গেল বছর অর্থাৎ, ২০২২ সালে বড় বড় দুই স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে আসা ভালো ভালো সিরিজগুলোর মধ্যে মানের তুলনায় এবং বক্তব্যের বিবেচনায় কিছুটা স্বল্পালোচিত সিরিজ হলো ‘দ্য ডেভিল’স আওয়ার’ (আমাজন প্রাইম) এবং ‘দ্য ওয়াচার’ (নেটফ্লিক্স)। এই লেখায় সিরিজ দুটোর উপর আলো ফেলা হলো। দুটোকে এক নিবন্ধে বাঁধবার কারণ হলো, দুটোর মধ্যে থাকা কিছু সাদৃশ্য। এই দুটো সিরিজই মানুষের অবসেশন বা আচ্ছন্নতা নিয়ে কথা বলে। এবং গভীরে দুটো সিরিজই মানুষের নানা অনিরাপত্তার দিক নিয়ে বক্তব্য রাখে।
দ্য ডেভিল’স আওয়ার (২০২২)
‘দ্য ডেভিল’স আওয়ার’ আমাকে বিমুগ্ধ করেছে এত এত জনরাকে মসৃণভাবে একত্রীকরণের প্রক্রিয়ায়। শুরু হয় মার্ডার-মিস্ট্রির সাথে পুলিশি তদন্ত প্রক্রিয়া আর হররের টাচ দিয়ে। সেই কথার পিঠে বলি, দেজা ভ্যুর ধারণাকে প্রভাবশালীভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে গোটা সিরিজে। এর সাথে সিরিয়াল কিলার জনরার অলংকার। কিন্তু শেষ অংকে এই সিরিজ যেভাবে সাইফাই আর ফ্যান্টাসিকে একত্রিত করেছে, তা বেশ চিত্তাকর্ষক রূপ পেয়েছে। এবং একইসাথে বুদ্ধিদীপ্ততা ধরে রেখে এমন গ্রাউন্ডেড সাইফাই বানানোও প্রশংসনীয়। একেবারে ‘থিমেটিক সাইফাই’ যাকে বলে। আর এত এত জনরা সহজাতভাবে মেশানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা অবশ্যই টম মোরানের বহুমাত্রিক এবং বহুস্তরী চিত্রনাট্যের।
এমন না যে ‘দ্য ডেভিল’স আওয়ার’ একদমই অভিনব কোনো ধারণা কিংবা একদমই সতেজ কিছু নিয়ে তৈরি। অবশ্যই এই সিরিজে অতীতের অনেক থ্রিলার সিনেমা আর সিরিজের প্রভাব এবং অনুপ্রেরণা আছে। তাতে এই সিরিজ খাটো হয়ে যাচ্ছে না। বরং একইসাথে, পুরনো অনেককিছুই এর ছায়ায় আরেকবার দেখার মতো অনুভূতি পাওয়া যায়। ভালোবাসাটা অনুভব করা যায়। থমাস হ্যারিসের ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ ও ‘রেড ড্রাগন’ উপন্যাস এবং এই দুটো থেকে নির্মিত একই নামের সিনেমা, ‘প্রিডেস্টিনেশন’, ‘সেভেন’, ‘দ্য সিক্সথ সেন্স’, ‘দ্য ওমেন’, ‘হেনরি: পোর্ট্রেট অব অ্যা সিরিয়াল কিলার’, মাইকেল কনেলির উপন্যাস ‘দ্য পোয়েট’, ‘কোহেরেন্স’, ‘মি. নোবডি’, এবং সাম্প্রতিক সিরিজ ‘ডার্ক’-এর কথাও বলবেন অনেকে। ছোট ছোট অনেক অনেক মুহূর্তে এমন অনেক প্রভাব/অনুপ্রেরণা/শ্রদ্ধাঞ্জলি আছে। তাতে এর মজা কিছু কমেনি। বরং ওসব অলংকারকে এতটা দক্ষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যা মাঝে মধ্যে অভিভূত করেছে।
ওই যে, আগেই বললাম টম মোরানের লেখনীর কথা। সিরিজের ৬ নাম্বার, অর্থাৎ শেষ এপিসোড পাগলামিকে আরো উঁচুতে নিয়ে গেছে। এবং থিমেটিক হওয়া সত্ত্বেও সাইফাই আর ফ্যান্টাসির অংশকে এতটা শক্তিশালীভাবে কাজে লাগিয়েছে এই সিরিজ, যার ডিজাইনিং আর জটিলতা ডার্কের কথা মনে করায়। অথচ, সেই গোটা এপিসোডের ৮০ ভাগই চ্যাম্বার ড্রামার স্টাইলে ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু চমৎকার সব সংলাপ, শুরু থেকে তৈরি করা আবহ, নিগূঢ় চরিত্রায়ন আর জেসিকা রেইন ও পিটার কাপালডির বহুমাত্রিক অভিনয়; সেসব দিকে খেয়ালই নিয়ে যায়নি।
