দুই বা তার বেশি মানুষ যখন পারস্পরিক মত বিনিময় কিংবা ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে তোলে, তখন সেটিকে বলা হয় আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক। বলা যায়, জগতের প্রতি দুজন মানুষের মধ্যকার সম্পর্কই হলো একেকটি আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক।
এই ধরনের সম্পর্কের আবার অনেক ধরনের শ্রেণীবিভাগ থাকতে পারে। কোনো সম্পর্ক হতে পারে আত্মিক, হৃদয়ঘটিত বা বন্ধুত্বের। আবার কোনো সম্পর্ক হতে পারে নিতান্তই ব্যবসায়িক কিংবা পেশাদারিত্বের খাতিরে। তবে সম্পর্ক যে ধরনেরই হোক না, সেখানে ভাঙা-গড়ার বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
একটি সম্পর্ক রাতারাতি গড়ে ওঠে না। সেটি প্রাথমিক অবস্থা থেকে একটি পরিণত পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেকগুলো ধাপ পার করে আসে। আবার সব সম্পর্ক চিরস্থায়ীও হয় না। অনেক সম্পর্কেই একসময় না একসময় ভাঙন ধরে। কিন্তু সেই ভাঙনও পাকাপোক্ত হওয়ার আগে কিছুটা সময় নেয়। সেই সময়ের মধ্যেও থাকে সূক্ষ্ম কিছু ধাপ।
আদতে সম্পর্কের ভাঙা-গড়ার এই ধাপগুলো খুবই জটিল ও কঠিন হলেও, এগুলোকে খুব সহজ করে তুলেছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মার্ক এল ন্যাপ। ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাসের এই ইমেরিটাস অধ্যাপক ১৯৭৮ সালে প্রণয়ন করেন দশ ধাপের রিলেশনাল ডেভেলপমেন্ট মডেল। এই দশটি ধাপকে আবার দুই ভাগে বিভক্ত করে তিনি দেখান যে, একটি আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক কোন পাঁচ ধাপে গড়ে ওঠে, আবার কোন পাঁচ ধাপে সেটি ভেঙে যায়।
চলুন তাহলে দেখে নেয়া যাক, ন্যাপ প্রণীত মডেল অনুসারে একটি আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক কীভাবে গড়ে এবং ভাঙে।
যেভাবে সম্পর্ক গড়ে
১. সূচনা (Initiation) – ‘ফার্স্ট ইমপ্রেশন’ কথাটির সাথে তো আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত। মূলত সেটিরই বাস্তব প্রয়োগ ঘটে থাকে সম্পর্কের এই পর্যায়ে। দুজন মানুষ প্রথমবারের মতো একে অপরের সংস্পর্শে আসে, এবং বিভিন্ন কারণে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই কারণগুলোর ভেতর থাকতে পারে কথা বলার ধরন, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, শারীরিক সৌন্দর্য, পোশাক পরিচ্ছন্দ, এমনকি গায়ের গন্ধও। অর্থাৎ নিতান্তই অপরিচিত দুজন ব্যক্তি যদি মনে করে যে তারা পরস্পরের পরিচিত হতে চায় ও একটি আলাপচারিতা শুরু করতে চায়, তাহলে প্রথম দেখার যে ব্যাপারগুলো দ্বারা তারা উদ্বুদ্ধ হবে, সেগুলোই হলো এই ধাপের অন্তর্ভুক্ত।
যেমন: একটি ছেলের একটি মেয়েকে দেখে বেশ ভালো লাগল। সে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল, এবং খুব বিনয়ের সাথে নিজের পরিচয় দিয়ে মেয়েটির নাম, পরিচয় জানতে চাইল। আবার ব্যবসায়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, দুজন ব্যক্তি তাদের ভিজিটিং কার্ড আদান-প্রদান করল, ভবিষ্যতে একসাথে আলোচনায় বসার প্রতিশ্রুতি দিল। এগুলোই হলো সম্পর্কের সূচনা।
২. নিরীক্ষা (Experimentation) – সম্পর্কের সূচনা পর্বের পর এই ধাপে আসে দুজন ব্যক্তির পরস্পরকে আরেকটু ভালো করে জানার পালা। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই ধাপেই একে অন্যকে ‘ঝালিয়ে’ নেয়া হয়, যাচাই করে দেখা হয় যে তাদের মধ্যকার সম্পর্কটি আরো সামনের দিকে এগোতে পারে কি না। বেশিরভাগ সম্পর্ক সাধারণত এই ধাপে এসেই থেমে যায়, কেননা দুজন মানুষের মধ্যকার আগ্রহ বা স্বার্থের জায়গাগুলো মেলে না। তাই তারা আবার ভবিষ্যতে দেখা করতে বা কথা বলতে চায় না। কিন্তু যদি দেখা যায় যে দুজন ব্যক্তি সম্পর্কের এই ধাপে পরস্পরের প্রতি আরো বেশি আগ্রহী হলো, নিজেদের মধ্যে অভিন্নতা খুঁজে পেল, তাহলে নিরীক্ষার ধাপটি সফল হয়। সম্পর্ক পরের ধাপে এগোনোর পথে পা বাড়ায়।
যেমন: ছেলেটি মেয়েটির সাথে আবার দেখা করল বা ফেসবুকে যোগাযোগ করল। তারা নিজেদের বিষয়ে টুকটাক আলাপ করল। হতে পারে তারা কথা বলল নিজেদের প্রিয় কাজ নিয়ে, কিংবা পছন্দের খাবার নিয়ে। মূলত এভাবে তারা জানার চেষ্টা করল যে তাদের মধ্যে মনের মিল রয়েছে কতটুকু। কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থে দুজন ব্যক্তি আবারো যোগাযোগ করল, এবং তারা বোঝার চেষ্টা করল যে তাদের দুজনের লক্ষ্য এক কি না, তাদের একত্রে কাজ করে সফলতা লাভের সম্ভাবনা কতটুকু। এগুলোই হলো সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিরীক্ষা।
৩. জোরদার করা (Intensifying) – সম্পর্কে পূর্বের দুটি ধাপ যদি সফল হয়, তাহলে এই তৃতীয় ধাপ থেকে সম্পর্কটি আরো সিরিয়াস রূপ ধারণ করতে থাকে। এক্ষেত্রে দুজন ব্যক্তি আগের চেয়ে ইনফরমালভাবে কথাবার্তা বলে বা মেলামেশা করে। নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে সম্পর্কটিকে মজবুত করার জন্য তারা একে অন্যকে উপহার দেয়, বিভিন্ন বিষয়ে মানসিক সমর্থন প্রদান করে। মোদ্দা কথা হলো, আগের দুটি ধাপে অনিশ্চয়তা বা সিদ্ধান্তহীনতা থাকলেও, এই ধাপে এসে দুজন ব্যক্তি সেগুলো ঝেড়ে ফেলতে চায়, কমিটেড বা অঙ্গীকারাবদ্ধ সম্পর্ক স্থাপনের বাসনা তাদের কাজেকর্মে দেখা যায়।
যেমন: ছেলেটি এবার মেয়েটিকে কোথাও ডিনারের জন্য আমন্ত্রণ জানাল। খেতে খেতে তারা নিজেদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলল। তাদের প্রতিদিন কীভাবে কাটে, বাসায় কে কে আছে, ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা কী, ইত্যাদি। আবার ব্যবসায়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, দুজন ব্যক্তি পারস্পরিক সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করল। দুজনের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যদি কিছুটা ভিন্নতা থাকেও, সেই ভিন্নতাকে কীভাবে দূর করে অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, সেটির ব্যাপারে উভয়পক্ষই চেষ্টা-চরিত্র শুরু করল। নিজ নিজ জায়গায় কিছুটা ছাড়ও দিল। এগুলোই হলো সম্পর্ক জোরদার করার বৈশিষ্ট্য।
৪. একাত্ম হওয়া (Integration) – সম্পর্কের এই ধাপে দুজন ব্যক্তি পরস্পরের আরো কাছাকাছি আসে। এতদিন তাদের মধ্যে যে দূরত্ব বা সীমানা ছিল, এবার নিজেরাই সেগুলোকে মুছে ফেলতে চায়। এখন তারা পরস্পরের ব্যক্তিগত বিষয়াবলি যেহেতু জেনে গেছে, এবং এটিও জানে যে তারা কেমন মানসিকতার অধিকারী, তাই অন্যের ব্যাপারেও অল্পস্বল্প মতামত দিতে থাকে। সর্বোপরি তারা একটি অঙ্গীকারের দিকে আরো অনেকখানি অগ্রসর হয়।
যেমন: ছেলেটির সাথে মেয়েটির প্রেম বা গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল। প্রায়ই তাদেরকে প্রকাশ্যে একত্রে দেখা যেতে লাগল। কিংবা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, দুজন ব্যক্তিই পরস্পরের দ্বারা লাভবান হতে বা মুনাফা লাভ করতে থাকল। অর্থাৎ এতদিন সম্পর্কগুলো কোনো একটি জায়গায় গিয়ে থেমে থাকলেও, একাত্ম হওয়ার এই ধাপেই সেগুলো সুস্পষ্ট কাঠামো লাভ করে, এবং এর আনুষঙ্গিক প্রভাবও দৃশ্যমান হয়।
৫. বন্ধন (Bonding) – এই ধাপে সম্পর্ক চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। প্রকাশ্য নানা ইঙ্গিত বা আচার আচরণের পাশাপাশি দুজন ব্যক্তি মৌখিক বা লিখিত আকারেও তাদের সম্পর্ককে একটি স্বীকৃতি দিতে শুরু করে। সাধারণত অঙ্গীকারের বিষয়টিও এখানে চলে আসে। সম্পর্ক পায় একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। তাই এই পর্যায়ে এসে আর চাওয়া মাত্রই সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসা যায় না। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক প্রশ্ন অথবা আইনি জটিলতার মুখোমুখি হওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
যেমন: ছেলেটি ও মেয়েটি বিয়ে করে ফেলল। কিংবা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, দুজন ব্যক্তি কাগজে-কলমে চুক্তির মাধ্যমে পরস্পরের পার্টনার হয়ে গেল। এভাবেই বন্ধনের মাধ্যমে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়, এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব লাভ করে।
যেভাবে সম্পর্ক ভাঙে
১. মতপার্থক্য (Differentiating) – একটি সম্পর্ক যত সুদৃঢ় ও মজবুতই হোক না কেন, কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে দুজন ব্যক্তির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিতেই পারে। অর্থাৎ এতদিন তারা অভিন্ন উদ্দেশ্যে একইভাবে ভাবলে বা সিদ্ধান্ত নিলেও, হঠাৎ করে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাভাবনায় সংঘর্ষ শুরু হতে পারে। এর ফলে এতদিন যে ভাবা হচ্ছিল দুজন ব্যক্তির মধ্যে কখনো কোনো দেয়াল গড়ে উঠবে না, সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে দুজন ব্যক্তি যত ঘনিষ্ঠই হোক না কেন, তাদের পৃথক ও স্বতন্ত্র সত্তাও রয়েছে।
যেমন: ছেলেটি কোনো একটি সিদ্ধান্ত নিল, যা মেয়েটির মনঃপুত হলো না। কিন্তু ছেলেটি মেয়েটির আপত্তি মেনে না নিয়ে, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে চাইল। এর ফলে তাদের সম্পর্কে একটি টানাপোড়েন শুরু হলো। কিংবা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তির বার্ষিক পরিকল্পনা অন্যজনের পছন্দসই হলো না। সে খানিকটা ভিন্নভাবে ভাবতে লাগল। কিন্তু এতে করে তাদের সম্পর্কে চিড় ধরার আশঙ্কা তৈরি হলো। এভাবেই মতপার্থক্য এসে সম্পর্কের বন্ধনকে কিছুটা হলেও শিথিল করে দেয়।
২. সীমানারেখা তৈরি (Circumscribing) – সম্পর্ক যখন একাত্মতা কিংবা বন্ধনের পর্যায়ে থাকে, তখন দুজন ব্যক্তি যেকোনো বিষয় নিয়েই নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাতে পারে। অর্থাৎ তারা পরস্পরের এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু মতপার্থক্য এসে জানিয়ে দেয় যে তারা মোটেই দুই দেহে এক প্রাণ নয়, বরং তাদের মধ্যে অবশ্যই কিছু বৈসাদৃশ্য বা ব্যবধান রয়েছে। তখন অবচেতন মনেই তারা নিজেদের চারপাশে একটি বেষ্টনী বা সীমানারেখা টেনে দেয়, এবং নিজেদেরকে নিজেদের সীমানার ভিতরই আবদ্ধ রাখে। যেসব বিষয়ে তাদের মধ্যে বিতর্ক বা ঝগড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে হয়, সেগুলো তারা এড়িয়ে যেতে চায়। বরং এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়, যেগুলোতে মতপার্থক্য আরো ঘনীভূত হবার সম্ভাবনা নেই।
যেমন: ছেলেটি তার ওই নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মেয়েটির সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। কারণ সে জানে, ওই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেই মেয়েটির সাথে তার নতুন করে ঝামেলা তৈরি হতে পারে। তাই সে সাধারণ কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগল, যাতে বিতর্কের সুযোগ নেই। এদিকে ব্যবসায়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, দুজন ব্যক্তি বুঝে গেল যে সব বিষয়েই তারা একইভাবে চিন্তা করবে না। তাই পারস্পরিক সিদ্ধান্তের পাশাপাশি তারা নিজেদের মতো করেও ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নিতে লাগল, যেগুলোতে অপরজনের সায় না-ও থাকতে পারে।
৩. স্থবিরতা (Stagnation) – একটি সম্পর্কের আরো অবনমন ঘটে এই ধাপে এসে। দুজন ব্যক্তির মধ্যে আলাপচারিতা বা ঘনিষ্ঠতা আরো সীমিত হয়ে যায়। তবু তারা সরাসরি বিচ্ছেদের কথা ভাবতে পারে না হয়তো কোনো পিছুটানের কারণে, কিংবা আইনগত সমস্যা থাকায়। হতে পারে সন্তানদের কথা ভেবে অথবা কোনো দুর্লঙ্ঘনীয় চুক্তি থাকার দরুন, চাইলেও দুজন ব্যক্তি তাদের সম্পর্কে ইতি টানতে পারে না।
যেমন: ছেলেটি মেয়েটির সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধই করে দিল। কেবল খুব প্রয়োজনেই তারা কথা বলে, কিংবা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু একসময় তাদের সম্পর্কে যে গভীরতা ছিল, তা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে। আবার ব্যবসায়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, দুজন ব্যক্তি জানে যে তাদের মতের মিল হচ্ছে না, তবু ব্যবসায়িক বৃহত্তর স্বার্থে কিংবা পারস্পরিক চুক্তিবদ্ধ থাকায়, তারা একত্রে কাজ করে যেতে বাধ্য হলো। এভাবেই সম্পর্ক অনেকটা অথর্ব বা জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
৪. এড়িয়ে চলা (Avoiding) – এই পর্যায়ে এসে দুজন ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক এতটাই তিক্ততা লাভ করে যে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই পরস্পরকে একেবারে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তারা এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করে যেন দুজনের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ বা আলাপচারিতার সুযোগ না থাকে। অর্থাৎ মানসিক বা শারীরিকভাবে তারা পরস্পরের অনেক দূরে চলে যায়।
যেমন: মেয়েটির সাথে আর একসাথে থাকা সম্ভব নয় বলে, ছেলেটি একদিন জামাকাপড় গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। মেয়েটিরও আর ছেলেটির প্রতি তেমন টান অবশিষ্ট না থাকায়, সে ছেলেটিকে আটকানোর চেষ্টাও করল না। কারণ মনে মনে সে-ও চায় ছেলেটির থেকে দূরে থাকতে। এদিকে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও, দুজন ব্যক্তি একে অন্যকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা কিংবা পরিকল্পনার অভাবে তাদের ব্যবসাও ক্রমান্বয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হতে লাগল। এভাবেই সম্পর্কের চূড়ান্ত সমাপ্তির আগে, মুখ দেখাদেখি, কথাবার্তা বা যোগাযোগ একপ্রকার বন্ধই হয়ে যায়।
৫. সমাপ্তি (Terminating) – সম্পর্কের এই পর্যায়ে এসে দুজন ব্যক্তির মধ্যে আর কোনো আকর্ষণ বা টানই অবশিষ্ট থাকে না। তাই সম্পর্কের সমাপ্তি অপরিহার্য হয়ে পড়ে, এবং একপর্যায়ে তা ঘটেও। দুজন ব্যক্তি তখন নিজ নিজ রাস্তা বেছে নেয়। যদি তাদের সম্পর্কে কোনো লিখিত চুক্তি থেকে থাকে, তাহলে তারা সেই চুক্তি শেষ করে দেয়। অথবা যাদের সেরকম কোনো চুক্তি নেই, তারাও পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে আর সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। অনেকক্ষেত্রে আবার এই সম্মতিরও প্রয়োজন পড়ে না। দুজন ব্যক্তির সম্পর্ক এতটাই বাজে অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় যে, কোনো কথাবার্তা ছাড়াই তারা পরস্পরের জীবন থেকে পুরোপুরি দূরে সরে যায়, যাবতীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
যেমন: ছেলেটি ও মেয়েটি উকিলের শরণাপন্ন হলো ডিভোর্সের জন্য। কিংবা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, দুজন ব্যক্তি তাদের চুক্তি শেষ করে দিল, চুক্তি ভেঙে ফেলল, কিংবা সিদ্ধান্ত নিল তাদের ব্যবসা আর অব্যাহত না রাখার। এভাবেই সম্পর্কগুলো শেষ হয়ে গেল।
এটাই ছিল ন্যাপ প্রণীত সম্পর্কের রূপরেখা, যার মাধ্যমে একটি সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, আবার ভেঙেও যায়। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, এটি কিন্তু কোনো গণিতের সূত্র না যে সবগুলো বিষয় এভাবেই ঘটবে বা ঘটা উচিত। আবার এটি এমনও কোনো ব্যাপার নয় যে প্রথম পাঁচ ধাপ অনুসরণ করে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে পরের পাঁচ ধাপ অনুযায়ী সেটি ভাঙতেও বাধ্য।
ন্যাপ নিছকই কিছু বাস্তব জীবনের দৃষ্টান্ত বা কেস স্টাডি বিশ্লেষণ করে সাধারণীকরণের ভিত্তিতে এই ধাপগুলো সাজিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব জীবনে যেহেতু সবকিছু নিয়ম মেনে হয় না, তাই অনেকের ক্ষেত্রেই সম্পর্কের এই ধাপগুলো না-ও খাটতে পারে।
আবার সবসময়ই যে এই ধাপগুলো পরপর ঘটবে, তেমনও কিন্তু নয়। ধাপগুলো যেকোনো সময় পেছনে ফিরে যেতে পারে, কিংবা কখনো কখনো একইসাথে কয়েক ধাপ এগিয়েও যেতে পারে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট ঘটনা বা পরিস্থিতিই প্রতিটি সম্পর্কের আলাদা আলাদা গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেবে।
যেমন: দুজন ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক জোরদার বা একাত্ম হওয়া পর্যন্ত গিয়েও থেমে যেতে পারে। সেটি আর বন্ধন পর্যন্ত না-ও গড়াতে পারে। আবার অনেক সময় এমনও হতে পারে যে দুজন ব্যক্তির সম্পর্ক এড়িয়ে চলা বা স্থবিরতা পর্যন্ত গিয়েও আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেছে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি বা ঘনিষ্ঠতায় চিড় ধরলেও, একপর্যায়ে তারা আবার তাদের সম্পর্ককে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে গেছে।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটি দেখা যায় তা হলো, সূচনা ও নিরীক্ষার পরও কোনো সম্পর্ক আর চূড়ান্তভাবে গড়ে উঠছে না, কিংবা মতপার্থক্য ও সীমানারেখা তৈরির পরও কোনো সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙে যাচ্ছে না। কেননা সম্পর্কে মানবীয় আবেগ-অনুভূতির গুরুত্ব অপরিসীম। সম্পর্ক যেহেতু কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ছকে ভাঙে বা গড়ে না, বরং মানুষের আবেগ-অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হয়, ফলে এর ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিতভাবে কখনোই পূর্বানুমান করা যায় না। হয়তো সে কারণেই, প্রথম দেখাতেই অনেকে পরস্পরের প্রেমে পড়ে যায়। আবার পাকাপাকিভাবে সম্পর্কের বিচ্ছেদ বা সমাপ্তির পরেও, অনেকেই আবার পরস্পরের কাছে ফিরে আসে!