ওয়েস্টার্ন, সিনেমা ইতিহাসের অন্যতম বিশাল এবং উল্লেখযোগ্য এই জনরাতে কাজ হচ্ছে সিনেমার জন্মকাল থেকেই। ২০ দশকে বাস্টার কিটনও বানিয়েছেন। ৩০ দশক থেকে তো সিনেমার সর্বাপেক্ষা সফল জনরা হিসেবেই ওয়েস্টার্রনে ছুটে চলা। দীর্ঘ এই সময়ে কত কত সাবজনরা-ই না তৈরি হয়েছে। যাকগে…সেই ইতিহাসের উপরিতলেও যদি যাওয়া হয়, এই আর্টিকেলের মূল আলোচনায় আর যাওয়া হবে না। কথা হলো, এই সুদীর্ঘ ইতিহাসে কোন কৃষ্ণাঙ্গকে প্রধান চরিত্রে রেখে ওয়েস্টার্ন বানানোর সংখ্যা ভয়াবহ রকমের স্বল্প। হাতে হাতে গণনা করা যাবে।
সেই ৬০ বছর আগে দ্য গ্রেট জন ফোরড ‘সার্জেন্ট রুতলেজ’ সিনেমা দিয়ে সর্বপ্রথম কোন কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাকে প্রধান চরিত্র দিয়েছিলেন এবং বর্ণবিদ্বেষ সরাসরি তুলে ধরেছিলেন। তারপর তো সীমিতই। এরমাঝেও বেশকিছু হয়েছে, যেগুলোর নাম এই আর্টিকেলের বিভিন্ন অংশে পাওয়া যাবে। তবে মূল কথা হলো ‘অল ব্ল্যাক ওয়েস্টার্ন’ কিন্তু সেভাবে নেই, কিছু সিনেমায় প্রধান চরিত্রেই শুধু কৃষ্ণাঙ্গ’রা থাকলেও। এবং অবাক করার বিষয়, এই ২০২১ সালে এসেই অবশেষে দুটো ওয়েস্টার্ন পাওয়া গেল, যেখানে সকল শিল্পীরাই কৃষ্ণাঙ্গ। এর ঐতিহাসিক মূল্য আছে। কেন এই দুটো সিনেমা গুরুত্বপূর্ণ, তা তো গোটা আলোচনাতেই টের পাওয়া যাবে।
২) Concrete Cowboy (2021)
ওয়েস্টার্ন ভাবটা আক্ষরিক অর্থেই নেমে এসেছে ফিলাডেলফিয়ার রাস্তায়! একটু চটকদারি মনোভাব থেকে লাইনটার উৎপত্তি হলেও, প্রিমাইজ ধারণা কিন্তু এমনই। সবথেকে বড় কথা হলো, কোন ফিকশনাল গল্প নয়, সত্য গল্পকে ভিত বানিয়েই তৈরি এই সিনেমা। ফিলাডেলফিয়ার ঘোড়সওয়ারিদের একটুকরো সংস্কৃতি নিয়েই এই সিনেমা। ফিলাডেলফিয়ার উত্তরে কিছু সংখ্যক ব্ল্যাক আমেরিকান কাউবয়দের বাস। তারা একত্রে একটা সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে ঘোড়ার দেখাশোনার একটা ভিন্নরকম সংস্কৃতি। তবে এই দেখাশোনার বিষয়টা আলাদা। কারণ এই ঘোড়াগুলো হচ্ছে সেই ঘোড়া যেগুলোর আসল ভবিতব্য আসলে, মারা পড়া। পেনসিলভানিয়ার নিলাম থেকে এদেরকে কিনে নিয়ে আনা হয় উত্তর ফিলাডেলফিয়ায়। সেখানকার ব্ল্যাক আমেরিকান কাউবয়রাই তাদের দেখাশোনা করে। উত্তর ফিলাডেলফিয়ার নোংরা, পরিত্যক্ত জায়গাগুলোতে কোনমতে কিছু জীর্ণশীর্ণ আস্তাবল বানিয়ে এই প্রাণীগুলোর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। শুধুমাত্র দরদ থেকে, মমতা থেকে। নাহয় প্রাণীগুলোকে হত্যা করাই যে অবধারিত ছিল।
