গ্রামবাংলার দৃশ্য কল্পনা করতে গেলে শুরুতেই মাটি, গোলপাতা কিংবা খড়ের তৈরি দোচালা ঘরের ছবি যে কারো মাথায় চলে আসবে। সপ্তদশ শতকের দিকে বঙ্গ অঞ্চলে জোড় বাংলা (যা লোকমুখে চার-চালা বা জরু বাংলা নামেও পরিচিত) নামক এক ধরনের স্থাপত্য রীতি মন্দিরের নকশায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই রীতি অনুযায়ী পুরো মন্দিরের নকশায় দুটো অংশ থাকে। ইমারতের স্থায়িত্বের কথা বিবেচনা করে দুটি চালা সেখানে পাশাপাশি জোড়া দিয়ে দেয়া হয়। একটি চালা ব্যবহৃত হয় বারান্দা হিসেবে, অপরটি মন্দির হিসেবে। এমন স্থাপত্যশৈলীর নমুনা পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনায়, বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে, পুরুলিয়া জেলার গড়পঞ্চকোটে, হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় আর বাংলাদেশের পাবনা শহরে। এছাড়া আরও বেশ কিছু জোড় বাংলা মন্দির বাংলায় রয়েছে, তবে মূলত পাবনার জোড় বাংলা গোপীনাথ হিন্দু মন্দিরটি নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
জোড় বাংলা গোপীনাথ মন্দির। বাংলাদেশের পাবনা জেলায় অবস্থিত দুটি জোড় বাংলা মন্দিরের মধ্যে এটি বেশি প্রসিদ্ধ। অপর মন্দিরটিকে একজন সাধুর মাজার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এখন। আর এই কাজের জন্য জোড় বাঙ্গাল মন্দিরটির পোড়ামাটির ফলকগুলো ধ্বংস করে সম্পূর্ণভাবে এর কাঠামো বদলে ফেলা হয়েছে। দেখা বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটিও একসময় জোড় বাংলা মন্দির ছিল। ঠিক একইভাবে, পুরো বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দশটি জোড় বাংলা মন্দিরের মধ্যে টিকে আছে শুধুমাত্র এই একটিই। গোপীনাথ জোড় বাংলা মন্দিরটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক স্বীকৃত। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মন্দিরটি সম্পর্কে পর্যটকদের এতো কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও, এর প্রতিষ্ঠাকাল কিংবা নির্মাতা সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণাকে কেন্দ্র করে পাবনার জোড় বাংলা মন্দিরের ইতিহাস এখানে উল্লেখ করা হলো।
পাবনা শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কালাচাঁদ পাড়া নামক একটি এলাকা রয়েছে। এখানেই অবস্থিত বিখ্যাত জোড় বাংলা মন্দির। গুগল আর্থ ইমেজেও দেখা যায় মন্দিরটি। উত্তরমুখী এই মন্দিরটির দক্ষিণ দিকে প্রায় ৫০ মিটার দূরে রয়েছে কানা পুকুর। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা দক্ষিণ রাঘবপুরে বাঁকানো একটি কাঠামো নিয়ে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মন্দিরটি।
বর্তমানে এখানে কোনো দেবদেবীর পূজার্চনা করা হয় না। ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক রাধারমণ সাহার দেয়া তথ্য অনুযায়ী এককালে এখানে গোপীনাথের মূর্তি ছিল, নিয়মিত তার পূজাও হতো। সেখান থেকে মন্দিরটি গোপীনাথের মন্দির হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এখানে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি ছিল বলেও জানা যায়। এখানে সর্বশেষ কবে পূজা হয় সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯১০ সালে স্থানীয় কালী মন্দিরে গোপীনাথের মূর্তিটি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তখন থেকে তা ওখানেই আছে। অপরদিকে নাজিমউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই জোড় বাংলা মন্দিরটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়নি বলে সেখানে কখনোই পূজার্চনা হয়নি। একটি পরিত্যক্ত মঠ হিসেবেই আজীবন পড়ে আছে এটি।
মন্দিরের সামনের দিকে তিনটি অর্ধবৃত্তাকার খিলান বিশিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে। দরজায় এবং বাইরের দিকে নকশা করা ইটের কারুকাজ মন্দিরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে। আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নির্মিত এই মন্দিরটির নির্মাতা হিসেবে মুর্শিদাবাদের নবাবের তহসিলদার জনৈক ব্রজমোহন ক্রোড়ী অধিক পরিচিত। যদিও এখানে কোনো শিলালিপি পাওয়া না যাওয়ায় এ ব্যাপারগুলো নিশ্চিত হয়ে বলার কোনো উপায় নেই। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এই ইমারতটি প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষণের জন্য গৃহীত হয়।
স্থানীয় জনগণের ভাষ্যমতে, পাবনা পৌরসভার শত বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৯৭৬ সালের ‘স্মরণিকা’ পত্রিকাটিতে উল্লেখ রয়েছে যে ব্রজমোহন ক্রোড়ী মতান্তরে বজ্রবল্লভ রায় ক্রোড়ী পাবনায় একটি জোড় বাংলা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সাথিয়ানী গ্রামের ভোলানাথ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া একটি দলিলেও নির্মাতা হিসেবে ব্রজমোহনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নির্মাণকালটা যে ঠিক কখন, তা নিশ্চিত হওয়ার মতো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ষোড়শ শতাব্দী থেকে বাংলায় একের পর এক মন্দির নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। এইসব মন্দিরের সাথে মিশে আছে একাধিক রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক ঘটনা। রাজনৈতিক দিক থেকে বলতে গেলে, এই সময়টা ছিল সম্রাট আকবরের এবং পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরের। একই সময়ে গৌদিয়া বৈষ্ণবের উদ্ভব হওয়ায় তখনকার পদ্য কিংবা সামগ্রিক সাহিত্যে কালীর প্রতি ভক্তি বা চৈতন্যের একটি বার্তা পৌঁছাতে থাকে ঘরে ঘরে। তাই ভিন্ন ধর্মের প্রজারা যাতে সম্রাটদের উপর নাখোশ না হয় তা মাথায় রেখেই বেশি করে মন্দির নির্মাণ শুরু করেন সম্রাটরা। একটি ধারা যখন শুরু হয়ে যায় তখন তা নিয়ে নানারকমের গবেষণাও চলতে থাকে। নাগারা, চালা, রত্ন, রেখা, জোড় বাংলা এই সব স্থাপত্য শৈলী আসলে তৎকালীন গবেষণারই ফলাফল। পাবনার এই জোড় বাংলা মন্দিরের দুটি চালা একত্রে ইংরেজি ‘M’ অক্ষরের মতো আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বের চালাটিকে বলা হয় ‘মান্দাপা’ আর পশ্চিমের চালাটি ‘গর্ব গৃহ’ নামে পরিচিত। পরেরটিকে বাংলা ভল্টও বলেন কেউ কেউ। এই মন্দিরটির নির্মাণ শৈলী বাংলার অন্যান্য মন্দির থেকে কিছুটা ভিন্ন। দোচালা ঘরের দুই প্রান্ত নিচু, মাঝখানে শিরদাঁড়ার মতো করে উঁচু একটি কাঠামোর দেখা পাওয়া যায়। ইট নির্মিত একটি অনুচ্চ বেদীর উপর মন্দিরের মূল কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরটির উপরের পাকা ছাদ বাংলার দোচালা ঘরের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রবেশপথ এবং তৎসংলগ্ন স্তম্ভ ও দেয়ালের নির্মাণ কৌশলের সাথে দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরের কিছুটা সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। গোপীনাথ মন্দিরের দেয়াল ও স্তম্ভে এক সময় প্রচুর পোড়ামাটির চিত্রফলক অলংকৃত ছিল। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মন্দিরের যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়।
এই ইমারতটি ভাস্কর্য শিল্পের একটি দারুণ নিদর্শন। আকারে ছোট হলেও দৃশ্যত বেশ কিছু সুন্দর ছোট ছোট পোড়া ইটের কারুকাজ করা নকশা মন জুড়িয়ে দেয়। দেয়ালগুলো বেশ প্রশস্ত কিন্তু সেই তুলনায় ভেতরের কামরাগুলো অপ্রশস্ত বলা চলে। দেশ ভাগের পর দীর্ঘদিন যাবত অনাদরে, অবহেলায় পড়ে ছিল মন্দিরটি। যার ফলে বেশ ক্ষতি হয়ে যায় ইমারতটির। পরবর্তীতে আইয়ুব খানের আমলে ১৯৬০ এর দশকে পাবনা জেলা প্রশাসকের প্রচেষ্টায় ইমারতটির আমূল সংস্কার করা হয়।
মন্দিরটির দিকে তাকালে এক নজরেই চোখে পড়বে বৃষ্টি এবং আর্দ্রতার কারণে পোড়ামাটির ফলক ক্ষয়ে গেছে অনেকাংশে, তাছাড়া মাটির লবণাক্ততার জন্য কাঠামোতেও নকশার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। সংরক্ষিত এই স্থাপনার প্রতি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার ফলেও মন্দিরটির হাল দিন দিন খারাপ হয়ে পড়ছে। তার উপর, খোলা জায়গার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই ‘বাড়িটিকে’ স্থানীয় শিশু-কিশোররা খেলার মাঠে পরিণত করে ফেলেছে। কাজেই সবদিকের অত্যাচারে মন্দিরটির এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
ঢাকা থেকে পাবনার বাসে চড়ে পাবনা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে অটো বা ব্যাটারি চালিত টমটমে করে মন্দিরে পৌঁছে যেতে পারবেন। স্বল্প খরচে, স্বল্প সময়ে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এমন একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখে আসলে সময়ের সঠিক ব্যবহারই হবে। মন্দিরটির যে বিপন্ন দশা, তাতে আর কত বছর তা টিকে থাকতে পারবে তা প্রশ্নের দাবি রাখে। কাজেই মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ নেয়া এখনই জরুরি।