ছন্নছাড়া পেটুক প্রহরী- সবকিছুই ছিল জীবন্ত। কালাপরী অকপটে পেত্নীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, রক্ত-বিবর্ণ রুখসানা বুঝিয়ে দেয় সহ্য করা অত্যাচার।
![](https://assets.roar.media/assets/IVfgl8BTW2TiZhD2_nwdn_file_temp_1619538981892__1619951941_203.190.13.210.jpg)
দর্শকমহলে পরী সিনেমা বহুল প্রশংসা কুড়ালেও, ভারতে সমালোচকদের বেশিরভাগই আড়চোখে দেখেছেন এই সিনেমাকে। তাদের মতে, প্রথমার্ধে সৃষ্টি হওয়া টানটান ভাব খানিকটা নেতিয়ে পড়ে ছবির দ্বিতীয়ার্ধে। কাসিম আলীর সাঙ্গোপাঙ্গোর কার্যকলাপ ও ছেলেবেলায় রুখসানার সাথে তাদের মোলাকাতের বিষয়টা পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা দরকার ছিল। তাহলে সিনেমার ভৌতিক আবহ দর্শকদের আরও বেশি গ্রাস করতে পারত। দ্বিতীয়ার্ধে এসে চিত্রনাট্যও হয়ে যায় ধীরগতির, ফলে মন্থর হয়ে যায় সিনেমার ঋতি। শেষদিকে এসে স্পষ্ট তাড়াহুড়োর চাপ লক্ষ করা যায়। হয়তো পরী সিনেমা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে হয়ে উঠতে পারত অনন্যসাধারণ, কিন্তু এই কয়েকটা ভেজালের ফাঁদে পড়েই তা সমালোচনার খোলস ভেঙে বের হতে পারেনি।
অলাতচক্র, ইফরিত ও বাংলাদেশ
স্পয়লার অ্যালার্ট!
হরর মুভির একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, এর কাহিনী রচনা করা হয় একটা নির্দিষ্ট ধর্মের মিথোলজিকে কেন্দ্র করে। সেজন্য হলিউডে সেসব হরর ফ্লিকই বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে, যা ইহুদি-খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন- খ্রিস্টান স্যাটানিজম, ভুডু, উইচক্র্যাফট, ব্ল্যাক ম্যাজিক ইত্যাদি ইত্যাদি। এতদিন ইসলামিক মিথোলজি ভিত্তিক সিনেমাগুলো উপহার দিয়েছে এসেছে টার্কিশরা; ‘সিক্কিন’, ‘ডাব্বে’ ইত্যাদি সিনেমার মাধ্যমে। বলিউড সে স্রোতে গা ভাসাল ‘পরী’র মধ্য দিয়ে। কারণ, এ সিনেমার গল্প গড়ে উঠেছে ইফরিত নামক একপ্রকার মন্দ জ্বিন ও তার অনুসারীদের কেন্দ্র করে।
সিনেমার কাহিনীর ধারা অনুযায়ী বর্ণনা করলে,
১৯৯০ সালে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা ও এর আশেপাশের অঞ্চল থেকে আচমকা নিখোঁজ হয়ে যেতে শুরু করে যুবতী নারীরা। অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, ইফরিত নামক এক ভয়ংকর ও শক্তিশালী জ্বিনের অনুসারীরা সেই যুবতী মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে গেছে। ইফরিতের অনন্য, অন্যতম, ও অবাক করা বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষের সাথে যৌন মিলনের এদের পূর্ণ সক্ষমতা রয়েছে। শয়তানকে সকল ক্ষমতার উৎস হিসেবে বিবেচনা ও তার পূজা করাকেই সহজ ভাষায় স্যাটানিজম বলা হয়।
জনসম্মুখে ও প্রকাশ্যে এর চর্চা করা প্রায় সকল ধর্ম এবং সমাজেই নিষিদ্ধ। তাই, শয়তানের উপাসনা করতে হয় অত্যন্ত গোপনে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। এমন একটি শয়তান (ইফরিত জ্বিন) উপাসনা সংগঠনের নাম হলো ‘অলাতচক্র’। ইফরিতের অনুসারীরা ভূত-শাস্ত্রীয় আচার-পালনের মাধ্যমে, যুবতী নারীদের সাথে ইফরিতের মিলনের ব্যবস্থা করে দেয়। উদ্দেশ্য, মানব সমাজে ইফরিতের বংশধর ও অনুসারী বিস্তার করা।
সাধারণ মানুষ ন’মাসের মাথায় জন্মগ্রহণ করলেও ইফরিতের সন্তান জন্ম নিতে সময় নেয় একমাস। যুবতীর গর্ভে ২৯ দিনেই বেড়ে উঠে ইফরিতের ঔরসজাত ওই সন্তান। সে জন্ম নেয় কোনোপ্রকার ন্যাভাল কর্ড বা নাভিরজ্জু ছাড়াই। অর্থাৎ, নাভি মায়ের অমরার সাথে যুক্ত না থাকায় সে মায়ের থেকে কোনো পুষ্টি গ্রহণ করেনি। শুধু মায়ের পেটকে একমাসের জন্য একটা থলে হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু সন্তানটাকে হৃষ্টপুষ্ট করে বড় করেছে তুলেছে, স্বয়ং ইফরিত জ্বিন।
![](https://assets.roar.media/assets/qk65v9buVdLCSAex_nwdn_file_temp_1619617118344__1619952054_203.190.13.210.jpg)
