ঘরের জানালাটা আলগা করে খুলে হয়তো ভোর দেখা হয়নি কখনো, সঞ্চয়ের টাকা থেকে খানিকটা খরচ করে নিজ শহর থেকে একটু দূরে কোনো দর্শনীয় জায়গায় হয়তো যাওয়া হয়ে উঠেনি, নিজ দেশ থেকে দূর পরবাসে খানিকটা দিনের জন্য অতিথি হওয়াও হয়তো হয়ে উঠেনি, তাই বলে কি ঘরে বসে স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখে কল্পনায় কিছু জায়গা থেকে আমরা ঘুরে আসতে পারি না? চলুন, আজকে ভ্রমণ করে আসি বিশ্বের এমন কিছু শহর থেকে, যেখানে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রার মান সবার চাইতে অনেক বেশি উন্নত।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় কনসালটেন্সি ফার্ম ‘মার্সার’ প্রতি বছর ‘কোয়ালিটি অফ লিভিং ইনডেক্স‘ প্রকাশ করে থাকে যেখানে কিছু মাপকাঠির বিচারে বিশ্বের সকল দেশের উপর জরিপ করা হয় এবং এর ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয় কিছু শহরকে। এসব শহরের অধিবাসীরা সাধারণত সর্বাপেক্ষা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন এবং তাদের জীবনযাত্রার মান বেশ উন্নত।
জরিপের মাপকাঠিসমূহ
১. রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশ
২. অর্থনৈতিক অবস্থা
৩. সমাজ-সংস্কৃতিগত অবস্থা
৪. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার মান
৬. পাবলিক সার্ভিস এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা
৭. বিনোদন
৮. ভোগ্যপণ্যের সহজলভ্যতা
৯. বাসস্থান
১০. প্রাকৃতিক পরিবেশ
এবার তাহলে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া যাক। ঘুরে আসি ২০১৭ সালের নির্বাচিত ১০টি শহর থেকে যেখানে মানুষের জীবনযাত্রার মান সর্বাধিক উন্নত।
ভিয়েনা
ভিয়েনা শহরকে অস্ট্রিয়ার রাজকীয় রাজধানী বলা হয়ে থাকে। রাজকীয় ঐতিহ্য এবং চমৎকার আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে ভিয়েনাকে সাজানো হয়েছে। রাজকীয় দর্শন, শিল্প ও সংস্কৃতি, কফি হাউজ, আরামদায়ক সরাইখানা এবং ভিয়েনার বিখ্যাত কবিতার জন্য শহরটি জনপ্রিয়।
এখানে প্রচুর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মিউজিয়াম ও গ্যালারি রয়েছে। কুন্সথিস্টোরিসেস মিউজিয়াম, মিউজিয়াম কোয়ার্টিয়ার এর মতো বিখ্যাত সব মিউজিয়াম রয়েছে এখানে।
স্ট্রব, মোজার্ট, বেথোভেন, হেইডেন-এর মতো বিখ্যাত কম্পোজারের জন্ম এবং কর্মস্থল এই ভিয়েনা শহর। এখানকার ফিলহার্মোনিক অর্কেস্ট্রা বিশ্ববিখ্যাত।
জুরিখ
সুইজারল্যান্ডের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র হলো জুরিখ। সুইজারল্যান্ডবাসীর জন্য কেনাকাটার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থল হচ্ছে এ শহরটি।
কুন্সথাস এবং রিটবার্গে রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর্ম। শহরে রয়েছে প্রায় ৫০০টিরও বেশি বার এবং ক্লাব। এছাড়া এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই উন্নত।
ওকল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডের একটি শহর ওকল্যান্ড। সুষম অর্থনৈতিক অবস্থাসম্পন্ন, মনোরম পরিবেশ এবং হাই লেভেলের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণে শহরের মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত।
সুন্দর সী-বীচ, হাইকিং টেইল আর আকর্ষণীয় দ্বীপ দ্বারা পরিবেষ্টিত এ শহর। এখানকার আবহাওয়া রৌদ্রোজ্জ্বল এবং এখানে পলিনেশিয়ান সংস্কৃতির উপস্থিতি রয়েছে।
মিউনিখ
জার্মানের ‘পাওয়ার হাউজ’ বলা হয় মিউনিখকে। এটি একটি আধুনিক কসমোপলিটান শহর। হাই টেক শহর হওয়ার কারণে বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন- বিএমডাব্লিউ, ম্যান (ট্রাক মেকার), এমটিইউ (এরোইঞ্জিন মেকার) প্রভৃতির হেডকোয়ার্টার রয়েছে এখানে।
ভ্যানকুভার
কানাডার তৃতীয় জনবহুল মেট্রোপলিটান শহর ভ্যানকুভার। সম্প্রতি আরেকটি জরিপে শহরটি উত্তর আমেরিকার ‘বসবাস উপযোগী সর্বশ্রেষ্ঠ শহর’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। ভ্যানকুভার কানাডার জাতিগতভাবে বৈচিত্রপূর্ণ এক শহর। শহরটি সমুদ্র এবং পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরম থাকে এবং তা প্রায়শই অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শীতকাল থেকে এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
এই সময়টা সবাই স্কিয়িং এবং স্নো-বোর্ডিংয়ে মেতে ওঠে। ভ্যানকুভারের যোগাযোগ ব্যবস্থা এককথায় চমৎকার। বাস, স্কাই ট্রেন, কমিউটার রেল, সি বাস- সবই রয়েছে শহরবাসীর সময় বাঁচিয়ে দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
