১১ সেপ্টেম্বর ২০০১; মানবসভ্যতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য তারিখগুলোর মধ্যে অন্যতম। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি লাল অক্ষরে চিহ্নিত, যা একবিংশ শতাব্দীর সময়কে পরিষ্কার দুটি ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে। দিনটি সবার কাছে পরিচিত নাইন-ইলেভেন বা ৯/১১ নামে। আমেরিকার, তথা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ভবন দুর্ঘটনার মধ্যে এর অবস্থান সবার ওপরে। প্রায় তিন হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যুকে স্মরণ করে পরবর্তী সময়ে সেই একই স্থানে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিসৌধ এবং জাদুঘর, যা পরিচিত নাইন ইলেভেন মেমোরিয়াল বা ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার মেমোরিয়াল’ নামে।
৯/১১ এর তিন বছর পর, ২০০৪ সালে নিহতদের স্মরণে দুর্ঘটনার স্থানেই একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের চিন্তা করা হয়, যার নকশা বাছাই করা হয় একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। প্রায় ৫,০০০ স্থপতির নকশার মধ্য থেকে একজন আনকোরা, অপরিচিত স্থপতির নকশাকে বিচারকরা নির্মাণের জন্য বেছে নেন, যার নাম মাইকেল আরাদ। এ ঘটনাকে স্থপতি মাইকেল আরাদ বলেন তার জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে। কারণ, এ নকশা বাস্তবায়নের সময় তিনি নিউ ইয়র্ক শহরকে নতুনভাবে চেনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ২০০৬ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর ২০১১ সালে এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
৯/১১ মেমোরিয়ালের দুটো অংশ, একটি মেমোরিয়াল এবং অপরটি জাদুঘর। জাদুঘরটি সম্পূর্ণ মাটির নিচে অবস্থিত। কেউ এই মেমোরিয়াল ভ্রমণে গেলে মাটির ওপর কেবল প্রবেশপথটাই চোখে পড়বে, বাকি পুরোটাই গাছপালায় ঢাকা। জাদুঘরে প্রবেশের জন্য মাটির ওপর যে ভবনটি নির্মিত হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে প্রদর্শনী কক্ষ বা প্যাভিলিয়ন। মাইকেল আরাদের সাথে পুরো সাইটের ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন করেছেন আরেক স্থপতি পিটার ওয়াকার।
২০০১ সালের এই মর্মান্তিক ঘটনাটির সময় স্থপতি আরাদ ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন। অন্য একটি ভবনের ছাদ থেকে তিনি দেখেছিলেন, কীভাবে দ্বিতীয় বিমানটি এসে দক্ষিণ পাশের ভবনটিতে আঘাত করেছে। ঘটনার পর আরাদ স্বপ্ন দেখেছিলেন এ স্থানে একটি স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণের, সেজন্য মাসখানেক পর তিনি প্রাথমিক কিছু স্কেচও করেছিলেন তার নকশার। যেখানে অন্যতম একটি প্রধান উপাদান ছিল পানি। আজ সেই নকশা বাস্তবায়নের পরও সেখানে পানির প্রাধান্যটাই চোখে পড়ে বেশি। কীভাবে একজন স্থপতি তার চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন একজন দর্শনার্থীর মনে, এই স্মৃতিসৌধ তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আরাদের নিজের ভাষায়,
“এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেভাবে এখন মানুষ নিউ ইয়র্ককে দেখে, তা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি চেয়েছিলাম এর একটা উত্তর খুঁজে পেতে। আমার কাছে এই নির্মাণ যেন একটা শুদ্ধিকরণ।“
