গত কয়েক বছর ধরেই খরা, অতিবৃষ্টি আর তীব্র শীতে পৃথিবীবাসী নাকাল হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে বন্যা, দাবানল আর ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশেষজ্ঞদের মতামত- বৈশ্বিক উষ্ণতার পাশাপাশি এল নিনো ও লা নিনার প্রভাবেই এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। কিন্তু এই এল নিনো আর লা নিনা কী? পাঠকদের এসব জানাতেই আজকের লেখা।
এল নিনো ও লা নিনা
এল নিনো (El Nino) আর লা নিনা (La Nina) এই দুটি হলো স্প্যানিশ শব্দ। এল নিনো অর্থ বালক বা ছোট ছেলে, আর লা নিনা অর্থ বালিকা বা ছোট মেয়ে। নাম দুটির সাথে সমুদ্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ এই দুই অবস্থা হলো সামুদ্রিক বায়ু সঞ্চালনের ফলাফল। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এবং বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ক্রমাগত পরিবর্তন থেকেই সৃষ্টি হয় এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রশান্ত মহাসাগরের পানির তাপমাত্রার চক্রাকার পরিবর্তনের ফলে এই বৈশ্বিক জলবায়ুগত ঘটনাটি হয়ে থাকে। এর কারণে তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাত উভয়ই প্রভাবিত হয়।
মূলত এই ঘটনা ১৬০০ সালের দিকে পেরুর জেলেরা প্রথম বুঝতে পেরেছিল। তারা লক্ষ্য করেছিল যে ডিসেম্বরে দক্ষিণ আমেরিকার কাছে পানি উষ্ণ হতে শুরু করে। স্প্যানিশ ভাষায় এই ঘটনাকে এল নিনো বলে। এল নিনোর আগমনের সাথে ক্রিসমাসের সময়ের মিল থাকায় পেরুর জেলেরা একে হিসেবে নাম দিয়েছিল যিশুর ছেলে। এরপর ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞানী গিলবার্ট দেখান যে এল নিনো বা লা নিনার সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক আছে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জলবায়ু চক্র তিন প্রক্রিয়ায় আবর্তিত হয়। আর এই প্রক্রিয়াটি এনসো (ENSO) চক্র নামে পরিচিত। এই এনসো চক্রের তিনটি পর্যায় রয়েছে: এল নিনো, লা নিনা আর এনসো নিউট্রাল বা নিরপেক্ষ পর্যায়। আবহাওয়ার শুষ্ক মৌসুম হলো এল নিনো পর্যায়, যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাত কমে যায় আর বন্যাও কম হয়। তবে এ সময় তাপমাত্রা অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। আর লা নিনার সময় বৃষ্টিপাত ও বন্যা বেশি হয়। তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়।
স্বাভাবিক সময়ে নিরক্ষরেখার চারপাশের বাণিজ্য বায়ু বা অয়ন বায়ু প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলগুলো থেকে উষ্ণ পানি বয়ে আনে। পশ্চিম দিকে যেতে যেতে এই বাতাস পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর থেকে সেই উষ্ণ পানি সমুদ্রের শীতল এলাকায় নিয়ে যায়। নিরপেক্ষ পর্যায়ে গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের স্বাভাবিক তাপমাত্রা -২ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে থাকে।
এল নিনো পর্যায়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরক্ষরেখার চারপাশে পানি উষ্ণ হতে থাকে। এসময় পূর্ব দিকের বাণিজ্য বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। পেরুর উপকূলে এবং বিষুবরেখা বরাবর উর্ধ্বমুখী সমুদ্রস্রোতও দুর্বল হয়ে পড়ে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে ভূপৃষ্ঠের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ হয়ে ওঠে। এ সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কয়েক মাস বা এমনকি ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে।
লা নিনা পর্যায়ে পূর্বদিকের বাণিজ্য বায়ু শক্তিশালী হতে শুরু করে। নিরক্ষরেখা এবং পেরুর উপকূল বরাবর শক্তিশালী ঠান্ডা সমুদ্রস্রোতে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে পানির উষ্ণতা বজায় রাখে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে ভূপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে শীতল হয়ে ওঠে।
সাধারণত চক্রের এই অবস্থা ৯ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত চলতে পারে। আবার কখনো কখনো তা ৩ বছর পর্যন্তও স্থায়ী হয়। সাধারণত ২-৭ বছর পর পর এই চক্র ফিরে আসতে পারে। সাধারণত এল নিনো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লা নিনা আসে। তবে সব সময় এল নিনোর পর পরই যে লা নিনা হবে এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ ১৯৭৬-৭৭ সালের এল নিনোর পর ১৯৭৭-৭৮ সালে আবারো এল নিনো হয়েছিল। এরপর ১৯৮৮ সালে লা নিনা এসেছিল।
ইতিহাস
