জিয়ালো জনরার উদ্ভবটা হয়েছে ষাটের দশকের শেষদিকে। মোটামুটি ৭০ দশক অব্দি স্থায়ী ছিল এই জনরা। মানে, সিনেমাতে অন্তত। জনরাটা ইতালীয়। মার্ডার-মিস্ট্রি, হরর-থ্রিলার; এই সবকয়টা জনরাকে একসাথে মেশালে যা হয়, তা-ই জিয়ালো। এককথায় এভাবেই ধারণা দেওয়া যায়।
‘জিয়ালো’ রীতিমতো ওয়াইল্ড জনরা। কঠোর জনরাভক্ত মাত্রই জিয়ালোর প্রেমে পড়তে বাধ্য। মার্ডার মিস্ট্রি গল্পে ডিটেক্টিভ উপাদান, সাথে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের অলংকার এবং সুপারন্যাচারাল হররের উপাদান যোগ করেই তৈরি হয় একটি যথাযথ জিয়ালো সিনেমা। তার উপর যেসব জিয়ালো সিনেমার গল্প মোটামুটি ফিমেল জিয়ালোতে ভিড়ে, মানে যেগুলোয় কোনো এক সাইকোপ্যাথ ধরে ধরে লাস্যময়ী তরুণীদের খুন করতে থাকে, সেগুলোয় বেশ ইরোটিক ভাইবও থাকে।
আশির দশকের আমেরিকান স্ল্যাশারে, মানে প্লটসর্বস্ব একদমই না হয়ে শুধু ক্যাম্পি/চিজি হওয়াই যেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল, এই জিয়ালোর ভালোই অনুপ্রেরণা তাতে পড়েছে। মারিও বাভা, দারিও আর্জেন্তোর মতো মাস্টার ফিল্মমেকাররা এই জিয়ালো জনরাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তা যাক। জিয়ালোর ইতিহাস নিয়ে এই আর্টিকেল নয়। তাই ওদিকে আর দীর্ঘ করবো না। এই সময়ের কিছু হররের মধ্য দিয়ে জিয়ালো জনরাটা আধুনিক একটা রূপ পাচ্ছে। এই কয় বছরের মধ্যে ইন ফেব্রিক (২০১৮), পিয়ার্সিং (২০১৮)-এর মতো বুদ্ধিদীপ্ত বেশ কিছু জিয়ালো সিনেমা এসেছে। ‘ম্যালিগন্যান্ট’ তন্মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
‘ম্যালিগন্যান্ট’ শব্দের অর্থ একদিকে ভাইরাসের মতো সংক্রামক কিছু বোঝায়। আবার ইভিল ন্যাচার বা দুষ্টু প্রকৃতির কিছুও বোঝায়। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন হরর সিনেমার পরিচিত পরিচালক জেমস ওয়ান। ‘স’ সিনেমা সিরিজের মতো ডিস্টার্বিং স্ল্যাশার দিয়ে তিনি পরিচিত। ‘দ্য কনজ্যুরিং’-ও তার বানানো। তবে ম্যালিগন্যান্ট তার অন্যান্য জনপ্রিয় কাজ থেকে ভিন্ন। জনরাটাও যে নির্দিষ্ট দর্শকশ্রেণীর জন্য। এবং ম্যালিগন্যান্ট তার অন্যতম দারুণ কাজ হয়েও থাকবে।
গল্পের শুরু হয় এক রিসার্চ হাসপাতাল থেকে। সাইক্রিয়াটিক ট্রিটমেন্ট এবং ওই বিশেষ রোগীদের উপর রিসার্চ করা হয়। সেখানকার এক ডাক্তার খুব ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আর বিস্ময় নিয়ে ক্যামকর্ডারে একটা রোগী সম্পর্কে বলছিলেন। তখনই গ্যাব্রিয়েল নামক এক ভয়ংকর রোগী গোটা হাসপাতালে তান্ডব চালাতে শুরু করে, যাকে সেভাবে দেখানো হয় না। এবং ওই ডাক্তার ভিডিওতে পুরো তথ্য জানিয়ে যেতে পারেন না।
এরপরে গল্প এগোয় সিয়াটলের এক গৃহিণীকে ঘিরে। কাজ থেকে ঘরে ফিরতেই দেখা যায় তার এবিউজিভ স্বামী তাকে এই সময় চাকরিতে যেতে নিষেধ করছে। তাদের উত্তপ্ত বাক্যালাপ থেকে বোঝা যায়, এর আগেও বেশ কয়েকবার অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত হয়েছে মহিলার। তাই স্বামী এটা নিয়ে অতি সতর্ক এবার। একপর্যায়ে তাদের উত্তপ্ত আলাপ হাতাহাতিতে গড়ায়।
স্বামী দেয়ালে ধাক্কা দেয় স্ত্রীকে, এবং স্ত্রী মাথায় চোট পায়। স্বামী ক্ষমা চেয়ে বরফ আনতে গেলে দরজা আটকে নিজেকে এই এবিউজিভ স্বামীর হাত থেকে বাঁচায় স্ত্রী। সেই রাতে তার ঘুমের মাঝে অকস্মাৎ একটা ভিশন আসে এমন যে, কোনো অদৃশ্য এক কুশক্তি তার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। তড়াক করে ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠার পর পরই সে বুঝতে পারে, তার সেই ভিশনে সে যেমনটা দেখতে পেয়েছে, ঠিক তেমনটাই হয়েছে, এবং মারা গেছে তার স্বামী। দিন কয়েক না যেতেই শোকার্ত এই স্ত্রী আবার একটি ভিশনের মুখোমুখি হয় ঘুমের মাঝে।
এবার সেই অশরীরী মেরে ফেলছে সেই রিসার্চ হাসপাতালের এক ডাক্তারকে, আটকে রেখেছে আরেক মহিলাকে। সে আর তার বোন গিয়ে পুলিশকে জানায় সব। স্বাভাবিকভাবেই গোয়েন্দা পুলিশের এসব অতিপ্রাকৃত ভিশনের কথাকে বিশ্বাস করার কথাও না। এবং প্রত্যাশিতভাবেই খুন হয় (বিদঘুটেভাবে)। এরপর ওই গৃহিণী অর্থাৎ ম্যাডিসনের কথায় পূর্ণ বিশ্বাস না আনলেও ‘কিন্তু’টায় কিঞ্চিৎ বিশ্বাস তারা আনে। ম্যাডিসনের কথা ধরে পরবর্তী খুনের ঘটনা প্রতিরোধ করতে গিয়েই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ওই উদ্ভট ফিগারকে দেখতে পায়। ধাওয়া করে। ফিগারটি ছায়ার মতো দৌড়ায় রীতিমতো। কিছু একটা গোলমেলে ব্যাপার আছেই ওর মধ্যে। আকৃতি মানুষের, কিন্তু পরিচিতি যে ঠিক কী, তা গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিজেও জানেন না।
এদিকে ম্যাডিসনই কেন ভিশনগুলো পায়, ওটার তদন্ত করতে গিয়ে তার মেডিকেল ফাইল খোলা হয়। সেখান থেকে জানা যায়, ১০ বছর বয়সে ম্যাডিসনকে তার বর্তমান পরিবার দত্তক নেয়। তার আগের কোনো স্মৃতিই তার খেয়ালে নেই। স্মৃতির ছোট্ট ভগ্নাংশও নয়। ছোটবেলার ভিডিও ক্যাসেট দেখতে গিয়ে ম্যাডিসন জানতে পারে, তার একটা কাল্পনিক ভাই ছিল। ম্যাডিসনের দত্তক বাবা-মায়ের কাছে সেটা কাল্পনিক হলেও ম্যাডিসনের কাছে অত্যন্ত বাস্তব, এবং সেটা দেখেই ম্যাডিসনের মনে পড়ে যায় সবকিছু। অপ্রত্যাশিত সব বাঁক আর বিভঙ্গে ভরা যে ঘটনার বাকিটুকু; অবিশ্বাস্য এক অতীতই যে সবকিছুর উৎপত্তিস্থল! এই ভঙ্গিমা ক্লিশে হলেও গল্পের গতি-প্রকৃতি ক্লিশে নয়।
জেমস ওয়ানের ‘ম্যালিগন্যান্ট’ জিয়ালো জনরার আধুনিক উপস্থাপনই শুধু নয়, একইসাথে পুনর্জাগরণমূলক সিনেমাও। টাইটেলের মেডিকেল টার্ম ও ন্যাচারাল টার্ম দুটোই এই সিনেমায় আছে। আর জিয়ালো জনরার প্রত্যেকটা অলংকারের যথাযথ সন্নিবেশ এতে ঘটেছে। সিনেমার প্রি-টাইটেল সিন, তারপর ম্যাডিসনের স্বামীর খুন হবার সিন- এগুলো তো পুরোপুরিই হরর সিনেমার আদলে কম্পোজ করা। সিনেমার আবহে হরর তো ছিলই, জিয়ালোর আবহে যেটা থাকতে হয়। একের পর এক খুন হচ্ছে, কে করছে বা কেন- সেটা চলে যাচ্ছে মার্ডার মিস্ট্রির অলংকারে। ওদিকে ডিটেক্টিভ তো আছেই। সেই উপাদানও নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত। ম্যাডিসনের দিক থেকে গোটা গল্পটাই ফাংশন করেছে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের আঙ্গিকে। আর আশির দশকের স্ল্যাশারের ভাইব তো আছেই। আর জিয়ালোর আরেকটা প্রধান ট্রেডমার্ক যেটা, সমাপ্তিতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত টুইস্ট, যেটা মনে হতে পারে একটু ওভার দ্য টপ, কিন্তু ওটাই জিয়ালোর প্রকৃতি; তো সেরকম আউটরেইজেস টুইস্টও এতে আছে।
অর্থাৎ, ম্যালিগন্যান্ট আসলেই জিয়ালো জনরার প্রতিটি রসদের যথাযথ সন্নিবেশ ঘটিয়েছে। এবং তা সম্ভব হয়েছে আকেলা কুপারের অমন সরস, বুদ্ধিদীপ্ত আর সুমসৃণভাবে লেখা চিত্রনাট্যের জন্য। মসৃণভাবে যদি লেখা না হতো, তাহলে এত এত জনরা, অলংকার, উপাদান মিলে একটা হ-য-ব-র-ল কিছু হতো। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। এই যে প্রতিটা জনরা অলংকারকে আলাদা আলাদাভাবে ধরে বাতলানো যাচ্ছে, সেটার কারণই তো চিত্রনাট্যে যথাযথভাবে সবকিছুকে ভিন্ন ভিন্ন লেয়ারে রাখা। আর সরস চিত্রনাট্যটি উন্মত্ততার সাথে অনুদিত হয়েছে জেমস ওয়ানের ভিজ্যুয়ালে। আধুনিক ভায়োলেন্ট আর স্টাইলিশ হররে জেমস ওয়ান তো ঘরোয়া নাম। প্রতিটি সিনেমার ক্ষেত্রেই আলাদা অ্যাস্থেটিক বেছে নেন তিনি। সেটা এই সিনেমার ক্ষেত্রে আরো সাযুজ্যতা পেয়েছে, কারণ জিয়ালো মানেই অত্যন্ত স্টাইলাইজড অ্যাস্থেটিকের সিনেমা।
আলো-ছায়ার শার্প কনট্রাস্ট, কালার প্যালেটগুলো একটু সুরিয়ালিস্টিক ঢঙের হওয়াই জিয়ালোর সিগনেচার ভিজ্যুয়াল স্টাইল। জেমস ওয়ানও নিয়ন অ্যাস্থেটিকে অন্ধকার আর আবছায়াতে পূর্ণ ইমেজারিগুলোতে জিয়ালোর সিগনেচার টোনটা ধরে রেখেছেন। ডিটেক্টিভ যখন খুনীকে ধাওয়া করে, ওই দৃশ্যে যেভাবে লং ক্যামেরা প্যানিংয়ের ব্যবহার হয়েছে, ওটাই জেমস ওয়ানের ফিল্মমেকিং স্টাইলকে আরো হাইলাইট করে। আর সম্পাদনায় কাটগুলো মাঝে মাঝে ভিজিবল, আবার মাঝে মাঝে অদৃশ্য থাকাতেই জেমস ওয়ানের স্টাইলাইজেশন আর স্টাইলের উপর নিয়ন্ত্রণ সুচারুরূপে প্রকাশ পেয়েছে।
জিয়ালোর শেষ সিগনেচার হলো এর আবহসঙ্গীতে। জিয়ালো সিনেমার আবহসঙ্গীত মানেই প্রগেসিভ রক আর হেভি মেটালের অনবদ্য মিশ্রণ। সবচেয়ে চমৎকার উদাহারণ হলো জিয়ালো জনরার মাস্টার ফিল্মমেকার দারিও আর্জেন্তোর সিনেমায় ‘গবলিন’ ব্যান্ডের সঙ্গীতায়োজন। আহা! কী বিস্ময়কর সব স্কোর কম্পোজ হতো! ডিপ রেড (১৯৭৫), সাসপিরিয়া (১৯৭৭), ফেনোমেনা (১৯৮৫)- আর্জেন্তোর এসব জিয়ালো সিনেমায় চমৎকার সব স্কোর কম্পোজ করেছিল গবলিন। ম্যালিগন্যান্টে কিংবা এই সময়ে তো আর গবলিন ব্যান্ড নেই। কিন্তু ম্যালিগন্যান্টের আবহসঙ্গীত জিয়ালোর সেই ঐতিহ্য জিইয়ে রাখতে পেরেছে বৈ। এবং সব অনুষঙ্গকে এক করে ক্লাসিক জিয়ালোর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে এক দুর্দান্ত আধুনিক জিয়ালো উপহার দিয়েছেন জেমস ওয়ান।