ফ্যাক্টচেকিং বিষয়ক ধারণাটি সারাবিশ্বেই এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে। সাধারণত তথ্য, ছবি, ভিডিও এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো যাচাই করে তা সঠিক কিনা তা নির্ণয় করাই ফ্যাক্টচেকিংয়ের মূল উদ্দেশ্য। এই বিষয় নিয়ে কাজ করতে দেশে দেশে ফ্যাক্টচেকিংয়ের আলাদা সংস্থাই গড়ে উঠেছে। বহির্বিশ্বে গেল শতাব্দীর শুরুর দিকে ধারণাটির প্রচলন হলেও ফ্যাক্টচেক বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সংস্থা গড়ে উঠতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অবশ্য বিষয়টি একেবারেই নতুন। মূলত ২০১৭ সাল থেকে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা গড়ে উঠতে শুরু করলেও অধিকাংশ মানুষ এখনও ধারণাটির সাথে অভ্যস্ত নয়। এ বিষয়ে ধারণা পেতে তাই পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন হতে পারে আপন দাসের লেখা ‘ফ্যাক্টচেকিংয়ের প্রথম পাঠ’ বইটি।
শুরুতেই আপন দাসের বিষয়ে জানা যাক। বাংলাদেশের অন্যতম ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা ‘ফ্যাক্টওয়াচ’ এ প্রায় আড়াই বছর ফ্যাক্ট চেকার হিসেবে কাজ করেছেন আপন দাস। বর্তমানে নৃবিজ্ঞান বিষয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন। এর আগে বাংলাদেশে ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টসের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। নিজের লেখা প্রথম এই বই ছাপাতে গিয়ে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে তাকে। তার ভাষ্যমতে, প্রতিষ্ঠিত একাধিক প্রকাশনীর সাথে যোগাযোগ করেও বইটি ছাপাতে পারেননি তিনি। পরবর্তীতে ফেনীর একটি প্রকাশনীর মাধ্যমে বইটি বাজারে আসে।
আপন তার বইটি পাঁচটি অধ্যায়ে সাজিয়েছেন। বইয়ের ভূমিকা পড়ে বোঝা গেল, তার ফ্যাক্টচেকিং পেশার পুরো অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন তিনি।
বইটি পড়ার শুরুতেই খটকা লাগতে পারে। কারণ বইয়ের শুরু হয়েছে ১৪৬ পৃষ্ঠা থেকে। শেষ হয়েছে ২৮৩ পৃষ্ঠায় গিয়ে। অদ্ভুতুড়ে পৃষ্ঠা সংখ্যার এমন ভুল কাম্য নয়। আরেকটি বিষয় দৃষ্টিকটু লেগেছে, বইতে স্থান পাওয়া ছবি বা স্ক্রিনশট যে পাতায় দেওয়া, তার ক্যাপশন চলে গেছে ভিন্ন পাতায়। পাঠক হিসেবে আশা করি, এই ধরনের সমস্যাগুলো পরবর্তী সংস্করণে আর থাকবে না।
এসব সমস্যার বাইরে ফ্যাক্টচেক বিষয়ে বাংলাদেশের প্রথম এই বাণিজ্যিক বইয়ের কন্টেন্ট বেশ সমৃদ্ধই মনে হলো। বইটির মাধ্যমে লেখক শুরুতে ফ্যাক্টচেকের ইতিহাস ও সংজ্ঞা বিষয়ক প্রাথমিক ধারণা দিয়েছেন। এই আলোচনায় যেমন বহির্বিশ্বের প্রসঙ্গ এসেছে, তেমনি বাংলাদেশে ফ্যাক্টচেক বিষয়ক সামগ্রিক একটি ধারণাও যে কেউই পেয়ে যাবেন বইটি থেকে।
ফ্যাক্টচেকের সাধারণ বিষয়গুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে আপন তার বইয়ে তথ্যের রকমফের ও যাচাইযোগ্যতা নিয়ে লিখেছেন। ফ্যাক্টচেকাররা যখন কোনো তথ্য যাচাই করেন তখন তাদের অনুসন্ধানে তথ্যটি কখনও পুরোপুরি মিথ্যা, কখনও বা তথ্যের একাংশ মিথ্যা বা গরমিল তথ্যের মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে দেখেন। এ বিষয়ে তারা যখন প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তখন তথ্যের রকমফের অনুযায়ী নির্ধারিত কিছু রেটিং দিয়ে থাকেন। আপন বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিতই লিখেছেন একটি অধ্যায়ে। তবে এড়িয়ে গেছেন একটি বিষয়। সাধারণত যাচাই করতে গিয়ে কোনো তথ্য যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তখন বিভিন্ন মাপকাঠি নিয়ে আলোচনা সাপেক্ষে এ নিয়েও ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন করা হয়। সত্য রেটিং দিয়ে প্রকাশিত এই ধরনের ফ্যাক্টচেক এখন বেশ কিছু ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাই করছে। আপন বিষয়টি উল্লেখ করেননি তার লেখার প্রাসঙ্গিক অংশে।