এই সংস্কৃতি কিন্তু এখনকার নয়। শতবর্ষী সংস্কৃতি! শ্বেতাঙ্গ কাউবয়দের ক্যাটল ফার্মিং-এর যেই ইতিহাস, সেই ইতিহাসকে একটা ধাক্কা দিয়ে আসল ইতিহাসটাই এই সিনেমায় আসে। এই সংস্কৃতি প্রথম চালু করে উত্তর আমেরিকার আফ্রিকান-আমেরিকানরাই। শত বছরের সেই সংস্কৃতি শুরু থেকে আজও ধরে রেখেছে উত্তর ফিলাডেলফিয়ার ‘ফ্লেচার স্ট্রীট আরবান রাইডিং ক্লাব।’ এটাই ব্ল্যাক কাউবয়দের সংস্কৃতি, যেই সংস্কৃতির গল্প সিনেমার পর্দায় অনেক অনেক বছর উঠে এসেছে রিকি স্টওবের ‘কংক্রিট কাউবয়’ (২০২১) দিয়ে, ইট-পাথরের শহরের ওয়েস্টার্ন বলেই তো নামটা ‘কংক্রিট’ এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ফ্লেচার স্ট্রীট রাইডিং ক্লাব’ ও তাদের গল্পই এই সিনেমার অন্যতম কেন্দ্রভূমি।
অন্যতম বলছি এই কারণেই, সিনেমার মূল ন্যারেটিভে আছে বাবা-ছেলের গল্প। ১৫ বছরের গোলযোগপ্রিয় তরুণ কোলকে তার এই বদভ্যাসের জন্য, তার মা জোরপূর্বক রেখে আসেন উত্তর ফিলাডেলফিয়ার সড়কে। তার বাবা হার্প থাকে সেখানে। বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছে বহু বছর আগেই। কারণ হার্পের প্রকৃতি সাংসারিক নয়। ঘোড়াগুলোই তার কাছে ধ্যানজ্ঞান। তাই ছেলে আসলেও সেইদিকে খুব একটা ঘা করতে দেখা যায় না তাকে। এখান থেকেই বাবা-ছেলের দূরত্বের চেনাজানা ন্যারেটিভটা পাওয়া যায়। বাবার অমনোযোগী স্বভাব আর ছেলের এই বয়সের বিদ্রোহী স্বভাব দুটোই তাদের মাঝে বিচ্ছিন্নতাকে আরো প্রবল করে। ‘কামিং অফ-এইজ’ জনরার স্বাদটা এতেই ঢুকে যায়।
তারপর সেখান থেকে খারাপ সঙ্গে জড়িয়ে অভাব ঘোচানোর তাড়নায় মাদক বিক্রি করে তড়িৎ টাকা কামানোর চিত্রটাও উঠে আসে। যেখানে ফিলাডেলফিয়ার তরুণদের বাস্তব চিত্রের পাশাপাশি, এই বয়সে সঠিক প্যারেন্টিংয়ের অভাবে ভালো-খারাপ কী, তা না বুঝেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার হতাশাজনক সম্ভাবনার বিষয়টিও উঠে আসে। এছাড়া গ্যাং ভায়োলেন্সের চিত্রও এসেছে এতে। আর ফ্লেচার স্ট্রীটের গল্প তো এর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেই। বরঞ্চ বাবা-ছেলের দূরত্বের ন্যারেটিভটা বাদে, এই দ্বিতীয় ন্যারেটিভের রাইডিং ক্লাব সরাসরিই কাজ করে বাস্তবে। ফ্লেচার স্ট্রীট রাইডিং ক্লাবের একটা মহৎ উদ্দেশ্যও আছে। তারা তরুণ, যুবকদের পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর টাইমে দক্ষ ঘোড়সওয়ারি হয়ে উঠার প্রশিক্ষণ দেয় বাস্তবে। তারা মনে করে, এতে তরুণরা বিপথে না গিয়ে সময়ের পরিচর্যা সঠিকভাবে করবে। এভাবেই তারা গড়ে তোলে হর্সম্যানশিপের সংস্কৃতি।
গ্রেগ নেরির উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘কংক্রিট কাউবয়’ এই সকল বিষয়গুলোকেই ধরার চেষ্টা করে। বাবা বা মায়ের হেয়ালি মনোভাব, অযত্নে বেড়ে উঠা বদমেজাজী উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তান, মাদকের দুনিয়ায় জড়িয়ে পড়া, অমোঘ জটিলতার তৈরি করা; বলতে গেলে এই ছকটা বহুল ব্যবহৃত এবং অনুমেয়। তবে এই সিনেমার প্রধান পুঁজি সত্যিকারের ইতিহাসটা। চিত্রনাট্যে সেই ইতিহাসের সাথে এই চেনা ছকের মিলনটা নতুন কিছু না দিলেও, সমতা রাখতে পেরেছে বৈ। তাই গোটা ন্যারেটিভটা অনেককিছুতে ভিড়ে ভরে উঠতে উঠতেও, দম নেওয়ার মতো স্পেস রেখেছে। বেশ কয়েকটি চরিত্রের বৃত্তটার বিস্তার দরকার হলেও, তেমনটা করা হয়নি চিত্রনাট্যে। উত্তর ফিলাডেলফিয়ার এই ভুলে যাওয়া, অজানা ইতিহাসটা দর্শকদের জানাতে প্রথমদিকে বেশ এক্সপোজিশন ব্যবহার করা হয়েছে, তবে একদিক থেকে সেটা প্রয়োজনীয়ই ছিল, যদিও আরো দক্ষতা তাতে যোগ হতে পারত। কিন্তু চিত্রনাট্যে এই অংশের ডিটেইল ভালো পরিমাণেই আছে। ওয়েস্টার্ন শুধু শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের নয়, এই পাঠটা এই সময়ে এসে বেশ প্রয়োজনীয়তা আর প্রাসঙ্গিকতাই বহন করে।
তথ্য বিবরণ, মাঝে মাঝে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা ব্যবহারের পাশাপাশি ডকুমেন্টারির অনুভূতি দিয়ে সিনেম্যাটিক গল্পটাকে বাস্তবিক এবং সত্য করে তোলার প্রয়াসে ‘ফ্লেচার স্ট্রীট রাইডিং ক্লাব’-এর কিছু সদস্যদেরকেই কাস্ট করা হয়েছে কয়েকটা পার্শ্ব চরিত্রে। তবে বলতেই হয়, অভিনেতারা এই সিনেমার হৃদয়কে সর্বদা স্পন্দিত হতে সাহায্য করেছেন, যখন অন্যকিছু কাজ করছিল না তখনও। ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ সিরিজের লুকাস চরিত্রের ক্যালেব ম্যাকলাফিন, ইদ্রিস এলবার মতো অভিনেতার মুখোমুখি যথেষ্ট ক্ষমতাধর অভিনয় দিয়েছেন, ছেলের চরিত্রে। ‘হোয়েন দে সী আস’ দিয়ে আলোচিত হওয়া জ্যারেল জ্যারোম তো চরিত্রটাকে নিজের করে নিয়েছেন।
পরিচালক রিকি স্টওব, চিত্রনাট্যকার ড্যান ওয়ালসারকে নিয়ে অনেকমাসই ফিলাডেলফিয়ার সেই অংশে ছিলেন, ফ্লেচার স্ট্রীট আর ক্লাবকে জানতে-বুঝতে। সেটা অবশ্য ডিটেল আর এক্সপোজিশনে পরিষ্কার। হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা দিয়ে ডকুর ভাব দেওয়ার পাশাপাশি সিনেম্যাটিক ভিজ্যুয়ালটাও পূর্ণভাবে দিয়েছেন। ন্যাচারাল লাইট ব্যবহার করে প্রকৃতি আর নগরের বিদগ্ধ জীবনের বৈপরীত্যকে মনোহররূপে ক্যামেরায় তুলেছেন। আস্তাবলে ঘোড়াগুলোকে দেখভালের দৃশ্যগুলো উল্লেখযোগ্য। তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশার চিত্রটা তাতে পাওয়া যায়। একটা ঘোড়া আস্তাবল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর কোল তাকে যখন বশে আনার চেষ্টা করে সেই দৃশ্যের ফ্রেমিং এবং সম্পাদনার টেবিলে সেটার কাটিং বেশ উল্লেখযোগ্য। থ্রিলটাকে দারুণভাবে আনা গেছে সেই দৃশ্যে।
‘কংক্রিট কাউবয়,’ রাইডিং ক্লাবের এবং তাদের সম্প্রদায়ের মানুষদের অর্থনৈতিক দুর্গতি, বহিঃশক্তির চোখ-রাঙানিকে আরো গভীরভাবে দেখতে পারত যদিও। তবে ওয়েস্টার্ন জনরার প্রচলিত ছাঁচে, ব্ল্যাক কাউবয়দের স্বল্প-বর্ণিত এই ইতিহাসের গল্পটা কিন্তু প্রয়োজনীয়, আবারো বলছি। সেদিক থেকে নতুনও।
১) The Harder They Fall (2021)
প্রস্তাবনা দৃশ্যে যাবার আগেই ক্রেডিট লাইনে দেখা যায়, সিনেমার গল্পটা কাল্পনিক। কিন্তু এই চরিত্রগুলো পুরানো পশ্চিমে ঠিকই ছিল। চরিত্রগুলো বাস্তব থেকেই ধার করা। সেই তথ্যটাই একটু নড়েচড়ে বসার অশ্রুত নির্দেশ দেয়। এবং সেটার একটা পূর্বকথাও আছে। সিনেমা দেখতে বসার আগে এইটুকু জেনে বসা হয়েছে যে, ‘দ্য হার্ডার দে ফল’ (২০২১) একটি ‘অল ব্ল্যাক ওয়েস্টার্ন’ সিনেমা! হ্যাঁ, এটা নড়েচড়ে বসার মতোনই তথ্য। কারণ, ওয়েস্টার্ন সিনেমার ইতিহাসে কেন্দ্রীয়চরিত্রগুলোতে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে কাজের সংখ্যা আঙুলের কড়েতে গোনার মতো। ওয়েস্টার্ন সিনেমার ইতিহাস থেকে তারা বরাবরই উপেক্ষিত।
ইদানীংকালে সেই ইতিহাসটা পাল্টাচ্ছে ক্রমাগত। গ্রেট কুয়েন্টিন টারান্টিনোর অন্যতম শক্তিশালী সিনেমা ‘দ্য হেইটফুল এইট’ (২০১৫) স্যামুয়েল এল জ্যাকসনকে কেন্দ্রীয় একটি চরিত্র দেওয়ার পাশাপাশি রিভিশনিস্ট ওয়েস্টার্নের সেটিংয়ে বর্ণের বিষয়টিকেও এনেছে। এছাড়া এন্টনি ফুকয়া ‘দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’ (২০১৬) সিনেমায়ও কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন কৃষ্ণাঙ্গকেই দিয়েছেন। সাধারণের জানাশোনার বাইরে থাকা অস্ট্রেলিয়ান ওয়েস্টার্ন সিনেমা ‘সুইট কান্ট্রি’ (২০১৭) একটি সত্য ঘটনার রূপায়ন, যার কেন্দ্রে একজন কৃষ্ণাঙ্গ অভিনয় করেছে। এবং দারুণ সেই সিনেমাটি সেই সময়কার (২০ দশকের) বর্ণবৈষম্যকে নগ্নভাবেই তুলে ধরেছে।
তা ইতিহাসের কথা বলতে বেশ কিছু সিনেমার নাম টেনে একথা-ওকথা তো হলো। তবে মূল ব্যাপার হলো, ‘দ্য হার্ডার দে ফল’ এবং উপরের ‘কংক্রিট কাউবয়’ দুটোই আলাদা করে ভবিষ্যতে উল্লিখিত হবে কারণ, শুধু কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়, সবকয়টি চরিত্রই কৃষ্ণাঙ্গ। বুনো পশ্চিমে তারাও যে ছিল/আছে। তাদেরও যে সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী আছে, গল্প আছে এই দুটো তাদেরই দলিল। দুটো সিনেমাই ২০২১ এ এলো নেটফ্লিক্সেরই ব্যানারে। এবং দুটো সিনেমার আরেকটা কমন লিংক, ইদ্রিস এলবা, যিনি দুটো সিনেমাতেই অভিনয় করেছেন। তবে বিষয়ে, স্বাদে দুটো সিনেমাই আলাদা। ‘কংক্রিট কাউবয়’ ইট-পাথরের শহরে ওয়েস্টার্নকে নতুনভাবে রূপ দিতে চেয়েছে, তো ‘দ্য হার্ডার দে ফল’ বুনো পশ্চিমের রুক্ষ প্রান্তরের পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রেখেই কিছু দান পাল্টিয়ে সেই হৃদয়টাকে স্পন্দিত করেছে।
এই সিনেমার অনেক চরিত্র, যেমন: ন্যাট লাভ, স্টেজকোচ ম্যারি, ব্যাস রিভস, জিম বাকওর্থ; এরা বাস্তবেরই। তবে তাদের পারস্পরিক বিরোধের ঘটনা কাল্পনিক। গল্প পুরানো ওয়েস্টার্নকেই তুলে আনে। শুরুতেই দেখা যায় এক আউট-ল্য একজনের ঘরে ঢুকে ঘরের কর্তা এবং কর্ত্রীকে হত্যা করে। তারপর একটা ছুরি বের করে কাটা দাগ টেনে দেয় ওই দম্পতির ছেলের কপালে। এরপর গল্প যায় বহুবছর পর। সেই ছোট্ট ছেলে সেদিনের পর থেকে আর ভালোর দিকে ফিরতে পারেনি। ব্যাংক লুট, খুন এসবকেই আপনা বানিয়েছে। ভালোবাসা থেকে ছুটে ছুটে বেড়ায়। এমন সময় খবর পায় অনেক বছর আগের সেই আউট-ল্য’কে তার গ্যাং পুলিশদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ছাড়িয়ে এনেছে। এই খবর পাবার পর সেই ছেলে ন্যাট লাভ, তার গ্যাংকেও একত্রিত করে বাবা-মা হত্যার প্রতিশোধ নিতে। এর মাঝে চরিত্রদের মিথস্ক্রিয়া, চমক লাগানো কিছু বাঁক, ভরপুর বন্দুকবাজি, রসবোধ সবকিছুই স্থান নিয়েছে।
এই সিনেমা কিন্তু অনেককিছুই। ক্লাইম্যাক্সে এই সিনেমা যখন সত্যিকার অর্থেই যখন তার স্বরূপ সামনে আনে, সেই অতীত সত্য হৃদয় নিংড়ানোর ক্ষমতা রাখে। গৌরবের সাথেই নিজের মেলোড্রামাটিক ক্লাইম্যাক্সকে প্রকাশ করে এই সিনেমা। এবং হয়ে উঠেছে পারিবারিক ট্র্যাজেডির ইতিহাস, কমনীয় ভালোবাসা আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভায়োলেন্স কীভাবে ছড়ায়; তার গল্প।
এবং গল্পকার ও পরিচালক জ্যামেস স্যামুয়েলের, বোয়াজ ইয়াকিনের সাথে সম্মিলিতভাবে লেখা এই চিত্রনাট্য অনেকগুলো স্তরে গল্পটাকে প্রকাশ করেছে। ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেটিভকে একটার সাথে অপরটার সাযুজ্য রেখে এগিয়েছেন। এক ন্যারেটিভের অ্যাকশান যেন প্রতিফলিত হচ্ছে আরেক ন্যারেটিভে। প্রত্যেকটা চরিত্রকে স্বকীয় বানিয়েছেন জ্যামেস স্যামুয়েল। তাদেরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় তাদের ভিন্ন ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য। একেকজনকে একেকটা স্টাইল দিয়েছেন তিনি। এবং প্রত্যেকের মনস্তত্ত্বের গভীরেও আলোকপাত করেছেন তিনি, মূল ন্যারেটিভটাকে ভিন্ন খাতে বইতে না দিয়েই। এমন কুল চরিত্রায়নে কুয়েন্টিন টারান্টিনোর অনুপ্রেরণাটা ভালোভাবেই চোখে স্যামুয়েলের কাজে।
টারান্টিনো যেভাবে চরিত্রগুলোর ভিন্ন ভিন্ন বৃত্ত তৈরি করেন এবং সংলাপের পর সংলাপ, অবশ্যই রসবোধযুক্ত, সাজিয়ে যেভাবে ন্যারেটিভ এগিয়ে নিয়ে যান তাতে টারান্টিনো-এস্ক ব্যাপারটাই কাজ করেছে। ভায়োলেন্সেও আছে সেই ছাপ। ক্রাইসিসের মুহূর্তেও স্যামুয়েলের চরিত্রগুলো কথা বলতে ভালোবাসে। তবে যেই বিষাদীয় সুরটা অন্তঃমিলে বেজে বেজে উঠে, যেই ক্লাইম্যাক্স সামনে আসে তা স্যামুয়েলের নিজস্বই। অবশ্যই চিত্রনাট্য লেখনীতে রেখেছেন নিজের ছাপ। সাথে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে কথা বলেছেন বর্ণবিদ্বেষ, খুনোখুনি নিয়ে। সিনেমার সময় আর স্পেস তাতে একটা সর্বকালকে ধরেছে। রিভিশনিস্ট ওয়েস্টার্ন তো, নৈতিক দ্বন্দ্ব আনবে। ভালোখারাপকে ধূসর জায়গায় রাখবে, সময়টাকে পালটে দেখবে; এটাই তো রিভিশনিস্ট ওয়েস্টার্নের কাজ।
