কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র প্রতাপ ও মামুন। দুজনে ভাল বন্ধু। প্রতাপের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মালকানগর গ্রামে আর মামুনের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। কলেজের ছুটিতে একবার প্রতাপ গিয়েছিল মামুনের বাড়ি দাউদকান্দিতে বেড়াতে। প্রতাপ হিন্দু হওয়ায় মামুনের পিতা হাকিম সাহেব প্রতাপকে নিজের বাড়িতে থাকতে দেননি- থাকার ব্যবস্থা করেন হাকিম সাহেবরই এক হিন্দু সহপাঠী সত্যসাধন চক্রবর্তীর বাড়িতে। রাগে ক্ষোভে প্রতাপ তখনই ফেরত যেতে চাইলেও মামুনের দিকে চেয়ে অত রাতে ফেরত যেতে পারল না, অগত্যা তাকে থাকতে হয় হাকিম সাহেবের সেই হিন্দু সহপাঠীর বাড়িতে।
হিন্দু সমাজের মতো মুসলিম সমাজে অস্পৃশ্যতার প্রথা না থাকলেও মামুনের পিতা হাকিম সাহেব কেন প্রতাপের প্রতি এ রকম আচরণ করেছিলেন তার কারণ হিসেব জানা যায়, হাকিম সাহেবের পিতা অর্থাৎ মামুনের দাদা সিলেটে একবার এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ‘অস্পৃশ্য প্রথার’ কারণে অপমানিত হয়েছিলেন। এরপর থেকে কোনো হিন্দুকে নিজেদের ভিটেতে কখনো থাকতে দেবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি। হাকিম সাহেবের পিতার সেই প্রতিজ্ঞারই ফল ভোগ করতে হয় প্রতাপকে। ঠিক যেমনটি সামাজিক, ধর্মীয়, এবং বংশীয় বিভিন্ন নেতিবাচক পরম্পরার নেতিবাচক ফলভোগ করে পরবর্তী প্রজন্ম। পরদিনই প্রতাপ দাউদকান্দি ছেড়ে আসার পণ করলেও চক্রবর্তীর আতিথেয়তা, মামুনের নিষ্কলুষ ভালবাসা আর বুলা নামক এক মেয়ের চঞ্চলতার টানে সে থেকে যায় আরো ৮-১০ দিন।
এসব ভারত বিভাগের বেশ আগের কথা। তারপর একসময় ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ সৃষ্টি হলো। প্রতাপ রায় মজুমদার ও তার পরিবার পূর্ববঙ্গ তথা মালকানগরের পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে আশ্রয় নেয় কলকাতায়। আর সৈয়দ মোজাম্মেল হক, অর্থাৎ মামুন থেকে যায় পূর্ব পাকিস্তানে। সাবজজ হিসেবে কলকাতায় স্থানীয় মানুষের মতো জীবনযাপন করলেও প্রতাপ কখনো নিজের শরীর থেকে পূর্ববঙ্গের গন্ধ মুছতে পারেনি, পূর্ববঙ্গীয় বাংলা ভাষার টান ভুলে কলকাতার টানে বাংলা বলতে পারেনি, মন থেকে ফেলতে পারেনি রিফিউজি হওয়ার অনুভূতি। অপরদিকে পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী মামুন নিজেই স্বাধীন পাকিস্তানে ভাল নেই। ইতোমধ্যে পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মামুন গ্রেফতারও হয়।
এভাবে পশ্চিম বাংলায় প্রতাপ রায় মজুমদার আর পূর্ব বাংলার সৈয়দ মোজাম্মেল হক ওরফে মামুনকে কেন্দ্র করে এগুতে থাকে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসের কাহিনী। তাদের জীবনকে ঘিরেই সমাবেশ ঘটে মমতা, মঞ্জু, অতীন, অলি, তুতুলের মতো অনেক চরিত্রের। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে উঠে আসে সমসাময়িক ইতিহাসের গতিধারা। ফজলুল হক, জহরলাল নেহেরু, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গন্ধীর মতো ঐতিহাসিক সব চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে।
উপন্যাসটি প্রায় ১১০০ পৃষ্ঠার, দুই খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে ভারত বিভাগ থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর পূর্বাপর প্রেক্ষাপট এবং দ্বিতীয় খণ্ডে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বর্ণিত হয়েছে।
