মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কায় অবস্থিত ‘দ্বিতীয় হাসান মসজিদ’ (মাসজেদ আল-হাসান আল-থানি) হচ্ছে বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ মিনার বিশিষ্ট মসজিদ। এটি একই সাথে বিশ্বের ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু। এই মসজিদের একমাত্র মিনারটির উচ্চতা ২১০ মিটার, যা প্রায় ৬০ তলা ভবনের সমান! ১৯৯৩ সালে নির্মিত এই মসজিদটির মুসল্লি ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার। এর মিনারের চূড়ায় একটি লেজার বিম অবস্থিত, যা থেকে কাবা ঘরের দিক বরাবর সর্বদা একগুচ্ছ আলোক রশ্মি বিচ্ছুরিত হতে থাকে।
হাসান আল-থানি মসজিদটি মরক্কোর সবচেয়ে বড় মসজিদ। এর অবস্থান মুসলিম বিশ্বের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে, ঠিক আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে। মসজিদটির অংশবিশেষ সমুদ্রের পানিতে ভাসমান। এর সমুদ্রের পানিতে ভাসমান অংশের উপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া যায়, যদিও সাধারণ মুসল্লিদের জন্য কাঁচের তৈরি স্বচ্ছ মেঝের মধ্য দিয়ে নিচের পানির দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ নেই। সমুদ্রের তীরে অবস্থিত হওয়ায় মসজিদটিতে নামাজরত মুসল্লিরা সব ধরনের দূষণ থেকে মুক্ত থেকে সমুদ্রের মুক্ত সতেজ হাওয়া উপভোগ করতে পারেন।
নির্মাণের ইতিহাস এবং অর্থায়ন
হাসান আল-থানি মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন মরোক্কার রাজা দ্বিতীয় হাসান। তার নামানুসারেই মসজিদটির এই নামকরণ করা হয়। মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কা অনেক বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক একটি শহর হলেও, ঘনবসতি বিশিষ্ট হাজার হাজার দালান-কোঠার ভিড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম, এমন কোনো স্থাপনা এখানে ছিল না। রাজার উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়ে তিনি মরক্কো, বিশেষ করে ক্যাসাব্লাঙ্কার জন্য একটি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ‘ল্যান্ডমার্ক’ স্থাপন করবেন।
ফরাসি স্থপতি Michel Pinseau-র নকশায় মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। প্রাথমিকভাবে ১৯৮৯ সালে রাজার ৬০ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মসজিদটির উদ্বোধন করার লক্ষ্য থাকলেও সেটি সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে রাসূল (সা) এর জন্ম/মৃত্যু বার্ষিকীর দিন আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করা হয়।
রাজা দ্বিতীয় হাসানের উদ্যোগে নির্মিত এই মসজিদ কমপ্লেক্সটি ছিল নিম্ন-মধ্য আয় বিশিষ্ট মরক্কোর ইতিহাসের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮০০ মিলিয়ন ডলার, যার যোগান দেওয়া মরক্কোর সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটি বিরাট অংশ সংগ্রহ করা হয় দেশের জনগণের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে।
প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ এই মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থের যোগান দেন। তাদের সবাইকে সরকারের পক্ষ থেকে অনুদানের রশিদ এবং একটি করে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। সাধারণ মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং কুয়েত, সৌদি আরব সহ কিছু আরব রাষ্ট্রও নির্মাণ কাজের অর্থায়নের ব্যাপারে সাহায্য করে। এছাড়াও কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্রও এ কাজের জন্য ঋণ প্রদান করে।
মসজিদটির বৈশিষ্ট্য
হাসান আল-থানী মসজিদ কমপ্লেক্সটি ক্যাসাব্ল্যাঙ্কার সমুদ্রতীরে প্রায় ৯ হেক্টর জমির উপর অবস্থিত। মসজিদটির ভেতরে ২৫,০০০ এবং বাইরের চত্বরে আরও ৮০,০০০ মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে। এতে নারীদের নামাজ আদায়ের জন্য পৃথক একটি বারান্দা আছে, যার ধারণ ক্ষমতা ৫,০০০।
মসজিদটির আয়তাকার কেন্দ্রীয় হল, যেখানে নামাজ পড়া হয়, সেটি একটি বিশালাকৃতির ভবন। এর দৈর্ঘ্য ২০০ মিটার, প্রস্থ ১০০ মিটার এবং ভূমি থেকে ছাদ পর্যন্ত উচ্চতা ৬০ মিটার, যা প্রায় ১৭ তলার সমান। আয়তাকার হলের ছাদটি ৭৮টি বিশালাকৃতির স্তম্ভের উপর স্থাপিত। হলঘরটি কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
মসজিদটির আংশিক মাটির উপর এবং আংশিক পানির উপর ভাসমান। পানির উপরে ভাসমান অংশের মেঝের কিছু স্থান কাঁচের তৈরি, যেখান থেকে মসজিদের নিচে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার দৃশ্য সরাসরি উপভোগ করা যায়। তবে এই সুবিধাটি জনসাধারণের জন্ম উন্মুক্ত নয়, এটি শুধু রাজপরিবারের সদস্যরা এবং নির্বাচিত বিশেষ অতিথিরাই পেয়ে থাকেন।
মসজিদ ছাড়াও এই বিশাল কমপ্লেক্সের মধ্যে আছে একটি মাদ্রাসা, হাম্মাম তথা গোসলখানা, মরক্কোর ইতিহাস সম্বলিত একটি জাদুঘর, একটি কনফারেন্স হল এবং একটি সুবিশাল লাইব্রেরি। শুধুমাত্র মাদ্রাসাটিই ৪,৮৪০ বর্গ মিটারের বিশাল ভূমির উপর অবস্থিত। ভূগর্ভস্থ এক তলা ছাড়াও আরও দুই তলা জুড়ে নির্মিত এই মাদ্রাসাটির আকার অর্ধ-চন্দ্রাকৃতির। মাদ্রাসা, কনফারেন্স হল এবং লাইব্রেরির কক্ষগুলোতে অত্যাধুনিক অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তির ব্যবস্থা আছে।
মসজিদ প্রাঙ্গণে আছে ৪১টি সুসজ্জিত পানির ফোয়ারা। মসজিদের বাইরে চারিদিক জুড়ে অবস্থিত বাগানটিকে নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। বাগানটি সপরিবারে পিকনিক করার জন্য খুবই জনপ্রিয়।
মসজিদটির ভূগর্ভস্থ অংশে আছে অজু করার স্থান এবং তার্কিশ স্টাইলে নির্মিত বিশাল পাবলিক বাথরুম তথা হাম্মাম, যদিও হাম্মামটি ব্যবহার করা হয় না। মসজিদের কেন্দ্রীয় হলের ছাদটি দুই পাশে সরে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে যেতে সক্ষম। ৩,৪০০ বর্গ মিটার আকারের এই ছাদটির ১,৭৫০ বর্গ মিটারই উন্মুক্ত হতে পারে। ১,১০০ টন ওজনের এই ছাদটি একটি মোটরের সহায়তায় খুলে যেতে সময় নেয় মাত্র পাঁচ মিনিট।
ছাদটি বন্ধ থাকা অবস্থায় ৫০টি ঝাড়বাতি হলটিকে আলোকিত করে রাখে, যাদের কয়েকটির ব্যাস ৬ মিটার, উচ্চতা ১০ মিটার এবং ভর ২০০ কেজি। দিনের বেলা ছাদটি খুলে দেওয়া হলে মুসল্লীরা খোলা আকাশের নিচে সূর্যের আলোয় আলোকিত হলঘরে নামাজ আদায় করতে পারেন। অথবা রাতের বেলা হলে চাঁদ-তারার কোমল আলো এবং হলরুমের চারপাশের দরজাগুলো থেকে বিচ্ছুরিত আলো হলরুমটিকে আলোকিত রাখে।
মসজিদের মিনার
মসজিদের মিনারটি বর্গাকৃতির। ২১০ মিটার উঁচু এই মিনারটি মরক্কোর সবচেয়ে উঁচু ভবন। এটি একই সাথে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মিনার এবং উঁচু ধর্মীয় স্থাপনা। মিনারটির চূড়ায় যে লেজার বিমটি আছে, সেটি থেকে সমুদ্র বরাবর কাবা ঘরের দিকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি ৩০ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যায়। মিনারটি সবুজ, গাঢ় সবুজ এবং নীল রংয়ের টাইলস দ্বারা সুসজ্জিত।
মিনারটির অস্বাভাবিক উচ্চতার জন্য এটি নির্মাণের জন্য মসজিদটির প্রধান কন্ট্রাক্টর Bouygues এর গবেষণা বিভাগ বিশেষ ধরনের কনক্রিট ব্যবহার করেছে, যা সাধারণ কনক্রিটের চেয়ে চার গুণ শক্তিশালী। এর ফলে মিনারটি প্রচণ্ড বাতাস এবং ভূমিকম্পেও অটল দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে।
মসজিদের স্থাপত্যশৈলী
মসজিদটিতে ইসলামিক এবং মরোক্কান স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে। এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন বিখ্যাত মসজিদ এবং ইসলামিক স্থাপত্যের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদটির ভেতর এবং বাহির জুড়ে যে অসাধারণ কারুকাজ, তার প্রায় সবই হস্তশিল্প। ছয় হাজার শিল্পী এবং কারিগর পাঁচ বছর ধরে মসজিদটির দৃষ্টিনন্দন মোজাইক, পাথর এবং মার্বেলের মেঝে ও স্তম্ভ এবং খোদাইকৃত কাঠের ছাদে নকশার কাজ করেছেন।
মসজিদে ব্যবহৃত সকল গ্রানাইট, মার্বেল, প্লাস্টার, কাঠ সহ অধিকাংশ নির্মাণ সামগ্রী মরক্কো থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে, শুধুমাত্র বিশেষ কিছু গ্রানাইটের নির্মিত স্তম্ভ এবং ৫৬টি কাঁচের তৈরি ঝাড়বাতি বাদে, যেগুলো ইতালির ভেনিস থেকে আনা হয়েছে। মসজিদটিতে রয়েছে বিশালাকৃতির দৃষ্টিনন্দন স্তম্ভ এবং ঘোড়ার ক্ষুরাকৃতির খিলান এবং অসংখ্য খাঁজ কাটা জ্যামিতিক নকশা।
মসজিদটির কেন্দ্রীয় আয়তাকার হলরুমটি বিশ্বের অধিকাংশ মসজিদ থেকে ভিন্ন। সাধারণত মসজিদের দিক এমন হয়, যেন কেবলামুখী হয়ে দাঁড়ালে নামাজের সারিগুলো যথাসম্ভব প্রশস্ত হয় এবং সেই তুলনায় কেবলা বরাবর মসজিদের দৈর্ঘ্য কম হয়। কিন্তু হাসান আল-থানি মসজিদের কেবলার দিক বরাবর দৈর্ঘ্য ২০০ মিটার এবং নামাজের সারির প্রস্থ ১০০ মিটার। এই ১০০ মিটার প্রস্থ তিনটি অংশে বিভক্ত। মাঝখানের অংশটি সবচেয়ে চওড়া এবং উঁচু, দু’পাশের অংশগুলো সেই তুলনায় একটু কম প্রশস্ত। দু’পাশের মধ্যবর্তী তলা দুটো নারীদের নামাজের জন্য বরাদ্দ।
পর্যটনের স্থান হিসেবে মসজিদ
মুসলিম বিশ্বের সর্ব পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত হাসান আল-থানি মসজিদটি এর অবস্থান এবং বিশালত্বের জন্য পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ক্যাসাব্লাঙ্কা এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে শহরটির যেকোনো স্থান থেকে এর সুউচ্চ মিনারটি দৃশ্যমান। এটি মরক্কোর খুব অল্প সংখ্যক মসজিদের একটি, যেটিতে অমুসলমানদেরও প্রবেশাধিকার আছে।
পর্যটকদের জন্য মসজিদটিতে দিনের মধ্যে কয়েকবার কয়েক ঘণ্টা ব্যাপী আরবি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান এবং স্প্যানিশ ভাষায় গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা আছে। এই ট্যুরের আওতায় নামাজের হল, ভূগর্ভস্থ অজু করার স্থান এবং হাম্মাম দেখানো হয়। মসজিদে প্রবেশ করতে হলে দর্শনার্থীদেরকে অবশ্যই ‘শালীন এবং সম্মানজনক’ পোশাক পরিধান করতে হয়। নারীদের জন্য অবশ্য মাথায় স্কার্ফ পরা বাধ্যতামূলক নয়। তবে অবশ্যই তাদের হাঁটু এবং হাতের কনুই পর্যন্ত ঢাকা থাকতে হবে।
যদিও খুব শীঘ্রই আলজিয়ার্সের গ্র্যান্ড মসজিদের কাছে হাসান আল-থানি মসজিদটি তার উচ্চতার রেকর্ড হারাতে যাচ্ছে, তবুও মসজিদটি নিঃসন্দেহে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের এবং ইসলামিক স্থাপত্যশিল্পের এক অন্যন্য সৃষ্টির উদাহরণ হয়ে থাকবে।