“জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্থান চলিয়া গিয়াছি। ইতি সোনা”
দেশভাগের পটভূমিতে সোনাদের পরিবার চলে গেল ওপারবাংলায়। দেশ, ভিটেমাটি, সোনালি বালির চর, সেই কিংবদন্তির খাল যেখানে ফি বছর একটা করে মানুষ ডুবে মরে, বাল্যবন্ধু ফতিমা আর খেলার সাথী ঈশম চাচা- সমস্ত কিছু ছেড়ে। পূর্ব বাংলা থেকে চলে গেল হাজারও হিন্দু পরিবার নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে। কিন্তু নীলকণ্ঠ পাখি যে কী! সবাই খুঁজে চলেছে এ পাখি।
কারো কাছে নীলকণ্ঠ পাখি নারী, কারো কাছে স্বামীসুখ, কারো কাছে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন, কারো কাছে বা স্বাধীনতা। নীলকণ্ঠ পাখি হচ্ছে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা যার জন্যে সে সারাজীবন ঘুরে ঘুরে মরে। কিন্তু পায় না। অথচ অস্তিত্বহীন নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজেই মানুষের ধেয়ে চলা।
ঢাকা জেলার হিন্দু মুসলান অধ্যুষিত রাইনাদী গ্রামের মানুষের জীবন-যাপন নিয়েই এগিয়েছে উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ। ধর্ম তাদের ভিন্ন, ধনী-গরিব ফারাকও আছে বেশ। কিন্তু উৎসব-পরবের দিনে মেতে ওঠে সকলে। আর তাই ঠাকুরবাড়ির ঢাকের বাজনায় দূরগ্রামে শ্বশুরবাড়িতে আনচান করে ওঠে মুসলমান ঘরের মেয়ে জোটনের মন। সেবারের বর্ষায় ঠাকুরবাড়ির সেজ ঠাকুর চন্দ্রনাথের ছেলে হলো- নাম তার সোনা। পরিবারের ছোট ছেলে হওয়ায় সকলের বড়ো আদরের সে। সোনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার বড়ো জ্যাঠামশাই মণীন্দ্রনাথ, যিনি পিতৃসত্য পালনে পাগল বনে গিয়েছিলেন। সোনার মা, জেঠিমা, লাল্টু, পল্টু, ছোটো কাকা শচীন্দ্রনাথ, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা সবনিয়ে একান্নবর্তী পরিবারের সেই চিরায়ত ছবি। গোপাটের ওধারে নরেন দাসের তাঁতঘর। নরেন দাসের বিধবা বোন মালতী যার স্বামী মারা গেছে ঢাকার দাঙ্গায়।
এদিকে মুসলমান পাড়ায় রয়েছে সামসুদ্দীন, সবাই ডাকে সামু। সামু জড়িয়ে পড়ছে মুসলীম লীগের সক্রিয় রাজনীতিতে। রয়েছে আবেদালি যে রুটি-রুজির জন্যে করে দিনমজুরি। অভাবের সংসার। ভাতের অভাবে বেশিরভাগ দিনই আবেদালির স্ত্রী জালালি বিলের শাপলা শালুক সিদ্ধ করে খেয়ে খিদে দমায়। আবেদালির অবাধ্য ছেলে জব্বার। কাবাডি খেলায় কসরত দেখিয়ে যে নাম করেছে সে ফেলু শেখ, সবাই ডাকে ফ্যালা। ফ্যালা এক ছেলে বটে! দিনদুপুরে এক ব্যবসায়ীর গলায় পোঁচ মেরে তুলে এনেছে তার বিবিকে। গয়না নৌকার মাঝি ঈশম শেখের কথা বলতেই ভুলে গেছি। সে মুসলমান পাড়ায় পঙ্গু স্ত্রীকে নিয়ে থাকে বটে, কিন্তু ঠাকুরবাড়ির চাকর হওয়ায় তাকে সবাই বলে বিধর্মী।
মাটির গন্ধ লেগে রয়েছে রাইনাদী গ্রামের আনাচেকানাচে। আর রয়েছে নানা রূপকথা। কিন্তু হঠাৎ কোত্থেকে ধর্মকে পুঁজি করে একদল লোক নেমে পড়লো বিদ্বেষ ছড়াতে। পর পর বেশ কয়েকটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধলো আশেপাশের গ্রামগুলোতে। মুসলিম যুবক কর্তৃক এক হিন্দু রমণীর শ্লীলতাহানি, মন্দিরের পাশে নামাজ পড়া নিয়ে ঝামেলা এসবই ছিল দাঙ্গার বিষয়বস্তু। কেউ বলে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, কেউ বলে বন্দে মাতারম। দেশভাগের প্রস্তাব আর তাতে এক প্রত্যন্ত গ্রামের নানা স্তরের মানুষের ভিন্নধর্মী প্রতিক্রিয়াকে লেখক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তবধর্মীভাবে তুলে এনেছেন।
উপন্যাসে রাজনৈতিক ইতিহাসের চেয়ে পূর্ব বাংলার একটি গ্রামের সামাজিক অবস্থা এবং মানুষের চিন্তাধারার পরিবর্তনের ধারাকে তুলে আনা হয়েছে অত্যন্ত সরল-সোজাভাবে। এ সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একদিন ঈশম শেখের তরমুজের মতো করে সোনার দেশকে করা হলো টুকরো টুকরো। অ্যাট লাস্ট দ্য সেলফিশ জায়ান্ট কেম! স্বার্থপর দৈত্য যে আর কিছুই নয়, সে স্বাধীনতা।
উপন্যাসে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনা বার বার বিভূতিভূষণের আরণ্যকের কথা মনে করিয়ে দেয়। সাদা জ্যোৎস্না, গন্ধপাদালের ঝোপ, অর্জুন গাছ, নদী তীর, তরমুজ ক্ষেত আর ফসলের মাঠ। ঝুম বৃষ্টিতে মা বোয়ালের নদীতে ডিম ছাড়া আর কাচ পোকা দিয়ে টিপ পরবার গল্প ছোট্ট অথচ কী যে নিখুঁত!
এটি দীর্ঘ কলেবরের উপন্যাস। পুনরাবৃত্তি ও ঘটনার ধীরগতিতে পাঠকমনে স্থবিরতা আসতে পারে। কিন্তু নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সংযোজন তা অস্বীকার করবার উপায় কিন্তু নেই। সেজন্যই এ উপন্যাসকে বলা হয়ে থাকে এই উপমহাদেশের বিবেক। এককথায়, দেশভাগের প্রেক্ষাপটে বাংলার দু’সম্প্রদায়ের মানুষের আবেগ-অনুভূতি, অপ্রাপ্তি আর আত্মিক সম্পর্কের পারস্পরিক বন্ধনের দলিলের নাম ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’।