মনে করুন, আপনি আবিষ্কার করতে চাইলেন একটি ব্যথানাশক ওষুধ। গবেষণা শেষে দেখলেন, আপনি যা আবিষ্কার করলেন তার ব্যথানাশক কোনো গুণ নেই। কিন্তু ওষুধটি জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যাবে। এটিই হলো সেরেন্ডিপিটি। ঘটনাক্রমে কোনো কিছু আবিষ্কার করাকে সেরেন্ডিপিটি বলা হয়। অনেক জীবন রক্ষাকারী ওষুধ রয়েছে যা বিজ্ঞানীরা গবেষণার সময় ঘটনাক্রমে আবিষ্কার করেন। চলুন, এসব জীবন রক্ষাকারী ওষুধ সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
পেনিসিলিন
১৯২৮ সাল, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে অগণিত মানুষ জীবন হারায়, যা স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত। ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য দায়ী জীবাণু স্ট্যাফাইলোকক্কাস। সেন্ট ম্যারিস হাসপাতালের পরীক্ষাগারে ফ্লেমিং পেট্রি ডিশে থাকা স্ট্যাফাইলোকক্কাস জীবাণু নিয়ে গবেষণা করছিলেন। কাজ শেষে অনিচ্ছাকৃতভাবে জানালার ধারে পেট্রি ডিশ রেখে যান তিনি।
এক মাস ছুটি শেষে যখন কাজে ফিরলেন তখন ফ্লেমিং দেখলেন স্ট্যাফাইলোকক্কাস ব্যাক্টেরিয়ার পেট্রি ডিশে মোল্ড জন্মেছে। যেসব জায়গায় মোল্ড জন্মেছে সেসব জায়গায় স্ট্যাফাইলোকক্কাস ব্যাক্টেরিয়া জন্মায়নি। তিনি বুঝতে পারলেন যে, মোল্ডে এমন একটি পদার্থ রয়েছে যা ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধিকে রোধ করতে পারে। এই মোল্ডটি ছিল পেনিসিলিয়াম নোটেটাম। ফ্লেমিং ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধি রোধকারী পদার্থটির নাম তিনি দেন পেনিসিলিন।
যুগান্তকারী অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্য আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ১৯৪৫ সালে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন।
আলসার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক
আলসার আক্রান্ত রোগী থেকে সংগ্রহ করা বায়োপসি পর্যবেক্ষণ করার সময় হ্যালিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব খুঁজে পান ব্যারি মার্শাল এবং তার সহযোগী রবিন ওয়ারেন। ১৯৮০ সালে এই দুই চিকিৎসক দাবি করেন, পাকস্থলীর আলসারের জন্য হ্যালিকোব্যাক্টার পাইলোরি দায়ী।
এটি প্রমাণের জন্য একজন রোগীর পাকস্থলী থেকে হ্যালিকোব্যাক্টার পাইলোরি সংগ্রহ করার পর তা নিজের শরীরে প্রবেশ করান মার্শাল। এর কিছুদিন পরেই আলসারের লক্ষণ দেখা যায় মার্শালের শরীরে, যা অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ফলে দূরীভূত হয়। এই আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে মেডিসিনে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয় মার্শাল এবং ওয়ারেনকে।
লিথিয়াম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জন কেড সুস্থ মানুষ এবং মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মূত্র গিনিপিগের তলপেটে প্রবেশ করান। যেসব গিনিপিগের শরীরে সুস্থ মানুষের মূত্র প্রবেশ করানো হয়েছিল তাদের তুলনায় মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীর মূত্র প্রবেশ করানো গিনিপিগগুলো দ্রুত মারা গেল। জন কেড আবিষ্কার করলেন, গিনিপিগগুলো দ্রুত মারা যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত ইউরিক এসিড দায়ী। এর ফলে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের রক্তে অতিরিক্ত ইউরিক এসিড রয়েছে।
ইউরিক এসিডের দ্রাব্যতা বৃদ্ধির জন্য লিথিয়াম দ্রবণ যোগ করেন জন কেড। এটি প্রবেশ করানোর পর তিনি দেখলেন, গিনিপিগগুলো উত্তেজিত হওয়ার পরিবর্তে শান্ত ছিল। মানুষের জন্য এটি নিরাপদ কি না তা প্রমাণ করতে কেড নিজের শরীরেও লিথিয়াম প্রয়োগ করেন। এরপর থেকে বিভিন্ন মানসিক রোগের চিকিৎসায় লিথিয়াম ব্যবহার করা শুরু করেন তিনি।
ক্লোরপ্রোমাজিন
১৯৫০ সালের ১১ ডিসেম্বর পল চারপেন্টিয়ের ক্লোরপ্রোমাজিন সংশ্লেষণ করেন। ১৯৫১ সালের মে মাসে তৎকালীন ফ্রান্সের একটি স্বনামধন্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ক্লোরপ্রোমাজিনকে একটি সম্ভাব্য জেনারেল অ্যানেস্থেটিক হিসেবে ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশনের উদ্দেশ্যে উন্মোচন করে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালানো ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশনে দেখা যায়- ক্লোরপ্রোমাজিন মানুষকে অজ্ঞান করতে পারে না। তবে এটি ঘুমের মতো অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং আশেপাশের বিষয়ের প্রতি অনাগ্রহের সৃষ্টি করে। এর ফলে মনোরোগবিদ্যাতে ক্লোরপ্রোমাজিনের ব্যবহার শুরু হয়।
ইমিপ্রামিন
ক্লোরপ্রোমাজিনের সাথে গঠনগত মিল থাকায় সুইস ফার্মাসিস্ট রোনাল্ড কুন ধারণা করেছিলেন, ইমিপ্রামিন স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এই রোগের চিকিৎসায় কোনো কার্যকারিতা পাওয়া যায়নি ওষুধটির। ওষুধটিকে প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাছে ফেরত পাঠানোর পূর্বে তীব্র হতাশায় ভুগতে থাকা এক রোগীর উপর এটি প্রয়োগ করেন কুন। তিনি দেখতে পান, রোগীর হতাশার লক্ষণ প্রশমিত হচ্ছে। এভাবে কুন ১৯৫৬ সালে ১৮ জানুয়ারি ইমিপ্রামিনের অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট প্রভাব আবিষ্কার করেন।
ক্লোরাল হাইড্রেট
রসায়নের জার্মান অধ্যাপক জুস্টুস ভন লাইবিগ ১৮৩২ সালে ক্লোরাল তৈরি করেন। ফার্মাকোলজি অধ্যাপক অট্টো লাইব্রিইচ ৩৭ বছর পর ১৮৬৯ সালে ক্লোরাল হাইড্রেট তৈরি করেন ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। লাইব্রিইচ ধারণা করেন, ক্লোরাল হাইড্রেটে এমন একটি উপাদান আছে যা শরীরে ক্লোরোফর্মে পরিণত হয় এবং যা ক্লোরোফর্মের মতোই ঘুমকে প্ররোচিত করবে। কিন্তু মানবদেহে ক্লোরাল হাইড্রেট ভাঙার ফলে কোনো ক্লোরোফর্ম তৈরি না হলেও ঘুম প্ররোচিত করার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ক্লোরাল হাইড্রেট ছিল প্রথম কৃত্রিমভাবে তৈরি করা বিশ্বাসযোগ্য সিডাটিভ যা এখনও ব্যবহার করা হয়।
নাইট্রাস অক্সাইড
জোসেপ প্রিস্টলি অক্সিজেন এবং কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস আলাদা করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ১৭৭২ সালে তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস আলাদ করেন যার নাম নাইট্রাস অক্সাইড। নিঃশ্বাসের সময় গ্যাসটি প্রিস্টলির শরীরে প্রবেশ করার ফলে তার শরীর শান্ত এবং অসাড় হয়ে যায়।
অ্যানেস্থেটিক হিসেবে নাইট্রাস অক্সাইডের কার্যকারিতা অনুধাবন করার পর চিকিৎসা শাস্ত্রে এর ব্যবহার শুরু হয়।
ডায়াজেপাম
লিও স্টার্নবাচ নতুন রঙ আবিষ্কারের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে তিনি এই খারিজ করা রাসায়নিক পদার্থ থেকে বিশ বছর পর সিডেটিভ ওষুধ ডায়াজেপাম আবিষ্কার করেন।
ওয়ারফেরিন
১৯২০ সালের শুরুতে পশু চিকিৎসকরা দেখলেন, আঘাত কিংবা সার্জারির পর কিছু গবাদি পশু থেকে অঝোরে রক্তপাত হচ্ছে। তারা আবিষ্কার করলেন, গবাদি পশুগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়া ক্লোভার খেয়েছিল। ২০ বছর পর ক্লোভার গাছ থেকে গবেষকরা অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট এজেন্ট ওয়ারফেরিন তৈরি করেন।
ঘটনাক্রমে আবিষ্কার হলেও এসব জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আবিষ্কারের পেছনে ছিল বিজ্ঞানীদের চেষ্টা আর প্রজ্ঞা। তাই তাদের চেষ্টা আর প্রজ্ঞার স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক বিজ্ঞানীই পেয়েছেন নানা পুরষ্কার। কে জানে, হয়তো ভবিষ্যতেও ঘটনাক্রমে কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হবে যা রক্ষা করবে অগণিত মানুষের জীবন!