শুরুতেই তো প্রশংসা করেছিলাম এর গ্রাউন্ডেড প্রকৃতির। সেটাই বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গা থেকে এই সিরিজকে আরো প্রগাঢ় করেছে। এরা যে সাধারণ দুনিয়ার, সাধারণ চরিত্রই! রোজকার চরিত্র। কিন্তু সেসবের ভেতরেও যে কত মোচড়, কত রহস্য থাকতে পারে; সেটাই উপস্থাপন করেছে এই সিরিজ। জেসিকা রেইনের সাথে তার ছেলের ডায়নামিক, আবার নিকেশ পাটেলের সাথে ডায়নামিক- সবকিছুই কমনীয়তার সাথে বাধা হয়েছে, ড্রামাটিক করে তোলা হয়েছে। শেষে, ‘মি. নোবডি’র মতোই ফিলোসফিক্যাল আর চিন্তা উদ্রেককারী সিরিজ হয়ে উঠেছে ‘দ্য ডেভিল’স আওয়ার’। প্রকৃতি নিজের মাঝে কত রকম রহস্যই ধরতে পারে, তারই বয়ান দিয়ে যায় এই ব্রিটিশ সিরিজ।
দ্য ওয়াচার (২০২২)
রায়ান মর্ফির সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার-হরর মিনিসিরিজ ‘দ্য ওয়াচার’ মানের তুলনায় একটু বেশিই মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। এমনটা হবার কথা ছিল না। বরং একদমই কাছাকাছি সময়ে রিলিজ হওয়া ‘দ্য মিডনাইট ক্লাব’ অমন মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়ার কথা সমালোচকদের কাছে। কিন্তু সুপারফিশিয়ালিটি আর সুডো ইন্টেলেকচুয়ালিটি নিয়ে তেমন ভাবান্তরই দেখলাম না। তা যাক।
‘দ্য ওয়াচার’ অস্বাভাবিক এবং অদ্ভুত এক সত্য ঘটনার উপর তৈরি। এবং রায়ান মর্ফি সেই ঘটনাকে গল্পের আঙ্গিকে আনার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়েছেন, যা স্বভাবতই হওয়া দরকার। নানা কল্পনা, কাল্ট, রিচুয়াল দিয়ে ডিজাইন করেছেন। এটাই তো টিপিক্যাল মর্ফি। সম্ভাবনা জাগাতে, নানা থিওরি দাঁড় করাতে মর্ফি অনেক জায়গাতেই সূক্ষ্মভাবে ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকেই যা ভুলত্রুটি হিসেবে ধরবে। ওই কাল্ট, রক্তপানের উৎসব যেটা গল্পের আকারেই আনা হয়েছে, সেটাকে শেষে কোনোকিছুর সাথে সংযুক্ত কর হয়নি। এটা ত্রুটি কিংবা অসংহত ন্যারেটিভ ট্রিটমেন্ট হিসেবে বলাই যায়। তবে ব্যাপারটা বোধকরি ওই সম্ভাবনার জায়গাতেই ছেড়ে দেওয়া। হতে পারে বানোয়াট গপ্পো, কারণ ওই ন্যারেটরও ‘বিশ্বাসযোগ্য ন্যারেটর’ না।
টেকনিকটা নতুন নয়, কিন্তু ব্যবহারটা চতুর হলে খুব প্রভাবযুক্ত করা যায়। তাছাড়া অনেক ‘রেড হেরিং’ আছে। এখন রেড হেরিং তো রেড হেরিংই। দর্শককে বিভ্রান্ত করাই এই ন্যারেটিভ ডিভাইসের কাজ। কেউ যদি তাতে ক্ষেপে গিয়ে গালি দেয়, তবে হয় সেটা? সিরিজের শেষ এপিসোড দর্শককে হতাশ করে।
আসলে হতাশ করাই এর উদ্দেশ্য। ঠিকভাবে বললে, দর্শকের মাঝে হতাশাজনক অনুভূতিই এই সিরিজ গড়ে তুলতে চেয়েছে। সত্য না জানাটা তো সবসময় হতাশাজনকই। কেউ বলতে পারে, “আধাসেদ্ধ।” কিন্তু ওটাই তো শেষ উদ্দেশ্য ছিল, কেউ যদি এর গভীরতর বিষয়গুলো খেয়াল করে। শেষ এপিসোড একইসাথে টুইস্টেডও। প্রধান একটি চরিত্রকে শেষ পর্যন্ত যে জায়গায় আনা হয়েছে! আয়রনিক! হ্যাঁ, গোটা ব্যাপারটাই তা। কিন্তু চরিত্রটা গোটা গ্যামাট পূরণ করেই ওই জায়গায় গিয়েছে। সিরিজটা যে গোড়া থেকেই মানুষের অবসেশন কিংবা মোহাচ্ছন্নতা নিয়েই ছিল।
এই সিরিজে একসাথে অনেক কিছু নিয়ে নড পাওয়া যায়। প্রথমদিকের একটি এপিসোডে ক্রিশ্চিয়ানিটি, শহরতলির রক্ষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বক্তব্য রেখেছিল। রক্ষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গীর বিষয়টা অবশ্য জোরালোভাবে এসেছিল। বাবার চরিত্র অর্থাৎ ড্যান চরিত্রটি দিয়েই একে জোরালো করা হয়েছে। কিন্তু সেটার জোরালো ফলো আপ নেই, যা অসংহতির সৃষ্টি করে।