সিনেমার ‘অল ব্ল্যাক’ কাস্টিংটাও হয়েছে চমকপ্রদ। ‘লাভক্রাফট কান্ট্রি’ দিয়ে অভিভূত করা জোনাথন ম্যাজরস, সাথে- ইদ্রিস এলবা, রেজিনা কিং, ল্যাকিথ স্ট্যানফিল্ড, জ্যাজি বিটস-সহ সকলেই চরিত্রের ছন্দের সাথে নিজেদের অভিনয় দক্ষতার দারুণ সমন্বয় করেছেন। রক সঙ্গীতের উদ্দাম তালে ছুটে চলছে তাদের চরিত্ররা কিংবা তারা, যেহেতু চরিত্রগুলোতেই তারা মিশেছেন। সঙ্গীতের রেফারেন্স যেহেতু আসলোই, তাই উল্লেখ করতেই হয় এর আবহ সঙ্গীত নিয়ে। পরিচালক পেশায় একজন সংগীতজ্ঞ। তাই সিনেমার এই অন্যরকম সঙ্গীতায়োজন আলাদা একটা ছন্দ গোটা সিনেমায় এনে দেয়। এমন কম্পোজিশন, স্কোর ওয়েস্টার্ন সিনেমায় সচরাচর কিছু না। এটা জেমস স্যামুয়েলেরই আরেকটা ট্রেডমার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
শুধুই কি সঙ্গীত! সিনেমার নান্দনিকতাটা যে তিনি নিখুঁতভাবে বুঝেছেন সেটা ইমেজারি তৈরির স্টাইলেই বোঝা যায়। শব্দ আর ইমেজারির অখণ্ডিত যোগাযোগটা এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেছে কুশলী সম্পাদনায়, যে বন্দুকের সাথে সাথে দর্শক কান ও মন আর ইমেজারি একই তালে নেচে উঠে। পুরোনো পশ্চিম নয়, এক নতুন পশ্চিম। রঙ রূপায়নগুলো যেন ঠিকরে বেরুবে। সেট ডিজাইন, কস্টিউম ডিজাইন, চরিত্রদের উদ্ভট স্বভাব সবকিছু একই তানে থাকায় এক নিখুঁত ঐকতানের জগত তৈরি হয়েছে, যেটা যতটা না পশ্চিমের, তারচে বেশি স্যামুয়েলের। এই জগতের সব তারই নির্দেশনায় তৈরি। স্যামুয়েল আর তার সিনেমাটোগ্রাফার যখনই ক্যামেরার এংগেল বদলেছেন, ফোকাস বদলেছেন তখনই এমন কিছু ধরেছেন এই বিশাল ওয়াইডস্ক্রিন রেশিওতে, যা রসবোধযুক্ত করে। ভিজ্যুয়াল গ্যাগ তৈরি করেছেন বেশকিছু রীতিমত, যেটা ওয়েস্টার্নে সচরাচর নয়। এবং এই ছান্দিক, জ্যাজি ফিল্মমেকিংও সচরাচর নয়। এটাই এই ওয়েস্টার্ন আবহের মাঝে একটা পরাবাস্তব আবহ তৈরি করে!
ওই যে বললাম, এটা জেমস স্যামুয়েলেরই সিনেমা! অভিষেক সিনেমা দিয়েই নিজের স্টাইল, নিজস্ব ভাষা তৈরি করেছেন। তার চরিত্ররা যেমন কথা বলতে পছন্দ করে, সেই কথায় সুর যোগ করে ইমেজারিগুলোও নেচে গেয়ে উঠতে পছন্দ করে। এমন বিশাল কাস্টিং, এই জনরা তাকে আরো দেওয়া হলে; নিশ্চয় আরো অনেক অলংকার বদলে উদ্ভাবনী কিছু তিনি আনবেন। ঐতিহ্যবাহী ওয়েস্টার্ন রূপেই নতুন কিছু ‘দ্য হার্ডার দে ফল।’ নতুন ইতিহাস, নতুন ওয়েস্টার্ন কাউবয়/আউট-ল্য, নতুন ছন্দ।
———————————————–
২০২১-এর মতো করেই আগামী বছরগুলোতে, এই জনরায় কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে আরো কাজ হবে, আরো গল্প উঠে আসবে সেটাই প্রত্যাশা করা যায়। এবং এই দুটো সিনেমা সেইক্ষেত্রে ‘কাল্ট’ই হয়ে উঠতে পারে।