এল নিনো এবং লা নিনা প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনা বহুবার হয়েছে। ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে অত্যন্ত শক্তিশালী এল নিনো ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মেক্সিকো ও চিলি পর্যন্ত প্রচুর বন্যা এবং ক্ষতি করেছিল। আর ১৯৮৮ সালের লা নিনার ঘটনায় উত্তর আমেরিকা জুড়ে খরা দেখা দেয়।
গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত লা নিনার প্রভাবে তাপমাত্রা কমেছে এবং কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে টানা তৃতীয়বারের মতো চলমান বিরল লা নিনার বৈশ্বিক শীতল প্রভাব সত্ত্বেও, ২০২২ সাল পৃথিবীর ষষ্ঠ উষ্ণতম বছর ছিল। আর এটি এশিয়া এবং ইউরোপের জন্য রেকর্ড দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর ছিল।
২০১৫-১৬ এর শক্তিশালী এল নিনো সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হিসেবে রেকর্ড করেছে। এসময় ইন্দোনেশিয়ায় ব্যাপক দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল, আর পেরু ভয়ঙ্কর বন্যার সম্মুখীন হয়েছিল। গত ৭০ বছরের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার রেকর্ড বিশ্লেষণ করে গবেষকরা ‘এল নিনো সাউদার্ন অসিলেশন’ বা এনসো’র মধ্যে পরিবর্তন খুঁজে পেয়েছেন। তাদের ধারণা বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে ২০৩০ সালের মধ্যে শক্তিশালী লা নিনা এবং এল নিনো শনাক্ত হবে।
গত ৫০ বছরে এল নিনো হয়েছিল ১৪ বার এবং লা নিনা হয়েছিল ১২ বার। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এ ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে বলে জলবায়ু বিজ্ঞানীদের ধারণা। সবশেষ এল নিনো ঘটে ২০১৬ সালে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার পেছনেও এল নিনো কাজ করে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনও এল নিনো এবং লা নিনার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
প্রভাব
সাধারণত প্রতি বছর প্রশান্ত মহাসাগরের বায়ুর কারণে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এশিয়ায় দিকে তাপ প্রবাহিত হয়। কিন্তু এল নিনো পর্যায়ে মধ্য এবং পূর্ব গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগর উল্লেখযোগ্যভাবে গরম হয়ে ওঠে। ফলে প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে মেঘের গঠন ও আবহাওয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, আর পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় বৃষ্টিপাত কমে যায়। আর লা নিনা পর্যায়ে মধ্য এবং পূর্ব গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পানি বেশ শীতল হয়ে যায়। ফলে অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ অংশে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
এল নিনো ও লা নিনার কারণে পৃথিবীর সামগ্রিক আবহাওয়ায় বেশ পরিবর্তন আসে, যেমন- আমেরিকার উত্তর দিকে এবং কানাডাতে শীতকালেও গরম পড়ে। আমেরিকার পশ্চিমে, পেরু ও ইকুয়েডরে গ্রীষ্মকালে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। এল নিনোর সময়ে আটলান্টিক সমুদ্রে হারিকেনের মাত্রা অনেক কমে যায় ও সমুদ্রের লবণাক্ততার মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয়।
গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরের লা নিনার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে উষ্ণ ও শুষ্ক শীত এবং প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম, আলাস্কায় আর্দ্র ও শীতল অবস্থার সৃষ্টি হয়। লা নিনা সাধারণত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে হারিকেনের কার্যকলাপও কমিয়ে দেয় এবং আটলান্টিকে এর মাত্রা বৃদ্ধি করে দেয়। এল নিনোর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণে অত্যধিক শীত এবং আলাস্কা ও উত্তর-পশ্চিম কানাডায় মৃদু শীত অনুভুত হয়।
এল নিনোর সময় ভারত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার ভূপৃষ্ঠের চাপ বেড়ে যাওয়া, প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বে বায়ুমণ্ডলের চাপ বেড়ে যাওয়া, পেরুর নিকটে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, আর এই উষ্ণ বাতাস উপরের দিকে উঠে পেরুর উত্তরে বৃষ্টিপাত ঘটায়। সাগরের পূর্বদিকের উষ্ণ পানি পশ্চিমে চলে আসে এবং সেখানকার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ৩০ সেন্টিমিটারেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে দেখা দেয় খরা। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াতে জলজ প্রাণীর জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে পড়ে। পেরুর সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় মৎসপ্রজাতির সংখ্যা কমে যায়। অন্যদিকে লা নিনার সময় এল নিনোর সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা ঘটে। এসময় পেরু এবং চিলির পূর্ব উপকূলে সমুদ্রের তাপমাত্রা জলজ প্রাণীর জীবনধারণের অনুকূলে থাকার কারণে সেখানে প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়, উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যায় আর তীব্র শীত ও তুষারপাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে কানাডা।