প্রথম ৪ এপিসোডে এই সিরিজ ধীরে-সুস্থে অনেক বক্তব্যের জায়গাকেই আসলে তৈরি করেছিল। কিন্তু এরপর গতিময় করতে আরেকটু ক্যাম্পি/চিজি ঘরানায় হাঁটা শুরু করে। ওখানেই মূলত ন্যারেটিভে একটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। তবে খারাপ বা বিরক্তিকর হয়নি। সিরিজের মূল বিষয় কিন্তু ওই ‘অবসেশন’ই। একটা নিখুঁত ঘরে বসবাস করা নিয়ে অবসেশন (যা পাওয়া যাবে সাম্প্রতিক সিনেমা ‘ভাইব্যারিয়াম’-এ। এটা শুধুমাত্র প্রিমাইজ, ওই সিনেমা আরো অনেক গভীরে আঘাত করে), কিংবা পুরনো ঐতিহ্যকে একইরকম রাখা নিয়ে অবসেশন, গোঁড়ামি। অবসেসড চরিত্রগুলো নিয়েই সিরিজ।
এই শতকের আমেরিকান ড্রিম যে হয়ে গেছে একটা সুন্দর, দামী বাড়ি ও গাড়ি এবং এসবের ঘেরে বাকিসব। সবাই যে দেয়াল তুলে ওই প্রাচুর্য আর প্রযুক্তিতে বন্দী। ওয়াচারের ওই চিঠিতে বার বারই লোভের কথা বলা হয়েছে। যদিও ওটা অবসেসড চরিত্র। কিন্তু এই লোভ যে আসলে ভালো থাকার লোভ। সুবিধাভোগী থাকার লোভ। ড্যানের পরিবারও যে ভালো থাকতে চায়। আর ভালো থাকার সংজ্ঞা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দামী ঘর, দামী আসবাব, ঐশ্বর্যমন্ডিত লাইফস্টাইলে বদলে দিয়েছে। এই শতকের বদলে যাওয়া আমেরিকান ড্রিম এবং সেই ড্রিমের সংজ্ঞা নিয়ে এই সিরিজ কথা বলেছে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা ‘আমিত্ববাদ’ নিয়ে কথা বলেছে এই সিরিজ। শহরতলী তো বরাবরই একাত্মবাদীতার কথা বলে। কিন্তু ড্যানের পরিবার শুরু থেকেই সীমানা তুলে হয়ে গেছে বহিরাগত, ওই যে পুরোদমে শহুরে তারা। বিগ মো, উইন্সলোরা সেই একাত্মবাদেই কিন্তু বিশ্বাস করা চরিত্র। এর মধ্য দিয়েই শহর আর শহরতলীর পার্থক্যের চিত্রটা, দৃষ্টিভঙ্গীর ভিন্নতা এই সিরিজ মসৃণভাবে তুলে ধরেছে।
প্রযুক্তির দুর্দমনীয় প্রসারের এই যুগে মানুষের নিরাপত্তা আর গোপনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এই সিরিজ। সেটা তো একেবারে প্রিমাইজেই পাওয়া যায়। রায়ান মর্ফি এসবেরও গভীরে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন গোটা আমেরিকান সমাজব্যবস্থা নিয়ে! পুঁজিবাদী সমাজের এই ইন্ডিভিজুয়ালিজম বা ব্যক্তিত্ববাদ এবং এই শতকের আমেরিকান ড্রিম ভেতরে ভেতরে অনেককেই কীভাবে সোশিওপ্যাথ করে তুলছে এবং কীভাবে নানা রকম অবসেশনের চক্করে ঘুরছে মানুষ, তা নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছে ‘দ্য ওয়াচার’। দারুণ সব অভিনয়শিল্পীর অভিনয় আছে এই সিরিজে। চরিত্র নিয়ে সকলের সতর্ক বোঝাপড়ার কারণেই বহুমাত্রিক সব অভিনয় পাওয়া গেছে।
প্রথম ৩/৪ পর্ব যতটা প্রগাঢ় ছিল, পরবর্তীতে একটু বিঞ্জেবল কোয়ালিটির হবার জন্য হয়তো রেড হেরিংয়ের পরিমাণ বেশি রাখতে গিয়ে বেশি মূলধারার হয়েছে। কিন্তু ‘দ্য ওয়াচার’ তা-ও আকর্ষণীয়। এবং বক্তব্যগুলো, পরের ওই ক্যাম্পি ভাইবের জন্য যে মুছে গেছে তা কিন্তু নয়। সংকীর্ণ হয়েছে, ছোট ছোট সংশক্তির জায়গা হারিয়েছে, তবে তর্কের জায়গাটা কিন্তু রেখে গেছে। পৃষ্ঠতলের নীচে থাকা উদ্বিগ্নতাই সিরিজে সমসাময়িকতা আর প্রাসঙ্গিকতা যুক্ত করেছে। ওটা নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে।