আইএমএফ কী?
ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (সংক্ষেপে আইএমএফ) জাতিসংঘের একটি বিশেষ সংস্থা। এটি গঠিত হয় প্রায় ৭৬ বছর আগে, ১৯৪৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর। এর সদরদপ্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। আইএমএফ মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অগ্রসর, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির সমৃদ্ধি নিয়ে কাজ করে। একইসাথে, বহুপাক্ষিক আর্থিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা, আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধা ও প্রচার করাও এই সংস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য।
আইএমএফ মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তিনটি কাজ সম্পাদন করে:
১. অর্থায়ন,
২. সক্ষমতা বৃদ্ধি, এবং
৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ
অনেক ভালো এবং মহৎ মনে হচ্ছে, তাই না? আসলে, সত্য এত সহজ নয়। এ বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে এই লেখায়।
আইএমএফ ঋণ কী?
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সম্পূর্ণ পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। বর্তমানে ১৯০টি দেশ আইএমএফ এর সদস্য। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফ তাদের স্বল্পমেয়াদী ঋণ প্রদান করে। তাদের ব্যবহৃত অর্থের বেশিরভাগই আসে এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে, মূলত অর্থপ্রদানের কোটার আকারে। প্রতিটি সদস্য দেশের জিডিপির আকার অনুযায়ী আইএমএফ প্রত্যেককে একটি কোটা নির্ধারণ করে দেয়। যখন একটি দেশ আইএমএফ-এ যোগদান করে, তখন এটি তার কোটার এক-চতুর্থাংশ স্বীকৃত বৈদেশিক মুদ্রা (সাধারণত ডলার) এবং কোটার তিন-চতুর্থাংশ নিজস্ব জাতীয় মুদ্রায় প্রদান করে।
আইএমএফ কোনও দেশকে স্বল্পমেয়াদে ও অর্থ-বাজারের থেকে কম সুদে মোটা অংকের ঋণ প্রদান করে যাতে সেই দেশের সরকার তাদের বর্তমান দেনা-পাওনা মিটিয়ে ফেলতে পারে ও দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে। সাধারণত, কোনও রাষ্ট্র আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণ নিতে চায় না। আইএমএফ-কে বলা হয় “Lender of last resort”, কোনও রাষ্ট্র আইএমএফ-এর কাছে ঋণ চাইলে ধরে নেওয়া হয় তাদের কাছে আর কোনও উপায় ছিল না। আইএমএফ ঋণ প্রদানের সময় কিছু কঠিন ও অবশ্য-পালনীয় শর্ত প্রদান করে, যেগুলো যথাসম্ভব দ্রুত মেনে নিতে হয়। সাধারণত, রাষ্ট্রগুলো আইএমএফ-এর কাছে হাত পাততে পছন্দ করে না।
কেন রাষ্ট্রগুলো আইএমএফ-এর ঋণ পছন্দ করে না?
আইএমএফ ঋণ দেবার আগে কিছু শর্ত ও নীতি সুপারিশ করে যেন দেশগুলোর সরকার দ্রুত তাদের আর্থিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করে ও বাজারে তাদের প্রভাব আরো বিস্তার করতে পারে, যাতে তারা দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয় এবং আইএমএফ-এর ঋণ পরিশোধ করতে পারে।
এই শর্ত ও নীতিগুলো বেশিরভাগ সময়ই অত্যন্ত কঠোর হয়। আইএমএফ যে শর্তগুলো দেয় সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সরকারি খরচ কমানো, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, পুঁজি প্রবাহে বাধা দূর করা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যবসাগুলোকে বেসরকারি খাতের অধিভুক্ত করা, ভর্তুকি হ্রাস, কর বৃদ্ধি ইত্যাদি।
সমস্যা হলো, এই শর্তগুলো দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থাভেদে পরিবর্তন হয় না। ফলে কোনো দেশের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, তাদের আইএমএফ-এর ঋণ পেতে হলে এই শর্তগুলো মেনে নিতে হয়। ঋণ দেয়া হয় গ্রহীতা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায়- ঋণের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে দেশগুলো আরো গভীর সমস্যায় পড়ে যায়।
আইএমএফ-এর শর্তগুলোর বেশিরভাগই হয় অর্থনৈতিক অবকাঠামো ও রাজনৈতিক অবকাঠামোগত সংস্কারমূলক। কাঠামোগত পরিবর্তনগুলো প্রায়শই এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে যেগুলো ঋণগ্রহীতা রাষ্ট্রের নিজস্বভাবে নেওয়া উচিত ছিল, যেমন- বেশিরভাগ নাগরিককে করের আওতাভুক্ত করা, এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শক্তিশালী করা। এটা ঠিক যে এই সংস্কারগুলো রাষ্ট্রের করা উচিত, কিন্তু আইএমএফ এগুলোকে খুবই কম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলে অনেকটা ‘শক ট্রিটমেন্ট’ এর মতো। তারা আশা করে- দেশগুলো কয়েক বছরের মধ্যে কয়েক দশক ধরে যা অর্জনের জন্য লড়াই করছে তা করে ফেলবে।