এল নিনো ও লা নিনা বিষুবরেখার আশেপাশের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে রয়েছে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এই দেশগুলোর অধিকাংশই দরিদ্র অঞ্চল। আর এই অঞ্চলগুলো কৃষির উপর অধিক নির্ভরশীল। অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি ফসলের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। আফ্রিকার ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, নাইজার, চাদ, সাহারা মরুভূমি এবং সুদানের মতো এলাকার বাসিন্দারা ইতোমধ্যেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। নিরক্ষরেখার কাছাকাছি হওয়ায় এ অঞ্চলগুলো বেশিরভাগ সময়ই শুষ্ক থাকে, কারণ মৌসুমী বায়ু এদেশগুলোতে পৌঁছানোর আগেই আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে। এল নিনোর ফলে সৃষ্ট খরা ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে ইথিওপিয়াতে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে, যার ফলে ফসল এবং গবাদি পশুর ক্ষতি হয়েছে।
এল নিনোর প্রভাবে মেকং নদীর পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে গেছে। ফলে শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনামে খরা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সেখানকার ফসলি জমির প্রায় অর্ধেকই লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে। মালয়েশিয়ায়, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াতেও সংকট দেখা দিয়েছে।
গবেষকদের মতামত, ১৯৮২ এবং ১৯৯৭ সালে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় শক্তিশালী এল নিনো সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় এল নিনোর কারণে ইকুয়েডর এবং পেরুর কিছু অংশ ভয়ঙ্কর বন্যার শিকার হয়। নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক ড. আগুস সান্তোসো বলেছেন, “ভবিষ্যতে দীর্ঘায়িত খরা এবং চরম বন্যার জন্য আমাদের আরও প্রস্তুত হওয়া উচিত। অবকাঠামোর দিক থেকে বন্যা খরার চেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক, যদিও কৃষির ক্ষেত্রে খরার প্রভাব বেশি। উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি রয়েছে।“
২০২৩ সাল কি এল নিনো বছর হতে যাচ্ছে?
বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন ২০২৩ সালে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে গোটা বিশ্ব। অর্থাৎ, এই বছর এল নিনো ফিরে আসার সম্ভাবনা ব্যাপক। ফলে উত্তর আমেরিকায় ভারী বৃষ্টিপাত, ইউরোপে তীব্র তাপদাহ এবং ব্রাজিল থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত দেশগুলোতে খরার কারণে ফসল নষ্ট হতে পারে। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রত্যাশিতভাবে এল নিনো ফিরে আসার কারণে ২০২৩ বা ২০২৪ সালে বিশ্বে গড় তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড হতে পারে।
বৈজ্ঞানিক সংস্থা আইপিসিসি (IPCC), যা নিয়মিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর গবেষণার রিপোর্ট দিয়ে থাকে। তারা দেখিয়েছে যে এল নিনোর কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতার মধ্যে পরিবর্তন আসছে। ফলে ভবিষ্যতে এল নিনো আরো শক্তিশালী হচ্ছে।
রয়টার্সের মতে, রেকর্ড অনুযায়ী এ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর ছিল ২০১৬, আর ওই সময় শক্তিশালী এল নিনো সক্রিয় ছিল। আর গত আট বছর ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম আটটি বছর। এছাড়া গ্রিন হাউজ প্রভাবের কারণে সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদি উষ্ণায়ণের ফলেও এর মাত্রা বেশি অনুভূত হয়েছে। তিন বছরে বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা রেকর্ড মাত্রার কাছাকাছি ছিল, তবে দীর্ঘায়িত লা নিনার শীতল প্রভাব না থাকলে এটি আরও বেশি হতো।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ফ্রেডেরিক অটো বলেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এল নিনোর কারণে সেখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। দেশগুলোতে মারাত্মক তাপপ্রবাহ, খরা ও দাবানল দেখা দিতে পারে। এছাড়া মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো অব্যাহত রাখায় বিশ্ব আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে। তাই এল নিনো শুরু হলে ২০২৩ সাল ২০১৬ সাল থেকেও বেশি উষ্ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে।“
জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং বন ধ্বংসের ফলে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি ২০২৩ সালে এল নিনো ফিরে আসে, তাহলে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। উল্লেখ্য, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা এই স্তরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিশ্ব নেতারা।
বাংলাদেশে এল নিনোর প্রভাব
এল নিনোর প্রভাবে বৈশ্বিক জলবায়ুর অবস্থা বেসামাল। অত্যন্ত শক্তিশালী এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বের অনেক অঞ্চলের তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে গেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে, কিছু জায়গায় ৪২ ডিগ্রিও ছুঁয়েছে। প্রচন্ড তাপে পুড়ছে ফসলের মাঠ, ধান ও সবজির ক্ষেত, অসময়ে ঝরে যাচ্ছে ফলের মুকুল। বাড়ছে ডায়রিয়া, হিটস্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যা।
এই বছর জুলাই, আগস্ট বা সেপ্টেম্বর নাগাদ এল নিনো হওয়ার ৮০% সম্ভাবনা রয়েছে, অথবা এটি অক্টোবর, নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ঘটতে পারে। যা-ই হোক না কেন, এল নিনোর একটি ব্যাপক বৈশ্বিক প্রভাব থাকবে। আর এই বছরের এল নিনোর কারণে বাংলাদেশে আগামী ছয় থেকে আট মাস স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ তাপমাত্রা, শুষ্ক জলবায়ু এমনকি ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপও বৃদ্ধি পেতে পারে।
সাধারণত এল নিনো বছরগুলোতে বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়, ফলে সেখানে খরা দেখা দেয়। যেমন, ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৯৭ সালের খরা। এবছর বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতও কম হয়েছে। ১৯৬৩, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৯১, ১৯৯৭ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড়গুলোও এল নিনো বছরগুলোতে হয়েছিল। তবে ব্যতিক্রমভাবে ২০০৭ সালের সিডর ও ২০০৯ এর বিজলি হয়েছিল লা নিনা বছরে। আর আইলা হয়েছিল লা নিনা ও এল নিনোর মাঝে। অর্থাৎ এল নিনো বা লা নিনা বছরেই বাংলাদেশে বড় ঝড়গুলো হয়েছে। এল নিনোতে সৃষ্ট খরার কারণে বাংলাদেশে পানি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। এছাড়া কম বৃষ্টিপাতের ফলে পানি সরবরাহেও ব্যাঘাত ঘটবে। নদীর স্তর শুকিয়ে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের লোনা পানি প্রবেশ করবে, যার ফলে এই উৎসের উপর নির্ভর করা বাসিন্দারা পানীয় জলের সঙ্কটে পড়বে। তবে পানির এই সমস্যা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়; আর এল নিনো ছাড়াও বাংলাদেশে মারাত্মক পানির ঘাটতি রয়েছে।
এছাড়া কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেলে শহরগুলো খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জে পড়বে। ফলে শহরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের কৃষিতে এল নিনো শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন- পানির ঘাটতি, মাটি ক্ষয় এবং রোপণ মৌসুমে ব্যাঘাত ঘটা। বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে ধানের ফলন হ্রাস পাবে। এতে খাদ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে। এল নিনোর সময় খরা ও বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করতে পারে, যেমনটি ১৯৯১ ও ১৯৯৭ সালে হয়েছিল। খরা পরিস্থিতির জন্য জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণীও হুমকির মুখে পড়বে।
পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন, এল নিনো ও লা নিনা স্বাভাবিক বিষয় হলেও মানুষের অবিবেচক কর্মকাণ্ড পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলছে। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে অতিরিক্ত গাছ কেটে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে, জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুকে দূষিত করছে আর অতিরিক্ত পরিমাণে যানবাহন ও কলকারখানাসহ কার্বন নিঃসরণকারী কার্যক্রমকে বৃদ্ধি করছে। এসবের ফলে পৃথিবীতে জীবনধারণ অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ছে। তাই আমরা যদি একটি বাসযোগ্য গ্রহ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে উপহার দিতে চাই, তবে অবিলম্বে আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি।