রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত ১১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বিশ্বের প্রথম করোনাভাইরাসের কার্যকরী ভ্যাকসিনের ঘোষণা দিয়েছেন। গ্যামেলিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউডের পক্ষ থেকে গবেষণা করা ভ্যাকসিনটি ইতোমধ্যে সরকারিভাবে রাশিয়ায় নিবন্ধিত হয়ে গেছে। পুতিনের ভাষ্যমতে, এই ভ্যাকসিন নেওয়া শরীরের জন্য নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে এবং অন্তত ২০টি দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ভ্যাকসিন কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। পুতিনের দুই মেয়ের একজন নাকি এই ভ্যাকসিন নিয়েছেন এবং তিনি সুস্থ আছেন।
আমাদের ভ্যাকসিনটি উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি দৃঢ় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সক্ষম। আমাদের অবশ্যই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত, যারা প্রথম বারের মতো সফল ভ্যাকসিন আনতে সক্ষম হয়েছে, যা আমাদের দেশ ও বিশ্ববাসীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে কোভিড-১৯ এর মহামারিতে একটি ভ্যাকসিনের জন্য পুরো বিশ্ববাসী গত ৮ মাস ধরে অপেক্ষা করছে। কবে আসবে একটি কার্যকর ও নিরাপদ ভ্যাকসিন, এটি বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষ সবারই প্রশ্ন। সেই ভ্যাকসিনের লক্ষেই আমেরিকা, চীন, ইংল্যান্ড, রাশিয়া কাজ করছে। আমেরিকা আর চীন যেখানে অনেকদিন ধরে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালিয়ে আসছে, সেখানে তুলনামূলক দেরিতে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু করেও তাদের আগেই রাশিয়ার ভ্যাকসিনের সফলতা চমকে দিয়েছে সবাইকে।
ভ্যাকসিনের খবরটি চমকপ্রদ হলেও বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে আশাবাদী হতে পারছেন না। কারণ রাশিয়া যতটা না বৈজ্ঞানিক পন্থায় কাজ করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে রাজনৈতিকভাবে। রাশিয়া এখানে ভ্যাকসিনটি মানুষের ওপর কতটা নিরাপদভাবে কাজ করবে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ভ্যাকসিনের প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে থাকাকে।
যেভাবে কাজ করবে এই ভ্যাকসিন
রাশিয়ার নতুন ভ্যাকসিনের নাম দেওয়া হয়েছে স্পুটনিক-৫। এটাকে তুলনা করা হয়েছে বিশ্বের প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিকের সাথে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ু যুদ্ধের সময় মহাকাশে যে প্রতিযোগিতা চলছিল, তখনই ১৯৫৭ সালে এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। রাশিয়ান জনগণের কাছে এই ভ্যাকসিনটাকেও স্পুটনিকের মতো সফলতা হিসাবে প্রচার করা হচ্ছে।
স্পুটনিক-৫ এ দুটি ভেক্টর ভাইরাস ব্যবহার করা হয় ভ্যাকসিনেশনের জন্য। ভেক্টর হচ্ছে একধরনের ভাইরাস যা থেকে তার বংশবৃদ্ধি করার জিনটি সরিয়ে ফেলা হয়। যে ভাইরাসের বিপরীতে ভ্যাকসিনেশন করা হবে, সেই ভাইরাসের কোনো জিন ভেক্টর ভাইরাসে প্রবেশ করানো হয়। তারপর সেই ভেক্টর ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করানো হয়।
স্পুটনিক-৫ এ ভেক্টর ভাইরাস হিসাবে অ্যাডিনো ভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যাডিনো ভাইরাস রেসপিরেটরি ইনফেকশন করে থাকে। কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী সার্স কোভ-২ ভাইরাসের স্পাইক বা মুকুট তৈরি করে থাকে এস প্রোটিন(S protein)। এই এস প্রোটিনকে দুটি ভেক্টর অ্যাডিনো ভাইরাসে প্রবেশ করানো হয়। এই অ্যাডিনো ভাইরাসকে মানব শরীরের কোষে প্রবেশ করানো হয়। তখন শরীরে এস প্রোটিন তৈরি হওয়া শুরু হয়। এই এস প্রোটিনের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে।
২১ দিন পর অন্য আরেকটি অ্যাডিনো ভাইরাস প্রবেশ করানো হয়। এই অ্যাডিনোভাইরাসের বিপরীতে শরীরে আরো দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। গ্যামেলিয়া রিসার্চ সেন্টারের দাবি, এই ভেক্টর ভাইরাস প্রবেশ করানো শরীরের জন্য নিরাপদ, একইসাথে রোগ প্রতিরোধের জন্যও কার্যকরী।
যে কারণে এই ভ্যাকসিন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে
রাশিয়া নিজেদের ভ্যাকসিন উৎপাদনে সফল দাবি করলেও বিজ্ঞানীদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। কারণ রাশিয়ার পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র পুতিনের মুখের কথার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে ভ্যাকসিনটি আসলেই কতটুক নিরাপদ ও কার্যকর, তা অন্য বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন না। তাছাড়া ভ্যাকসিনের ট্রায়াল যথেষ্ট মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়নি।