ডাসেলডর্ফ
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য পরিচিত এ শহরটি অবস্থিত পশ্চিম জার্মানিতে। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন দুনিয়ার জন্য ডাসেলডর্ফ এক অন্যতম প্রাণকেন্দ্র।
এই শহরটি স্থাপত্যপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য, পুরো শহর জুড়েই রয়েছে প্রচুর স্থাপত্যকর্ম।
ফ্রাংকফুর্ট
ফ্রাংকফুর্ট অবস্থিত জার্মানিতে। এটি ইউরোপের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ অর্থনৈতিক কেন্দ্র। চাকরীর ক্ষেত্রে ফ্রাংকফুর্টের বেশ সুনাম রয়েছে।
এখানে কর্ম জীবনকে খুব সুন্দরভাবে ব্যালেন্স করা হয়। চাকরিজীবীরা বছরে ৩০ দিন ছুটি পেয়ে থাকেন। এ সময়ে তারা আশেপাশের শহর এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভ্রমণ করে থাকেন। ফ্রাংকফুর্টকে জার্মানির ‘সবুজ নগরী’ বলা হয়ে থাকে।
শহরে প্রায় ৫০টিরও বেশি সবুজ জায়গা সম্বলিত পার্ক রয়েছে।
জেনেভা
জেনেভা শহরটি সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত। এটি বিশ্ব কূটনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এবং এ শহরে রয়েছে বিশ্বের বহু ধনী লোকের বসবাস। শহরটিতে রয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
মন্ট্রিল
মন্ট্রিল অবস্থিত কানাডায়। এটি কানাডার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং পশ্চিমা বিশ্বে প্যারিসের পরে ফ্রেঞ্চ ভাষাভাষী সবচেয়ে বেশি লোকজন রয়েছে মন্ট্রিলে। অর্থ, বাণিজ্য ও প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে শহরটি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মন্ট্রিলের অধিবাসীদের ‘রাতের জীবন’-এর জন্য এ শহরের খ্যাতি জগতজোড়া। শহরে উত্তর আমেরিকানের চেয়ে ইউরোপিয়ান ভাবটাই বেশি পরিলক্ষিত হয়। মন্ট্রিলের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এখানকার বাসা ভাড়া কানাডার অন্যান্য এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত কম। এখানে দেখা মেলে ৪টি ঋতুর- শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎকাল। শীতকালে কখনও কখনও তাপমাত্রা -২০° সেলসিয়াস বা তারও নিচে নেমে আসে।
মাউন্ট রয়্যাল পাহাড় মন্ট্রিলের এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। রাস্তায় নিরাপদে সাইকেল চালানোর জন্য শহরটিতে রয়েছে প্রায় ৪০০টির মতো স্টেশন।
এছাড়াও এখানে রয়েছে পাতালপথ যা বিভিন্ন শপিংমল, বাস স্টেশন, অফিস, এপার্টমেন্ট, ব্যাংক প্রভৃতির সাথে সংযুক্ত। তীব্র শীতে এই পাতালপথ অনেকের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।
এবার আসা যাক মন্ট্রিলের খাবারদাবার নিয়ে। এখানে এত রেস্টুরেন্ট রয়েছে যে বলা হয়ে থাকে ‘নর্থ আমেরিকা’র ‘বেস্ট ফোর ডাইনিং সিটি’র মধ্যে মন্ট্রিল একটি। পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশের খাবার আপনি চেখে দেখতে পারবেন এখানে।
পার্থ
পার্থ শহরটির অবস্থান অস্ট্রেলিয়ায়। প্রায় ২.০৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার শহরটি রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে। বিশ্বের কিছু সেরা সমুদ্র সৈকত, লোভনীয় খাবার, চমৎকার আবহাওয়া ও মানুষের বন্ধুবাৎসল্য শহরটিকে ভিন্নতা এনে দিয়েছে। পার্থের মানুষের জীবনযাত্রার স্বচ্ছন্দতাই বলে দেয় এখানকার জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে। এখানকার মানুষেরা বিভিন্ন সামাজিক উৎসব উপলক্ষে প্রায়শই একত্রিত হয়। প্রবাসীদেরকেও খুব সহজে আপন করে নেয় তারা। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান কোস্টলাইনে রয়েছে বেশ কিছু সেরা সি বীচ। বেশিরভাগ সি বীচেই রয়েছে কার পার্কিংয়ের সুবিধা। এছাড়াও বাস বা ট্রেনে করেও সরাসরি যাওয়া যায়।
এই শহরে রয়েছে প্রচুর মূল্যবান আকরিক এবং কয়লা। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে চীন তাদের কাঁচামালের জন্য এখান থেকে আকরিক ও কয়লা সংগ্রহ করে থাকে।
এসবের ফলে পার্থের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে বেশ দ্রুত এবং অনেক ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য এলাকার অধিবাসীদের চেয়ে এখানকার মানুষের আয় অনেক বেশি। শহরের বেশিরভাগ মানুষই পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত না করে নিজস্ব বাহনে যাতায়াত করে থাকে। ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়ার কারণে প্রায় সারা বছরই এখানে উষ্ণ ও রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া থাকে।