ফ্যাক্টচেকিং বিষয়ে যারা ধারণা রাখেন কিংবা ফেসবুকে যারা নিয়মিত গণমাধ্যমের পোস্ট দেখে থাকেন, তারা খেয়াল করে থাকবেন, অনেক সময় শিরোনাম এবং সংবাদের বিস্তারিত অংশে মিল না থাকায় গণমাধ্যমের সংবাদ ভুল বার্তা দেয় পাঠকদের। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গণমাধ্যমে শিরোনাম দেখলেন মেট্রোরেলে একটি মেয়ে নেচে ভাইরাল হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই স্থানের নাম উল্লেখ না থাকায় আপনি ধরেই নেবেন ঘটনাটা বাংলাদেশেরই হবে। কিন্তু বিস্তারিত প্রতিবেদন পড়তে গিয়ে জানলেন, এটা আসলে ভারতের ঘটনা। সমস্যা হচ্ছে, বিস্তারিত প্রতিবেদন খুব কম পাঠকই পড়েন। ফেসবুক পোস্ট আর খবরের শিরোনাম দেখেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান তারা। এতে পাঠকরা একধরনের প্রতারিতই হচ্ছেন বলা যায়। আলোচিত বইতে এই প্রসঙ্গটি এসেছে। এটা সাধুবাদের দাবি রাখে।
আরেকটি বিষয় প্রায়ই গণমাধ্যমগুলোতে চোখে পড়ে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একটি গণমাধ্যম একটি খবর প্রকাশ করলে সেটি যাচাইবাছাই না করে অন্য গণমাধ্যমগুলো কিছু শব্দ বা লাইন পরিবর্তন করেই প্রায় হুবহু কপি করছে। এখন খবরটি যদি মিথ্যা বা ভুল হয় তাহলে এই কপির কারণে গণমাধ্যম থেকে গণমাধ্যমে যাচাই ছাড়াই ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। আপন এ প্রসঙ্গে আওয়াজ তুলেছেন তার বইতে। লিখেছেন, এক্ষেত্রে কপিরাইট আইন বাস্তবায়ন জরুরি।
বইতে আপন একটি গবেষণার বরাতে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া গুজবের ১৮ শতাংশের উৎসই গণমাধ্যম। এক্ষেত্রে দুটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থার (রিউমর স্ক্যানার এবং বুম বাংলাদেশ) করা গণমাধ্যমের ভুলের দুটি পরিসংখ্যানও উঠে এসেছে তার লেখায়।
লেখক তার বইয়ের শেষ অংশে ফ্যাক্টচেকিংয়ের কলাকৌশল ও প্রয়োজনীয় টুলগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন যা গণমাধ্যমকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ একজন মানুষের জন্যও দারুণ সহায়ক হয়ে উঠতে পারে।
ফ্যাক্টচেক প্রসঙ্গটি যেহেতু তথ্য যাচাইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেহেতু ফ্যাক্টচেক বিষয়ক এই বইয়ে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, আপন সেসব যাচাই সাপেক্ষেই উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে তথ্যসূত্র যুক্ত থাকা তারই প্রমাণ দেয়। নন-ফিকশন বইয়ের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এটি একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। বইটি পড়ে সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও যেকোনো পাঠক সহজে ফ্যাক্টচেকের বিষয়ে ধারণা পাওয়ার ভিত্তিতে গুজব রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন, প্রত্যাশা থাকুক এমনই।
সংক্ষিপ্ত বই পরিচিতি
বই: ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রথম পাঠ
লেখক: আপন দাস
প্রকাশকাল: ২০২৩
প্রকাশনী: হাইপারস্পেস
প্রচ্ছদশিল্পী: সজল চৌধুরী
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৩৭
মুদ্রিত মূল্য: ৫০০ টাকা