ম্যাক্স প্ল্যাংক তখন জার্মান ভ্রমণে। সাল ১৯১৮। সদ্যই তিনি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একরকম জনক তিনি। কাজেই, বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর ডাক পড়ছে তার। যেখানেই যাচ্ছেন, হুবহু একই বক্তৃতা দিয়ে আসছেন সব জায়গায়। এই কাজ আমাদের শিক্ষকরাও করে থাকেন বৈকি। নটরডেম কলেজের মুখতার স্যার নাকি কুবের-কপিলার আদিরসাত্মক গল্প দিনের পর দিন, ক্লাসের পর ক্লাস দাঁড়ি কমা পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করে যেতে পারতেন। নোবেল জয়ী কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের আর কী দোষ?
তার সাথে ঘুরতে ঘুরতে আর শুনতে শুনতে একসময় তার ড্রাইভারের এই বক্তৃতা লাইন বাই লাইন মুখস্থ হয়ে গেল। সে প্ল্যাংককে বললো,
“স্যার। এক লেকচার দিতে দিতে আপনার তো একঘেয়ে লাগার কথা। এবার মিউনিখে আপনার বদলে আমি লেকচারটা দিলে কেমন হয়? আপনি সামনের সারিতে ড্রাইভারের ক্যাপ পরে বসে থাকবেন আর শুনবেন। আপনার জীবনে সামান্য বৈচিত্র্য আসলো, আমার জীবনেও সামান্য বৈচিত্র্য আসলো।”
এই প্রস্তাব প্ল্যাংকের মনে ধরলো। সেদিন সন্ধ্যায় বাঘা বাঘা সব মানুষের সামনে প্ল্যাঙ্কের ড্রাইভার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর লম্বা লেকচার ঝেড়ে দিয়ে এলো। লেকচার শেষে পদার্থবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক লেকচারদাতার দিকে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। লেকচারদাতা মুচকি হেসে বললেন, “মিউনিখের মতো এমন একটা আধুনিক শহরে কেউ এমন মামুলি একটা প্রশ্ন করবে, আমি ভাবতেই পারিনি। আমার ড্রাইভারও এই প্রশ্নের উত্তর জানে।”
জনাব প্ল্যাঙ্কের ড্রাইভার তো তার সীমিত জ্ঞান নিয়েও উপস্থিত বুদ্ধির জোরে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছেন। আপনি আমি হলে পারতাম কি? নির্ভর করে আমাদের উপস্থিত বুদ্ধির উপর। সে যাকগে। বুদ্ধি নিয়ে নয়, কথা হচ্ছে জ্ঞান নিয়ে।
জ্ঞান দুই রকম। প্রকৃত জ্ঞান; যা অর্জন করার জন্য আপনাকে একটা বিশাল পরিমাণ সময় আর শ্রম দিতে হবে। আসল ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের যে জ্ঞানটা ছিল, তা হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান। আরেক রকম জ্ঞান হচ্ছে ড্রাইভারি জ্ঞান, যা কিনা আপনি অন্যের কাছ থেকে পেয়েছেন। সেটা আপনি চাইলে কোথাও উপস্থাপন করতে পারবেন। আপনার চেহারা সুরত আর গলা ভালো হলে তো কথাই নেই। কিন্তু বিষয়বস্তুর গভীরে গেলে আপনি খেই হারিয়ে ফেলবেন। গল্পের ভুয়া ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক হচ্ছে এই ড্রাইভারি জ্ঞানের অধিকারী।
সমস্যা হলো, পৃথিবী যত এগোচ্ছে, প্রকৃত জ্ঞান থেকে এই ড্রাইভারি জ্ঞানকে আলাদা করা মুশকিল হয়ে পড়ছে। সংবাদ পাঠকরা এই কাজটা আমাদের জন্য আরো কঠিন করে দিচ্ছে। একেক জন সংবাদ পাঠক আজকে একেকজন অভিনেতা। খুব উঁচুমানের অভিনেতা আসলে। এটা আমরাও জানি, তারাও জানে। এ কারণেই ট্রেভর নোয়া (Trevor Noah) স্ট্যান্ডআপ কমেডি থেকে সংবাদ উপস্থাপনায় চলে আসেন। এ কারণেই জন অলিভাররা যখন আমাদের সামনে সংবাদ উপস্থাপন করেন, আমাদের মনে হয়, তারা বুঝি সত্যি সত্যিই ঐ বিষয়ে এত গভীর জ্ঞান রাখেন।
সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা। কেউ কেউ হয়তো একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সত্যিই গভীর জ্ঞান রাখেন। তারা একটা সমস্যার জটিলতা বুঝতে সময় নেন। চিন্তা করেন। সমস্যার এদিক ওদিক সবদিক থেকেই ভাবেন। তারপর সময় নিয়ে একটা লম্বা রিপোর্ট হয়তো লেখেন। তাতে নানারকম উদাহরণ হাজির থাকে, থাকে তার ব্যতিক্রমও।
বেশিরভাগ সাংবাদিক অবশ্য এসব ঝুটঝামেলার ধার ধারেন না। তারা চটকদার কিছু ঘটলেই সেটা নিয়ে একটা গল্প ফেঁদে বসেন। নিজের মাথায় সামান্য যা মালমশলা আছে, তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেন। না পারলে গুগল সার্চ তো আছেই। এই গল্পে যুক্তি, তথ্য-উপাত্তের চেয়ে ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতিই বেশি প্রাধান্য পায়। আমজনতা সেগুলো খায়ও অবশ্য। এই সাংবাদিক ভাইয়েরা হচ্ছে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের সেই ড্রাইভার।
আজকের ব্যবসার দুনিয়ায় দেখবেন এই ড্রাইভারি জ্ঞানের খুব কদর। আজকের সিইওরা যতটা না বিজনেস এক্সিকিউটিভ, তার চেয়ে অনেক বেশি সুপারস্টার, সেলিব্রিটি ফিগার- যা বলেন তা-ই। লোকটা কেমন কাজ জানে, কাজের প্রতি তার ডেডিকেশন কতটুকু, বাইরে থেকে তা বোঝা সম্ভব নয়। আমরা দেখি, লোকটা ক্যামেরার সামনে কেমন পারফর্ম করছে। বাজারে পণ্য অবমুক্ত করার অনুষ্ঠানটি সে মাতিয়ে রাখতে পারছে কিনা। আগেকার যুগে রকস্টাররা যে দায়িত্ব পালন করতো, এখন সিইওদের সেটা করতে হচ্ছে। আর যখনই আমজনতাকে মাতানোর বিষয়টা আলোচনায় চলে আসে, জ্ঞানের পরিধি বা গভীরতা দুটোই তখন সাইডলাইনে চলে যায়।
ড্রাইভারী জ্ঞান থাকাটা একদম খারাপ না। কোনো কোনো জায়গায় হয়তো আপনি উৎরেও যাবেন। কিন্তু কোথাও না কোথাও আপনি আটকাবেনই। তখন তো আপনাকে লজ্জায় পড়তে হবে। আর একবার ধরা খেলে অন্য ফিল্ডে আপনার ভালো জ্ঞান থাকলেও লোকে তখন আর আপনার কোনো কথাকে পাত্তা দেবে না। এ অবস্থায় করণীয় কী?
ওয়ারেন বাফেটের বিজনেস পার্টনার চার্লি মুঙ্গের আমাদের একটা বুদ্ধি দিয়েছেন। তিনি বলছেন, নিজের জ্ঞানের পরিধিটা জানা থাকা চাই। আপনি কী জানেন আর কী জানেন না- সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি কী জানেন আর কী জানেন না সেটা জানা। খেলাধুলা, রাজনীতি, অর্থনীতি, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি সব বিষয়ে আপনার জ্ঞান না থাকলেও আপনি কিছু করে খেতে পারবেন। কিন্তু কোথাও না কোথাও আপনার বিশেষত্ব থাকা চাই। বৃত্তটা বড় করুন, সমস্যা নেই। কিন্তু ভেতরটা যেন ফাঁপা না হয়।
কোনো এক আড্ডায় সবাই হয়তো ক্রিকেট নিয়ে গল্প করছে। ক্রিকেটে আপনি কোনো আগ্রহ পান না। কিন্তু চুপ করে থাকলে তো খারাপ দেখায়। তাই অংশগ্রহণের খাতিরে আপনি একটা মতামত দিলেন। সেই আসরে আপনার চেয়ে বহু কাবেল লোক বসে আছে। গত দশ বছরের বাংলাদেশ তথা বিশ্ব ক্রিকেটের পরিসংখ্যান যার মুখস্থ। সে আপনার মতামতকে যুক্তি-তথ্য দিয়ে একেবারে ধুয়ে দিল। এরকম ক্ষেত্রে শুধু শুধু একটা মন্তব্য করে সবার হাসির পাত্র হবার তো দরকার নেই। এর চেয়ে আপনার যদি ফুটবল নিয়ে আগ্রহ আর যথেষ্ট জানাশোনা থাকে, আপনি গল্পের রাস্তাটাকে ফুটবলের দিকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা কীভাবে বুঝবো যে কে প্রকৃতই জ্ঞানের চর্চা করছে আর কার ড্রাইভারি জ্ঞান? কার ভেতরটা নিরেট আর কার ভেতরটা ফাঁপা? খুব সহজ। সত্যিকার জ্ঞানীরা নিজেদের সীমা জানে। কোথায় থামতে হবে জানে। তারা যখন বুঝতে পারে যে এই বিষয়টা তাদের জানাশোনার বাইরে, তারা চুপ করে যায়। অনেকে গর্ব করে বলে এটাও বলে, “আমি জানি না।” তারা জানে যে, না জানাটা কোনো অপরাধ নয়, না জেনেও অনেক জানার ভান করাটা অপরাধ। শো-অফারদের কাছ থেকে আপনি কখনো এই বাক্যটা শুনতে পাবেন না।
মূল: Chauffeur Knowledge, The art of thinking clearly, Rolf Dobelli
ফিচার ছবি- Behance