মেমোরিয়ালের স্থানটি নিউ ইয়র্কের একটি অন্যতম বাণিজ্যিক স্থান। আশেপাশে প্রচুর সুউচ্চ ভবন থাকার কারণে মেমোরিয়ালটি আরও বেশি করেই চোখে পড়ে। যেন ব্যস্ত শহরের মধ্যেই ছোট্ট এক টুকরো জঙ্গল! ১৬ একরের অর্ধেক জুড়েই আছে প্রায় ৪০০ ওক গাছ। আর মেমোরিয়ালটি অবস্থিত ঠিক সেখানে, যেখানে টুইন টাওয়ারের অবস্থান ছিল। যদিও সেখানে কোনো ভবন নেই, আছে বিশাল দুটি চতুর্ভুজাকৃতির গর্ত, যা কালো মার্বেল দিয়ে ঘেরা এবং অষ্টপ্রহর তার মধ্যে জলপ্রপাতের মতো পানি গড়িয়ে পড়ছে। মার্বেলের ওপর ব্রোঞ্জ প্যানেলে খোদাই করা আছে প্রতিটি নিহত মানুষের নাম। নকশার পেছনের চিন্তা সম্পর্কে আরাদ বলেন,
“দুটি ফাঁকা অংশ হলো সেই শূন্যতা, যা তৈরি হয়েছে কয়েক হাজার নিরীহ মানুষের অন্তর্ধানে। এ শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়, যার ফলে অনর্গল প্রবাহিত পানিতেও ফাঁকা অংশটুকু কখনো ভর্তি হয় না। আর কালো দেওয়াল বেয়ে পড়তে থাকা পানিটুকু যেন চোখের জল, যা কখনো শেষ হবার নয়।“
স্থপতি আরাদ তার বাড়ির ছাদে একটি মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন তার প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী। পরবর্তী সময়ে ‘লোয়ার ম্যানহাটন ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (LMDC)’ যখন নকশা প্রতিযোগিতার ঘোষণা করে, তখন তিনি তার চিন্তা-ভাবনার বাস্তব রূপ তৈরি করেন এবং প্রতিযোগিতায় জয়ী হন। তবে যখন তিনি কাজ শুরু করেন, তিনি দেখলেন যে আরেক স্থপতি ড্যানিয়েল লিবস্কিন্ডের নকশার কিছু অংশ তার চিন্তা-ভাবনার সাথে খাপ খাচ্ছে না। লিবস্কিন্ড ভূগর্ভস্থ অংশটুকুর নকশা করেছিলেন, যেখানে পুরো মেমোরিয়ালটাই ছিল মাটির নিচে। আরাদ তার নকশার অন্যান্য অংশগুলোর প্রশংসা করলেও এ ব্যাপারটি মেনে নিতে পারলেন না। যদিও এই নকশাটিকে মান্য করা ছিল প্রতিযোগিতার পূর্বশর্তগুলোর মধ্যে একটি।
“এই অংশটুকু আমার কাছে দেখে মনে হয় যেন বাধাপ্রাপ্ত একটি জায়গা এবং মানুষের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা। আমি নিউ ইয়র্ককে যতটুকু চিনি, আমার অভিজ্ঞতা বলে, নিউ ইয়র্কের মানুষের জীবনে পাবলিক প্লেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন স্থান যেখানে সবাই একসাথে আসবে এবং নিতান্ত অপরিচিত মানুষেরাও একে অপরের পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবে। যেখানে আপনি অনুভব করবেন সামাজিকতা এবং সৌহার্দ্য, যা আপনাকে করে তুলবে সাহসী। সেই ভয়াবহ আক্রমণের পর একটি সময় এসেছিল একতার, যা অত্যন্ত সুন্দর ছিল। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও এটি পুরো পৃথিবীকে এক করতে পেরেছিল।“
আরাদ তাই পরিবর্তন আনলেন লিবস্কিন্ডের নকশাতে। পাবলিক প্লেসের গুরুত্ব মাথায় রেখে তিনি মেমোরিয়ালের জায়গায় নিউ ইয়র্কবাসীদের জন্য তৈরি করলেন বিশাল এক প্লাজা, যার মর্মস্থলে সেই দুটো গর্ত অবস্থিত। যা এককালে ছিল বিখ্যাত সেই ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’ এর পাদদেশ। আরাদের প্রকৃত নকশায় এই আট একরের এই দুটো গর্তের ঠিক নিচে একটি গ্যালারি রয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। সেখানে নিহতদের নাম খোদাই করা দেয়ালের গা বেয়ে জলপ্রপাতের পানিটুকু পড়বে, যেন ঠিক মৃত্যুর পরের জীবন। আবার দর্শনার্থীরা যখন মাটির ওপরে, রাস্তার সমতলে উঠে আসবে, আরাদের ভাষায় সেটি যেন ‘নবজীবন ফিরে পাওয়া’। তবে তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, যখন নিরাপত্তাজনিত কারণে নকশার এই অংশটুকু পুরোপুরি বাতিল হয়ে যেতে বসেছিল।