চীন-আমেরিকা যেখানে তাদের ভ্যাকসিনের এখন ফেজ-৩ ট্রায়ালে আছে, রাশিয়া সেখানে ফেজ-৩ তে যাওয়ার আগেই নিজেদের ভ্যাকসিন সফল দাবি করে বসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য একে এখনও ফেজ-১ এই রেখেছে। আমেরিকা যেখানে ৩০,০০০ মানুষের ওপর ফেজ-৩ ট্রায়াল চালাচ্ছে, রাশিয়া সেখানে মাত্র ৭৬ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর ট্রায়াল চালিয়েছে।
এই স্বেচ্ছাসেবীদের ওপর ট্রায়াল শুরু হয় ১৭ জুন থেকে। অর্ধেককে দেওয়া হয়েছে ভ্যাকসিনের তরল মাধ্যম, বাকি অর্ধেককে দেওয়া হয়েছে দ্রবণীয় পাউডার রূপে। প্রথম গ্রুপের কিছু স্বেচ্ছাসেবী নেওয়া হয়েছে সেনাবাহিনী থেকে, যা প্রশ্ন তুলছে তাদের হয়তো জোর করে ট্রায়ালে নিয়ে আসা হয়েছিল।
স্বাস্থ্যকর্মী আর গবেষকরাও অনেকে নিজের শরীরে ভ্যাকসিন নিয়ে ট্রায়াল দিয়েছেন, যা আধুনিক বিজ্ঞানে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ভ্যাকসিন শুধু সুস্থ মানুষদের দেহেই প্রয়োগ করা হয়েছে। কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে কি না তার উত্তর পাওয়া যায়নি। ফলে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের ওপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগে তাদের শারীরিক অবস্থা আরও অবনতি হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
বর্তমানে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন শুধু স্বাস্থ্যখাত বা বিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিশ্ব রাজনীতিতেও গুরুতর অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে দেশ আগে ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে পারবে, তারাই হয়তো চালকের আসনে থাকতে পারবে। রাশিয়া, আমেরিকা, চীনের মধ্যে সেই প্রতিযোগিতাই চলছে। ফলে ভ্যাকসিন কতটুকু কার্যকর বা নিরাপদ, তার চেয়ে যেন বাজারে সবার আগে আনতে পারাটাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাশিয়ার এই ভ্যাকসিন অপরিপক্ক অবস্থাতেই কার্যকর দাবি করা হচ্ছে। এতে কোটি কোটি মানুষের এই ভ্যাকসিন ব্যবহার করার একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। রাশিয়ার এই অবস্থান অন্য দেশগুলোকেও হয়তো রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলবে। তারাও যদি রাশিয়ার দেখানো পথে হাঁটা শুরু করে, তাহলে সেটা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ভ্যাকসিনের ওপর মানুষের বিশ্বাস উঠে যাবে এবং ভ্যাকসিন বিরোধীরা আরো সক্রিয় হয়ে উঠবে।
তাছাড়া গত মাসে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য অভিযোগ করে, রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হ্যাকাররা তাদের ভ্যাকসিন সম্পর্কে তথ্য হ্যাক করার চেষ্টা করেছে। যদিও রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই অভিযোগ নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ তাদের দাবি, রাশিয়া অন্য দেশগুলোর থেকে ভ্যাকসিন গবেষণায় এমনিতেই এগিয়ে আছে। তাদের আর কারো কাছ থেকে তথ্য চুরি করার দরকার নেই।
পুতিন এই বছরে কিছুটা চাপে আছেন। রাশিয়ায় করোনা আক্রান্ত রোগীর পাশাপাশি মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে। তার জনপ্রিয়তায়ও ধস নেমেছে। তাই দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক মহলে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ভ্যাকসিনের দৌড়ে এগিয়ে থাকতে চাচ্ছেন। তিনি দাবি করেছেন, তার মেয়েও এই ভ্যাকসিন নিয়েছেন। কিন্তু তিনি এই ট্রায়ালের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন কিনা জানা যায়নি।
রাশিয়ার দাবি, তাদের কাছে ইতোমধ্যে একশ কোটি ভ্যাকসিনের অর্ডার চলে এসেছে ২০টি দেশ থেকে। তারা প্রতি বছর ৫০ কোটি ভ্যাকসিন তৈরি করার জন্য প্রস্তুত করছে ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতেরতে এই ভ্যাকসিনের জন্য ‘গিনিপিগ’ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
রাশিয়ার ভ্যাকসিন কাজ করবে কি না তা সময়ই বলে দেবে। তবে তা কোটি কোটি মানুষের ওপর প্রয়োগ করার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। রাশিয়ার বর্তমানের কার্যক্রমের পাশাপাশি অতীতের কার্যক্রমও তাদের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এর আগে পুতিন রাশিয়ার দুটি ইবোলা ভ্যাকসিনকেও আফ্রিকাতে অত্যন্ত কার্যকরী ভ্যাকসিন বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু তার পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই ভ্যাকসিনগুলোকে ‘ক্যান্ডিডেট ভ্যাকসিন’ হিসাবে নথিভুক্ত করে।