প্রাচীন ভারতীয় ধর্মীয় সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তারকারী ঐতিহাসিক মহাকাব্য ‘মহাভারত’ থেকে জানা যায় যে, পঞ্চপাণ্ডবের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য নিজের সেরা শিষ্য অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, অর্জুনকে কেউ কোনোভাবে হারাতে সক্ষম নয়। সেই সময়টাতে নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর সন্তান যুবরাজ একলব্য পরম ভক্তি নিয়ে দ্রোণাচার্যের কাছে তীরচালনা শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। নিষাদরা ছিলো মূলত আদিবাসীদের জোট, সেখানের ভূমিপুত্র-প্রকৃতির সন্তান।
মহাভারতের সমাজে কে কোন দায়িত্ব পালন করবে সেটা তার বর্ণ-সম্প্রদায় দিয়ে নির্ধারণ করা হতো। যুদ্ধ করবে শুধুই ক্ষত্রিয়রা, তাই দ্রোণাচার্য অনার্য একলব্যকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে রাজি ছিলেন না। নিষাদকুমার একলব্য বিফল হয়ে একাকী এক বনে বসবাস করা শুরু করেন। আর দ্রোণাচার্যকেই গুরু মেনে, তার মূর্তি তৈরি করে অস্ত্রসাধনা শুরু করেন। একসময় তিনি তীরচালনায় অত্যন্ত দক্ষ হয়ে ওঠেন। অর্জুন একলব্যের এই দক্ষতার পরিচয় পেয়ে গুরুকে জানান যে, একলব্যের কারণে তার খ্যাতি হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
দ্রোণাচার্য তার প্রিয় শিষ্যের মান রক্ষার্থে একলব্যের কাছে গিয়ে দেখতে পান, একলব্য তো তাকেই গুরু হিসেবে মেনে আসছে। অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য দ্রোণ কৌশলের আশ্রয় নেন। সেসময় সমাজে একটা রীতি প্রচলিত ছিলো যে, শিক্ষাগ্রহণের শেষে গুরু শিষ্যের কাছে কিছু চাইবে যাকে ‘গুরুদক্ষিণা’ বলা হতো। দ্রোণাচার্য একলব্যের কাছে গুরুদক্ষিণা হিসেবে তীর চালাতে সবচেয়ে দরকারি অঙ্গ ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি চেয়ে বসেন। একলব্য খুশিমনে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি কেঁটে দেন। ফলে আর কারোর পক্ষে অর্জুনকে টক্কর দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
মূলত এই বিষয় নিয়েই সিনেমা নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্রকার আবু সাইয়ীদ। মহাভারতের কাহিনীতে কুরু রাজপরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। কিন্তু জানা যায় না রাজার কোনো কর্মচারী কিংবা রাজ্যের একেবারে সাধারণ কোনো প্রজার হালচাল। মহাভারত সংশ্লিষ্ট যা কিছু নিয়ে শিল্প-সাহিত্য-সিনেমা তৈরি হয়েছে, সবখানেই প্রায় রাজাদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে। সেই জায়গা থেকে বের হয়ে এসে পরিচালক মহাভারতের অবহেলিত চরিত্র একলব্যের গুরুভক্তি নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন।
‘রূপান্তর’ সিনেমায় দেখানো হয়েছে, শুটিং চলাকালীন সময়েও চিত্রনাট্য নিয়ে পরিচালকের ভাবনা কীভাবে পাল্টে যায়। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস, সিনেমায় তার নাম আরিফ। ফেরদৌসের চরিত্রটি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার, যিনি শুটিং ইউনিট নিয়ে পার্বত্য এলাকায় ব্যস্ত সময় পার করছেন একলব্যের গুরুভক্তি নিয়ে ‘গুরুদক্ষিণা’ নামে একটি সিনেমা বানানোর জন্য। চিত্রধারণের একপর্যায়ে এসে তিনি বেশ জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।
শুটিং দেখতে ভীড় করা সাঁওতালরা বলাবলি করছিলো, অভিনেতারা (একলব্যের চরিত্রের) তীর ধরতেই জানেন না। স্বভাবতই অভিনেতা তীর ধরেছিলো বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে, অথচ সেই সাঁওতাল যুবকদের বক্তব্য ছিলো, তীর ধরতে হয় মধ্যমা (মধ্য আঙ্গুল) ও তর্জনী দিয়ে। এটা শুনে আরিফ বেশ বিভ্রান্ত হন, তিনি সবসময় জেনে এসেছেন তীর ছোঁড়ার সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়েই ধরতে হয়। মহাভারতের গল্পে একলব্য তার এই আঙ্গুল কেঁটে দেওয়ায় তার তীরচালনা বন্ধ হয়ে যায়।
আরিফ অনেক ভেবেচিন্তে সাঁওতালদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক তীরন্দাজের সাথে কথা বলতে চান। বয়স্ক তীরন্দাজও জানান যে, বংশ পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে তারা মধ্যমা ও তর্জনী দিয়েই তীর চালিয়ে আসছে। এটা জেনে আরিফ আরো দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন। আরিফের সহকারী পরিচালক শায়লা এই চিন্তা-ভাবনায় তাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ভাবতে থাকেন, একলব্যের প্রতিভাকে নষ্ট করার জন্যই যদি দ্রোণাচার্য বৃদ্ধাঙ্গুলি গুরুদক্ষিণা নেন, তাহলে একলব্যের অনুসারীরা কেন তীরচালাতে বৃদ্ধাঙ্গুলি ব্যবহার করে না! সাঁওতালরা নিজেদেরকে একলব্যের অনুসারী হিসেবে দাবি করে থাকে, কারণ তারাও একলব্যের মতোই নিম্ন জাতিগোষ্ঠী।
কয়েকদিনের গভীর চিন্তাভাবনার পর শেষমেশ আরিফ তার চিত্রনাট্যই পাল্টে ফেললেন। যেহেতু এ সময়ে মহাভারতের রেফারেন্সের সাথে তীর চালানোর নিয়মটা মিলছে না, তাই আরিফ এই ব্যাপারটি নিজের মতো ব্যাখা করতে চাইলেন। তিনি যে ইতিহাস আনলেন, সেটা অন্য কোথাও লেখা নেই। চিত্রনাট্য পাল্টে ফেলে সব নতুন করে শুরু করলেন। গল্পের চাহিদা অনুযায়ী অভিনেতা হিসেবে কয়েকজন সাঁওতালকে রাখলেন, আর আগের কয়েকজন বাদে বাকি সব অভিনেতাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন।
তিনি যে ইতিহাস আনলেন সেখানে দেখালেন, তীর চালানোর ক্ষেত্রে নিষাদ রাজপুত্র একলব্য থেকে এখনকার সাঁওতাল পর্যন্ত কীভাবে এই আঙ্গুল পরিবর্তন করে তীর চালানোর শুরু হয়েছে। তার মতে, নিষাদ তীরন্দাজরা তাদের প্রিয় রাজকুমারের তীর চালনা বন্ধ হওয়ার শোকে একলব্যের কাছে জানান, তারাও আর কোনোদিন তীর চালাবে না। একলব্য এই প্রস্তাবে রাজি হননি। তিনি তার অনুসারী তীরন্দাজদেরকে তীর চালানোর কাজ চালিয়ে যাবার আদেশ দেন।
একদিকে কুমারের আদেশ, অন্যদিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে তীর না চালানোর মানসিক শপথ, তারপর আবার শিকারই তাদের একমাত্র জীবিকা। এই বিষয়গুলোকে একসাথে গেঁথে ফেলার জন্য তারা নতুন কৌশল বের করলেন, যেখানে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি বাদ দিয়ে মধ্যমা ও তর্জনী ব্যবহার করে তীর চালানোর অনুশীলন শুরু করলেন। যদিও তীর চালাবার সেই প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে নতুনভাবে ভিন্ন কৌশলে তীর চালনা বেশ কষ্টসাধ্য। এরপর তারা নিশানায় তীর লাগানো তো দূরের কথা, ঠিকভাবে তীর ধরতেই পারছিলেন না। যারা এই সাধনা শুরু করেছিলেন, সেই প্রজন্ম এই নতুন কৌশলে তাদের তীর লক্ষ্যে ভেদ করাতে পারেননি। কিন্তু তারা দমে যাননি, তাদের সন্তানেরা এরপর সফল হয়েছিলেন, যার ফলে কৌশলের নতুন রূপান্তর ঘটেছিলো।
এভাবে ইতিহাসকে নতুন দিকে ঠেলে দিয়ে আরিফ (ফেরদৌস) সিনেমার নাম পাল্টে দিয়ে গুরুদক্ষিণা থেকে ‘রূপান্তর’ করে ফেলেন। এই সিনেমাটিতে সমাজের বিত্তবানদের ক্ষমতার সাথে পাল্লা দিয়ে নিম্নশ্রেণীর মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে। নির্মাতা আবু সাইয়ীদ বোঝাতে চেয়েছেন, অর্থ-বিত্তের শক্তির কাছে ন্যায়-অন্যায় তুচ্ছ হয়ে যেতে পারে।
সিনেমাতে যে লোকেশনে ব্যবহার করা হয়েছে সেটা মহাভারতের মতো বিশাল আখ্যানে বড্ড বেমানান। এই ধরনের ইতিহাসনির্ভর সিনেমার ক্ষেত্রে বাজেটের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
‘সিনেমার মধ্যে আরেক সিনেমা’ ব্যাপারটায় সমান্তরালভাবে আরো কিছু ঘটনা আনা যেত। সাধারণত এই ধরনের সিনেমার ক্ষেত্রে বাইরের কাহিনীও যথেষ্ট ঘটনাবহুল হতে দেখা যায়। কিন্তু রূপান্তরের বাইরের অংশের কাহিনী বলতে আরিফের বিভ্রান্ত হওয়া আর তার সহকারী পরিচালক চরিত্রের শায়লা ও সাঁওতালদের সাথে বিভ্রান্তির বিষয়ে আলাপ করা। সিনেমার কয়েকটি শটে সাঁওতালি নৃত্যের চমৎকার উপস্থাপনা দেয়া যায়। সবদিক দিয়ে বিবেচনা করলে রূপান্তরকে বেশ ভিন্নধর্মী এক সিনেমা বলা যায়।
এক নজরে ‘রূপান্তর’
মুক্তির সাল – ২০০৮
পরিচালনা, প্রযোজনা, চিত্রনাট্য, সংলাপ – আবু সাইয়ীদ
প্রধান চরিত্রে – ফেরদৌস আহমেদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শাকিবা বিনতে আলী, শতাব্দী ওয়াদুদ
চিত্রগ্রহণ – এ আর জাহাঙ্গীর, আবু সাইয়ীদ
সম্পাদনা – জুনায়েদ হালিম
চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ
- International Festival of Films on Tribal Art and Culture, India
- Rome Independent Film Festival
- Rotterdam Film Festival
- Third Eye Film Festival, India
- Goa International Film Festival, India
- Kerala International Film Festival, India
- Chennai International Film Festival, India
পুরস্কার
- Script category, Rotterdam Film Festival
- Best International Film, International Festival of Films on Tribal Art and Culture, India
- বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের আর্থিক অনুদান।