বাচ্চা জন্মানোর পর ওই যুবতীকে মেরে ফেলা হয়। আর বাচ্চাকে বড় করা হয় দুনিয়াতে মানবকূলে ইফরিতের বংশবিস্তারের উদ্দেশ্যে। তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে শুধুমাত্র কালাপরী নামক এক প্রকার অশুভ ডাইনি। ইফরিতের রক্ত প্রচণ্ড বিষাক্ত হওয়ায়, তাদের সন্তানের রক্তেও সে বিষ বাহিত হয়। প্রাণঘাতী সে বিষ যদি ইফরিত সন্তান ২৮ দিনের মধ্যে নিজের শরীর থেকে খালাস না করতে পারে, তবে বিষের প্রভাবে সন্তান নিজেই মৃত্যুবরণ করবে। এই ইফরিতকে দেখার সাধ্য সাধারণ মানুষের নেই। শুধু এর শব্দ এবং নিঃশ্বাস আঁচ করা যায়।
একসময় ফাঁস হয়ে যায় অলাতচক্রের সেই গোপনীয় ও বর্বরোচিত আখ্যানের কথা। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর ড. কাসিম আলী, ইফরিতের অনুসারী ও বংশধরদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে ‘কেয়ামত আন্দোলন’ নামে এক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। জনসমর্থনকে পুঁজি করে প্রথমদিকে এই আন্দোলন নিজ গতিতে অগ্রসর হতে থাকলেও, প্রফেসরের অধিকাংশ কর্মকাণ্ডই ছিল ভয়ানক ও চরমপন্থী। তাই সরকারের পক্ষ থেকে এ আন্দোলনের উপর আসে নিষেধাজ্ঞা, নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এর সকল কার্যক্রম। কিন্তু হাল ছাড়েননি প্রফেসর, গোপনে চালিয়ে যেতে থাকেন ইফরিত জ্বিনের বংশধর দমনের কাজ। এ কাহিনীর উপর ভিত্তি করে কাসিম আলী ‘দ্য ইভিল চাইল্ড’ নামে একটি বই লিখেছেন, যা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেই ইফরিত সম্পর্কে জানতে পারেন অর্ণব।
![](https://assets.roar.media/assets/RIRmUsyQ6Zv9HatX_nwdn_file_temp_1619617275945__1619952085_203.190.13.210.jpg)
ইফরিতের কাহিনী তুলে ধরতে গল্পলেখক পুরোপুরি ইসলামিক মিথোলজির আশ্রয় নেননি, খানিকটা নিজ মনের মাধুরীও মিশিয়েছেন। কারণ, সাতক্ষীরার এ কাহিনী, অলাতচক্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কাসিম আলী, সবই লেখকের কল্পনাপ্রসূত। এর বাস্তবিক কোনো ভিত্তি নেই। তবে সাতক্ষীরার কলারোয়া, শ্যামনগর, দেবহাটা বা সুন্দরবন সংলগ্ন ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে এ রকম একটা ঘটনা নব্বই দশকের দিকে বেশ সাড়া ফেলেছিল। গ্রামের মানুষ রহস্য ও গুজবকে মুখরোচক গল্প হিসেবে পরিবেশন বেশ পছন্দ করে। দু-চারজন যুবতী হয়তো কোনো কারণে নিখোঁজ হয়েছিল, এর সাথে ইফরিত বা অলাতচক্র মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে জবরদস্ত কল্পকাহিনী। এখনও ওসব এলাকার মধ্যবয়স্ক মানুষেরা এ ঘটনাকে সত্যি বলেই ধারণা করে থাকেন।
![](https://assets.roar.media/assets/uJqyd5SLocha6VVs_20210427143734__1619951786_203.190.13.210.jpg)
স্যাটানিজম ভিত্তিক সিনেমা তুরস্কে প্রায়ই নির্মিত হয়ে দেখা যায়। খারাপ জ্বিন, কালো জাদু, বান মারা, জাদুটোনা ইত্যাদি নিয়েই তাদের বেশিরভাগ হরর সিনেমার প্লট নির্মিত। যারা ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত টার্কিশ হরর সিনেমা ‘ম্যাজাই’ দেখেছে, তারা ‘পরী’ সিনেমার প্লট আর ইতিহাসের সাথে অনেকটা মেলাতে পারবে।
![](https://assets.roar.media/assets/5nl8G53DCVx7mA7H_Wikimedia__1619952237_203.190.13.210.jpg)
![](https://assets.roar.media/assets/MPTv6rzxBh2bGXAM_masala.com__1619951916_203.190.13.210.jpg)
দ্বিতীয়ার্ধের ধীরগতির চিত্রনাট্য ও ছোটখাটো কিছু ভুলের কথা বাদ দিলে সিনেমাটি বেশ উপভোগ্য। বিশেষ করে, বলিউডের হরর ঘরানায় এ সিনেমা এনে দিয়েছে এক বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ। এই স্রোতে এগিয়ে চললে বলিউড থেকে সেরা হরর কন্টেন্ট পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। প্রাকৃত-অতিপ্রাকৃতে ছুটে চলা এ ছায়াছবির গল্প অশুভকে হারিয়ে জয়গান গায় শুভশক্তির, সব ছাপিয়ে হয়ে উঠতে চায় স্বাভাবিক জীবনের এক অস্বাভাবিক গল্প। সাথে যুক্ত হয় মিষ্টি প্রেমের গল্পের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলা হাড় হিম করা ভূতের ভয়। প্রচুর রক্ত, হঠাৎ চিৎকার, নিষিদ্ধ তন্ত্রমন্ত্রের বেড়াজাল পেরিয়ে বলিউডের গতানুগতিক সিনেমার ধারণাকে ভেঙে দিতে চায় পরী। সিনেমা শেষে একটা প্রশ্ন রেখে যায় এই সিনেমা,
“আসল রাক্ষস কে?”