
ইশারা করতেই ট্যাক্সিক্যাব থামল। ড্যাশ মাউন্ট ক্যামেরায় ক্যাবে ওঠা দুই যাত্রীকে দেখতে পায় দর্শক। একজন স্বঘোষিত ছিনতাইকারী, আরেকজন স্কুল শিক্ষক। বেশ ঝড়ো কথাবার্তার বিনিময় হচ্ছে দু’জনের মধ্যে। ইরানের শরীয়া আইন মোতাবেক ফাঁসির দণ্ডাদেশ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বলছে দু’জনে। ছিনতাইকারী এ আইন জারি রাখার পক্ষে বলছে, আরেকদিকে পেছনের সিটে বসে স্কুল শিক্ষক আইন রদ করার পক্ষে বলছে, তার কাছে ব্যাপারটি যথেষ্ট অমানবিক; তাই সে সাপেক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছে।
ড্যাশ মাউন্ট ক্যামেরা রাস্তায় কী হচ্ছে, তা লক্ষ করার চাইতে ক্যাবের ভেতরের এই উত্তেজিত পরিবেশেই তার ফোকাস ধরে রাখতে আগ্রহী বেশি। গন্তব্যস্থলে এসে যাত্রী দু’জন ভাড়া পরিশোধ করতে চাইলে, ভাড়া নিতে চান না ক্যাবচালক। ক্যাবচালক কে, সেটা তখনো উন্মোচিত হয়নি দর্শকের সামনে। সেটা উন্মোচিত হয় ক্যাবের পরবর্তী যাত্রী ক্যাবে ওঠা মাত্রই।
ক্যাবের পরবর্তী যাত্রী একজন পাইরেটেড ডিভিডি বিক্রেতা। ক্যাবে উঠে ক্যাবচালককে দেখে একগাল হাসি উপহার দিলেন এই ডিভিডি বিক্রেতা। ক্যামেরাও এবার চালকের দিকে ঘোরে। চালকের আসনে বসে আসেন খোদ জাফর পানাহি! সেই পানাহি, ইরান সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অপরাধে (?) ২০১০ সালে যাকে ৬ বছরের জন্য গৃহবন্দী রাখার আদেশ এবং ২০ বছরের জন্য সিনেমা নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইরান সরকার।
কিন্তু সরকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে পরের বছরই বানিয়ে ফেললেন ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’ (২০১১) নামক সিনেমাটি, যেই সিনেমার রিল কেকের ভেতর ঢুকিয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠানো হয়! পানাহির অকুতোভয় স্বভাব আর ফিল্মমেকিং প্যাশনের কথা কমবেশি সবারই জানা, যারা পানাহির কাজের সাথে পরিচিত। তাই সেই সংলগ্ন কথাবার্তায় বক্তব্যের অহেতুক দীর্ঘায়ন না করে ফেরত আসা যাক ‘ট্যাক্সি/ ট্যাক্সি তেহেরান’ প্রসঙ্গে।

Image Source: Jafar Panahi Film Production
পূর্বের দু’টি সিনেমা ঘরের চার দেয়ালের মাঝে চিত্রায়িত হলেও, গৃহবন্দী অবস্থায় ‘ট্যাক্সি’ই প্রথম সিনেমা ঘরের চার দেয়ালের বাইরে। এ সিনেমায় পানাহি তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে পেরেছেন ইরানের বাইরের পরিবেশে। আরো বেশি মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছেন, যদিও তার ক্যামেরা ভেতরের পরিস্থিতিটুকু তুলে ধরাতেই বেশি মনোযোগী। চলমান ইমেজে, পানাহি একটি ট্যাক্সি ক্যাবের রোজকার ব্যস্ততা ধারণ করার পাশাপাশি একাধিক অনুষঙ্গে ইরান সরকারের অতিনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা তুলে এনেছেন সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে।
‘ট্যাক্সি’ মূলত ডকুফিকশন। তবে সিনেমার অনেক দৃশ্যেই পানাহি ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্যপন্ন অবস্থার কথা উল্লেখ করে ডকুমেন্টারি আর ফিকশনের মাঝের অংশটি ধূসর রেখায় রেখে দিয়েছেন। ট্যাক্সি স্ক্রিপ্টেড, কিন্তু কোনো অভিনেতা দিয়ে নয় বরং ভিড় থেকে কিছু সাধারণ মানুষকে চরিত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। তবে চরিত্রগুলো ঠিক চরিত্র নয়, বরং পানাহির একাধিক বক্তব্যের একেকটি বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে তারা। চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়েই এক-একটি বক্তব্যের অবতারণা করেছেন, পানাহি। সিনেমার দ্বিতীয় যাত্রী; সেই পাইরেটেড ডিভেডি বিক্রেতা, যে মনে করে, পাইরেটেড ডিভিডি বিক্রি করে সে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন করছে, তার সাথে পানাহির আলাপচারিতায় ইরান সরকারের সর্বক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার কথা উঠে আসে। সে কথাতেই ইরান সরকারের শিল্পীদের অবদমিত করে রাখার চেষ্টা ও শিল্পের বিশালতাকে তাদের রক্ষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে খারিজ করার চেষ্টার কথা স্পষ্ট প্রকাশ পায়।
পরবর্তী যাত্রী, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়া স্বামী ও তার স্ত্রী। স্বামীর কিছু হয়ে যাওয়ার আগে, স্বামী চান স্ত্রীকে তার সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ করে যেতে এবং প্রমাণস্বরূপ তা ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করে যেতে চান, যাতে ইরানের ইসলামিক আইন অনুযায়ী সেই সম্পত্তি তার ভাই, ভাইয়ের সন্তানেরা ভোগদখল করতে না পারে। এই ঘটনা সূক্ষ্মভাবে এটিও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রযুক্তি কীভাবে ইরানের সমাজব্যবস্থায় একটি বড়সড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে এবং রক্ষণাত্মক ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
এরপর ক্ষণিকের প্রাণবন্ত মুহূর্ত আর খানিকটা কমিক রিলিফ পাওয়া যায় পানাহি আর তার ছোট্ট ভাগ্নি হানার বাকপটুতায়। হানা তার ডিজিটাল ক্যামেরায় আশেপাশের সবকিছুই ধারণ করছে তার ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে জমা দিতে হবে বলে।

Image Source: Jafar Panahi Film Production
তার স্কুলের ম্যাডাম বলেছে, ‘নোংরা বাস্তবতা’ না ধারণ করে সবসময় ইতিবাচক কিছু ধারণ করতে, সবকিছু ‘পশ’ রাখতে। পশ না রাখলে সে সিনেমা হবে অবণ্টনযোগ্য। এ কথার গভীরের আলাপ, ইরানের হিপোক্রেসি ছোট্ট হানার বুঝে না আসলেও ভাগ্নির কথা শুনে স্মিত হাসেন পানাহি। সেই হাসিতে শুধু ব্যঙ্গই প্রকাশ পায়। কারণ ওই দাগে পানাহির সব সিনেমাই যে অবণ্টনযোগ্য। এই হিপোক্রেসি, বালখিল্যতাকে তোয়াক্কা করেন না পানাহি।
এই নিয়ন্ত্রিত বিষয়সূচিকে দূরে ঠেলে হানা প্রকৃত শিক্ষাটা পেতে পারে তার মামার সিনেমা থেকে। এই কথোপকথন থেকে উঠে আসা বার্তা শুধু হানার ক্ষেত্রেই নয় বরং ইরানের প্রতিটি স্বপ্নবাজ তরুণ চলচ্চিত্র নির্মারতার এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন পানাহি। গল্পবয়ানের শশব্যস্ততায় গাড়ির কাঁচে মুখ রেখে হানার শান্ত, কৌতূহলী দৃষ্টিতে তার চারপাশের সবকিছুকে খুব তড়িৎ গতিতে সরে যেতে দেখে দর্শক। ক্লোজ শট যেন বলে যায়, তার কৌতূহল ভরা চোখ আর ছোট্ট সেই মুষ্টিতেই আবদ্ধ আগামীর সম্ভাবনা, যদি নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় মগজধোলাই না হয়ে সে নিজের উপলব্ধি ক্ষমতা আবিষ্কার করতে জানে। ট্যাক্সি’র গল্পবয়ানে আরো তীক্ষ্ণতা যোগ হয়, যখন একজন নারী আইনজীবী দেশটির শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ কার্যপদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা করেন পানাহির সাথে।

Image Source: Jafar Panahi Film Production
পানাহির প্রতিটি সিনেমাই আকস্মিক আঘাত হানে কপট রাজনীতির মুখে, প্রকাশ্য অবাধ্যতায় পিছু হটে না। সে দাগে ‘ট্যাক্সি’ সাহস আর অবাধ্যতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে বললে, খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। গৃহবন্দী হবার পর জাফর পানাহি সিনেমার জনয় তার স্বাধীনতাকেই হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। হাতে যখনই ক্যামেরা তুলে নিয়েছেন হুমকিতে পড়েছে স্বাধীনতা এমনকি ঝুঁকির কবলে পড়েছে জীবন। পানাহির পূর্বের দু’টি সিনেমা- ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’, ‘ক্লোজড কার্টেইন’, সিনেমা থেকেও পানাহির ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির নিরীক্ষায় সীমাবদ্ধ থেকেছে বেশি। সেদিক থেকে ট্যাক্সি পুরোপুরিই তার দুর্দমনীয় শিল্পীসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ আর চলচ্চিত্র শিল্পের জয়জয়কারে মুখরিত হয়ে উঠেছে।
ট্যাক্সি হাস্যরসাত্মক এবং চটপটে সিনেমা। ট্যাক্সির ড্যাশবোর্ডে লুকানো ক্যামেরায় পুরো সিনেমা ধারণ করার সেই ক্যাশ-ক্যাব স্টাইলে সামাজিক আর রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে সরাসরি তর্জনী তাক করা আলাপনগুলো অনেক বেশি গঠনমূলক আর চপল মনে হয়। রিয়েল টাইম ধরে এগিয়ে চলা এই ক্যাশ-ক্যাব স্টাইল আর চপল আলাপনের ট্যাক্সি, আব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘টেন’ (২০০২) সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়।
বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরা বসিয়ে শট নেওয়া, মাঝের অজস্র কাটগুলোকে মসৃণ সম্পাদনায় ঢেকে দিয়ে শেষত যেই রূপ পানাহি তৈরি করেছেন তা দেখে গুরু কিয়ারোস্তামি হয়ত প্রশংসাই করতেন। তবে বিষয়াদি নিয়ে নাড়াচাড়ার ক্ষেত্রে গুরু কিয়ারোস্তামি থেকে শিষ্য পানাহির স্পর্শ’টা আরো কোমল। এমনকি ট্যাক্সি যখন নীতিমূলক স্বরে ভারি হয়ে উঠতে থাকে, তখনো একটা লাবণ্য আছড়ে পড়ে তার চারপাশেল; যাতে করে নীতিমূলক হওয়া নিয়ে কোনোরকম অনুরক্তির সুযোগ থাকে না। শেষ দৃশ্যে ট্যাক্সি সেই নোংরা বাস্তবতাকেই ধারণ করে।

Image Source; Jafar Panahi Film Production
ট্যাক্সি পরিবর্তনের গড়পড়তা প্রত্যাশা দিয়ে ইতি টানে না বরং জমানো অভিমানটাকে আরো দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করে অকপটে। এবং কোনো ‘এন্ড ক্রেডিট’ ছাড়া ইতি টানা ট্যাক্সির শেষে একটা প্রশ্ন বেশ ভারি হয়ে দর্শকের মাথায় চাপে, পানাহি কি আন্তর্জাতিকভাবে এমনই এক সাহসী আর খ্যাতিপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, যে সরকারি সব নিয়ম ভঙ্গ করার পরো তাকে দমন করার কোনো ব্যবস্থা নিতে ইতস্তত করছে ইরান সরকার? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তড়িৎ একটি জিজ্ঞাসা দর্শককে কৌতূহলের চরমে পৌঁছে দেয়,
“যদি অবরুদ্ধ থেকে এমন সিনেমা বানানো যায়, তবে পূর্ণ স্বাধীনতা পেলে নিজের সিনেমাকে কোন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারেন পানাহি?”
কোনোকিছুতেই যে তাকে দমানো সম্ভব নয়, এটুকু স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়।