১৯৩৭ এর নির্বাচন, এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা গঠন, কংগ্রেসের নীতি, জিন্নাহর চিন্তা, ভারত বিভাগ, শরণার্থী সমস্যা, ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসন, ৬২’র চীন-ভারত যুদ্ধ, ৬৫’র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের উত্থান-পতন, ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ, ৭৫’এর বঙ্গবন্ধু হত্যা সহ প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লেখক স্পর্শ করে গেছেন নাটকীয় সব কাল্পনিক কাহিনীর বাঁকে বাঁকে। বিশেষ করে দ্বিতীয় খণ্ডের প্রায় পুরোটা জুড়েই বিবৃত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিজয় আলেখ্য।
প্রায় প্রতিটি সাহিত্যেই সাহিত্যিকের জীবনদর্শন ও আদর্শের ছাপ থাকে। সেটা হোক অবচেতনে বা সজ্ঞানে। ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে সুনীলও তার ব্যতিক্রম করেননি। বিভিন্ন চরিত্রের মুখ দিয়ে তিনি ইতিহাসের ঘটনাগুলোর বিচার করিয়েছেন। একইভাবে সমসাময়িক সমাজের রাজনৈতিক ও আদর্শিক মতবাদসমূহকেও মূল্যায়ন করিয়েছেন। তাই সেসবে বিচার ও মূল্যায়নে লেখকেরই ব্যক্তিগত চিন্তা, মতাদর্শ এবং জ্ঞানের প্রতিফলন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রোমান্টিকতায় হালের কলকাতার বাঙালি সাহিত্যিকদের মতো সুনীলও উত্তেজক দৃশ্য-কল্প তৈরি করেছেন। উপন্যাসের বিশালতা এবং অগণিত চরিত্রের আগমনে মাঝে মাঝে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে বটে কিন্তু হঠাৎ কোনো নাটকীয়তা অথবা ঐতিহাসিক চরিত্রের আগমনে তা আবার পুনর্জীবন লাভ করে। লেখক মনে হয় ইচ্ছে করেই তেমনটি করেছেন।
উপন্যাসের শেষে ঋণস্বীকারে লেখক বলেছেন “উপন্যাস মূলত কল্পনার লীলাক্ষেত্র, তাকে তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত করা যায় না।” ভারত বিভাগের প্রেক্ষাপট এবং তার পরবর্তীতে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের রাজনৈতিক ঘটনাসমূহ তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত না করে লেখা প্রায় অসম্ভব। অথচ সে কাজটিই লেখক সম্ভব করেছেন সাবলীলভাবে। এ সময়ের প্রায় ৪০ বছরের ইতিহাস লেখক বর্ণনা করে গেছেন গল্পচ্ছলে। যারা তথ্যজটে আটকে পড়ার ভয়ে ইতিহাসনির্ভর বই পড়তে ভয় পান তারাও এই বই পড়ে ইতিহাসের প্রেমে পড়বেন। আর ইতিহাস-উৎসুকদের জন্যও বইটি অবশ্যপাঠ্য।
উপন্যাসে কাহিনী বিন্যাসের ধরন এবং প্রেক্ষাপটের আবেদন বুঝানোর জন্য যথাসম্ভব স্পয়লার না দিয়ে কয়েকটি উক্তি প্রসঙ্গ সহ তুলে ধরছি।
“সেই শোক প্রতাপ ও মমতাকে অনেক কাছাকাছি এনেছিল…। এটি যেন প্রতাপ ও মমতার মাঝে একটি অদৃশ্য সেতু নির্মাণ করেছিল। তা এতই ব্যক্তিগত যে অন্য কেউ বুঝবে না। মুখে কিছু বলার দরকার নেই। অনেক লোকের মাঝখানে হয়তো অন্য কথা হচ্ছে, শুধু প্রতাপ বা মমতা পরস্পরের দিকে একবার তাকালেই দু’জনে জানবে যে তাদের বুকের মধ্যে হু হু কান্না এবং দুজনেই দুজনকে নিঃশব্দে বলছে, ‘শান্ত হও, শান্ত হও’।”
“প্রতাপ ও মামুন এখন প্রায় প্রৌড়। মামুন প্রতাপকে বলে একবার মালকানগর ঘোরে আসতে। কিন্তু প্রতাপ কিছুতেই রাজি হয় না। তার বিশ্বাস দেশ বিভাগের আগে বাড়ির চেহারা যেমন ছিল এখন তা নেই। দখলকৃত ক্ষতবিক্ষত বাড়ির মুখ না দেখে অক্ষত বাড়ির স্মৃতি নিয়েই প্রতাপ বাকি জীবন কাটাতে চায়। প্রতাপ ও মামুন দুজনেই ছাত্রজীবনে বুলা নামে মেয়েটার প্রেমে পড়েছিল। এতদিন পর দু’জনেই বুলাকে দেখার জন্য প্রায় বুলার শ্বশুর বাড়ির সামনে এসে যখন দাঁড়ায়, তখন বাড়িতে ঢোকার আগেই হঠাৎ প্রতাপ ফিরে যায়। যে কারণে প্রতাপ মালকানগরে ফিরে যেতে চায়নি একই কারণে সে বুলাকে আর দেখতে চায় না।”
“প্রতাপের ভগ্নীপতি বিশ্বনাথ জীবন-যুদ্ধে হেরে আশ্রয় নিয়েছিলেন কাশিত। যাওয়ার আগে সে প্রতাপকে একটি চিঠি দেয়। সেই চিঠির শেষ বাক্যটি দিয়ে এ লেখা শেষ করছি, ‘ব্রাদার! এ জীবনে ভগবান আর আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকালেন না’।
[পূর্ব পশ্চিম (১ম ২য় খন্ড একত্রে) পেতে ভিজিট করুন রকমারি ডট কমে।]