আইএমএফ-এর শর্ত পূরণ করার জন্য একটি জাতির অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায়ই খারাপ হয়ে যায়, যার ফলে মন্দা, দারিদ্র্যের হার এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। তাই, সাধারণত সরকার আইএমএফ থেকে আর্থিক সহায়তা চায় না।
এমনকি আইএমএফ-এর ঋণ অস্থায়ী সাহায্য হিসেবে দেখানো হলেও সংস্থাটি নিশ্চয়তা দিতে পারেনি যে এটি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে যে ঋণ দেয় তা আসলেই অল্প সময়ের জন্য, বরং এই ঋণের ফলে দীর্ঘমেয়াদী নির্ভরতার সূচনা হয়।
এতকিছুর পরও প্রতিবারই আইএমএফ তাদের ঋণ ফেরত পেয়ে যায়। কারণ, তারা দেশগুলোর সর্বশেষ অবলম্বন, কোনো রাষ্ট্র তাদের ঋণ পরিশোধ না করলে আর কেউই সেই রাষ্ট্রকে সাহায্য করবে না।
আইএমএফে-এর শর্ত যেভাবে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করে
আইএমএফ-এর দেয়া শর্তগুলো ঋণগ্রহীতা রাষ্ট্রের মৌলিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করতে পারে না। সংস্থাটি এমন সব শর্ত আরোপ করে যার ফলে অর্থনৈতিক অবমূল্যায়ন হয়ে সাধারণ নাগরিকের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়, কিন্তু কখনোই এমন শর্ত (যেমন- খেলাপী ঋণ আদায়, বকেয়া কর আদায় ইত্যাদি) আরোপ করে না যার ফলে অভিজাত শাসক শ্রেণীর সমস্যা হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, আইএমএফ ঘন ঘন ভর্তুকি কমানোর জন্য শর্ত আরোপ করে। ভর্তুকি হ্রাস সরকারি ব্যয় কমায় বটে, কিন্তু ভর্তুকি কমানোর ফলে অবমূল্যায়িত খাতের জন্য সৃষ্ট মূদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধ্বগতি; ধনী, উচ্চশ্রেণীর শাসকদের চেয়ে সাধারণ জনগণকে বেশি প্রভাবিত করে।
বেশিরভাগ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বিভিন্ন অলাভজনক খাতে ব্যয় অব্যাহত রাখে যাতে সাধারণ জনগণের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত হয়, এর ফলে প্রায়শই দেশের বাজেটের ঘাটতি তৈরি হয়। আইএমএফ-এর ঋণ পেতে হলে এই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। ঘাটতি কমানোর জন্য সরকার বিভিন্ন খাতে কর বাড়িয়ে অথবা আরো বেশি টাকা ছাপিয়ে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে দেশের আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারে যা দেশকে নিশ্চিত মুদ্রাস্ফীতির দিকে ধাবিত করে। মূলত, এই কৌশলগুলো প্রায় কখনোই বৈদেশিক ঋণ বা বাজেটের ঘাটতি মেটাতে পারে না, উল্টো অর্থনীতিকে আরো স্থবির করে তোলে।
আইএমএফ-এর শর্তগুলো বাস্তবায়নের ফলে দেশের বেকারত্ব বাড়ে, সরকারি আয় কমে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পায়, কর ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়, পেনশন ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সব মিলে আরো বেশি মানুষকে দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রে আটকে রাখে। শ্রমবাজারকে আরো নমনীয় করা এবং প্রত্যাবর্তনশীল কর সংস্কারের করে, আয়করের হার সমান করা দারিদ্র্যের হার ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়।
অর্থনীতিকে দ্রুত রূপান্তর করার জন্য আইএমএফ যেহেতু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বৈষম্য বিবেচনায় না নিয়ে মানদণ্ড আরোপ করে, তাই এই শর্তগুলো সার্বিকভাবে সাধারণ জনগণের ক্ষতি করে এবং দরিদ্রদের আরো বেশি দরিদ্র করে তোলে।
শাসক অভিজাত শ্রেণী ঋণ করে, যা সাধারণ নাগরিকদের প্রজন্মান্তরে শোধ করতে হয়। অনেকে বলতে পারে- আইএমএফ-এর শর্তগুলো দ্বারা অর্থনৈতিক সংস্কার সাধিত হয় যা একটি রাষ্ট্রের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- সেই সংস্কারের জন্য যে মূল্য দিতে হবে তা দেবার জন্য একটি দেশের আপামর জনসাধারণ কি প্রস্তুত? অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত সংস্কার করতে হয় সঠিক পদ্ধতি ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার সাথে, ঋণ পরিশোধের জন্য তাড়াহুড়ো করে নয়।