আরাদের জন্য একটি কঠিন কাজ ছিল আক্রমণের শিকার মানুষগুলোর নামের তালিকা তৈরি, বাছাই এবং খোদাই। কর্তৃপক্ষের সাহায্যে এবং নিহতদের পরিবারের সহযোগিতায় তালিকা প্রস্তুতিতে লেগে যায় বেশ কয়েকটা বছর। আক্রমণের মুখে কারা প্রথমেই নিহত হয়েছিলেন, কারা পরবর্তী সময়ে, কে কোথায় অবস্থান করছিলেন এবং কারা ছিলেন পরস্পরের আত্মীয় ও পরিচিত- এসব আলাদা করে আবার নকশায় অন্তর্ভুক্ত করা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য একটি কাজ। আরাদের মতে,
“অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট হওয়ার একটা ভয় ছিল। অনেকেই অনেক আজেবাজে ধারণা দিচ্ছিল। তবে আমি কৃতজ্ঞ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের কাছে এবং এর প্রধান ও নিউ ইয়র্কের মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গের কাছে।“
অবশেষে মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সহায়তায় আরাদ এই কঠিন কাজ সাফল্যের সাথেই শেষ করতে সক্ষম হন।
মাইকেল আরাদের আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল পৃথিবীবিখ্যাত স্থপতি সান্তিয়াগো কালাত্রাভার মুখোমুখি হওয়া। একই জায়গায় কালাত্রাভা নকশা করেছিলেন ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ট্রানজিট হাব’, যা ২০১৫ সালে উদ্বোধন হওয়ার কথা। কালাত্রাভা তার ভূগর্ভস্থ স্টেশনে বেশ কিছু ‘স্কাইলাইট’ ডিজাইন করেছিলেন, যা নির্মিত হলে মেমোরিয়াল থেকে বেশ সহজেই চোখে পড়ত এবং দেখলে মনে হতো মেমোরিয়ালেরই অংশ।
আরাদের কাছে এ স্কাইলাইট ছিল অত্যন্ত প্রখর, যা কার্যত তার মেমোরিয়ালের নকশার নিজস্বতাকে একপ্রকার ধ্বংসই করে দিচ্ছিল। এ সমস্যা সমাধানে তিনি মেয়রের হস্তক্ষেপ চাইলেন এবং নিজেও বেশ অনেকবার ব্যক্তিগতভাবে কালাত্রাভার সাথে দেখা করলেন। তিনি কালাত্রাভাকে প্রস্তাব দিলেন স্কাইলাইট কমিয়ে আনতে এবং কীরকম পরিবর্তন হলে তার মেমোরিয়ালের নিজস্বতা বজায় থাকবে তা নিজে বোঝার এবং দেখানোর জন্য তিনি কালাত্রাভার নকশা ধারও নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে কালাত্রাভা, আরাদের প্রস্তাব অনুযায়ী তার নকশার পরিবর্তন করেছিলেন। যদিও সান্তিয়াগো কালাত্রাভার তুলনায় মাইকেল আরাদ সেরকম বড় কোনো স্থাপত্য ব্যক্তিত্ব নন, এবং তিনি চাইলেই আরাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। এ ব্যাপারে কালাত্রাভা বলেন,
“আমি এই বিশেষ স্থানটির গুরুত্বটুকু বুঝি। এখানে আমার ডিজাইন করা স্টেশনের চাইতে মেমোরিয়াল থাকাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
৯/১১ মেমোরিয়ালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাইকেল আরাদের বক্তব্যের একটি অংশ দিয়ে শেষ করা যাক। তিনি দুটি ছবি দেখিয়েছিলেন। একটিতে দেখা যাচ্ছিল, একজন মানুষ মেমোরিয়ালে খোদাইকৃত তার প্রিয়জনের নামটিতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন এবং অন্য ছবিটিতে দুটো বাচ্চা মেয়ে প্লাজাতে খেলছিল-
“এটি হচ্ছে একটি নাট্যমঞ্চ, যেখানে প্রয়োজনীয় দৃশ্য, সাজ-সরঞ্জাম, আলো সবই রয়েছে, প্রয়োজন শুধু অভিনেতার। মেমোরিয়ালে আসা দর্শনার্থীরাই হলেন সেই অভিনেতা, যারা এই মৃত স্থানে প্রাণ সঞ্চার করবেন। এই দুটো ছবি একই দিনে তোলা, এবং এখন সময় এসেছে সামনে এগোনোর, এ দুটো ঘটনা একসাথে ঘটার, ঠিক সেভাবেই, যেভাবে দুটো ছবি পাশাপাশি রয়েছে।“