
ব্রিজ বা সেতু বললেই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের নদী বা কোনো জলাশয়ের উপর নির্মিত যানবাহন চলাচলের জন্যে ব্যবহৃত সেতুগুলোর কথায় মনে পড়ে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে এমন অনেক সেতু যেখানে আছে মানুষের বসতি, বাজার, সুপারশপ, এমনকি গয়নার দোকান পর্যন্ত। এমনি কিছু দৃষ্টিনন্দন সেতুর প্রতিচ্ছবি উঠে আসবে আজকের লেখায়।
পন্টে ভেকিউ, ফ্লোরেন্স
ইতালির রাজধানী রোম থেকে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দূরে আর্নো নদীর তীরে ফ্লোরেন্স শহরটির অবস্থান। প্রাচীন ইতালির ইতিহাসে শহরটির বেশ তাৎপর্য রয়েছে। এই শহরে পুরাতন অনেক স্থাপত্য কীর্তি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। তবে এসবের মধ্যে কয়েক’শ বছর পুরনো এক সেতু ‘পন্টে ভেকিউ’ (Ponte Vecchio) এখনো সবাইকে বিস্মিত করে রেখেছে।

ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে অবস্থিত পন্টে ভেকিউ সেতু; Source: citywallpaperhd.com
ধারণা করা হয়, ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে সেতুটি তৈরি করা হয়। তবে সেতুটি কখনো যানবাহন চলাচলের জন্যে ব্যবহার করা হয়নি। সেতু তৈরি করার পর থেকে সেখানে বিভিন্ন দোকান সরকার কর্তৃক অনুমতি সাপেক্ষে ভাড়া দেয়া হতো এবং ব্যবসা করার জন্য ঋণও দেয়া হতো। যদি কোনো দোকানদার ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হতো তখন রাজার আদেশে রাজ্যের সৈন্যরা সেই দোকানের জায়গার অধিকার নিয়ে নিত। দোকানের পণ্য বিক্রি করে ঋণের টাকা তোলা হতো এবং পুনরায় অন্য কোনো ব্যবসায়ীকে ভাড়া দেয়া হতো। তবে মজার ব্যাপার হলো, ইতালীয় ভাষায় ‘ব্যাঙ্করোট্টো’ বা ঋণখেলাপির ধারণাটি নাকি এখান থেকেই প্রথম শুরু হয়।

পন্টে ভেকিউর রাস্তায় পথচারীদের একাংশ; Source: documentarytube.com
এখানে অনুমোদিত দোকানগুলোর মধ্যে মূলত কসাইখানা, মাছ এবং চামড়ার ব্যবসার জন্যে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এসকল দোকান থেকে বিভিন্ন বর্জ্য ফেলা হতো নদীর জলে, যার কারণে নদীর পানি এবং সেতুর চারপাশ অসম্ভব ময়লা হয়ে পড়ছিল। ফলে সেতুর চারপাশে দুর্গন্ধ ও আবর্জনা ছড়িয়ে থাকতো। ফ্লোরেন্সের শাসক পরিবারের প্রাসাদটি ছিল সেতুমুখী। ফলে সেতুর দুর্গন্ধ বাতাসে বয়ে যেত প্রাসাদের চারপাশে। এই অবস্থা দেখে সেই অঞ্চলের শাসক ‘ডিউক ফেরদিনান্দো ডি মেডিসি’ বাজারের দোকানগুলো উচ্ছেদ করে দিলেন এবং সেখানে স্বর্ণের দোকানের অনুমোদন দিলেন। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত সেতুটিতে স্বর্ণের ব্যবসায় খুব জাঁকজমকভাবে চলছে।

পন্টে ভেকিউর একটি স্বর্ণের দোকানের ভেতরকার দৃশ্য; Source: birdsphotographer.com
ক্রেমারব্রুক, এরফার্ট
কেন্দ্রীয় জার্মানের একটি প্রদেশ থুরিঙ্গিয়া যার রাজধানী হলো এরফার্ট। গেরা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটি থুরিঙ্গিয়ার সবচাইতে বড় শহরও বটে। এই শহরেই অবস্থিত শহরটির অন্যতম আকর্ষণ অনেক বছরের পুরনো সেতু ক্রেমারব্রুক। জার্মান ভাষায় ক্রেমারব্রুক (Krämerbrücke) বলতে বোঝায় বণিকদের সেতু।

জার্মানীর ক্রেমারব্রুক সেতু; Source: ontheluce.com
এই সেতু প্রস্থে অনেকটাই প্রশস্ত। সেতুটির দু’পাশে রয়েছে উঁচু উঁচু কাঠের তৈরি বাড়ি। আর বাড়িগুলোর নিচে রয়েছে বিভিন্ন দোকান। দোকানগুলোতে বিক্রি হয় সব ধরনের গৃহস্থালি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কারুশিল্প, কাপড়, কাঁচের জিনিস, গহনা, হাতের তৈরি আকর্ষণীয় জিনিসপত্র ইত্যাদি। এছাড়াও এখানে ক্যাফে, রেস্তোরাঁ ও স্ট্রিট ফুডের ব্যবস্থা রয়েছে। দু’পাশের বাড়ির মাঝখানের রাস্তার উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে পথচারীরা কেনাকাটা করতে পারেন।

সেতুর দু’পাশে দোকানের সারি; Source: commons.wikimedia.org
এরফার্টের উপর দিয়ে বাণিজ্যিক রাস্তা তৈরি করার পরিকল্পনা থেকে সেতুটির মূল কাঠামো তৈরি করা হয়। ১১১৭ সালে নির্মিত এই রাস্তাটির কাঠামোটি ছিল মূলত কাঠের। কিন্তু সেতুতে আগুন লেগে যাওয়ার কারণে ১৩২৫ সালে সেতুটি পাথর দিয়ে পুননির্মাণ করা হয়। তখন সেতুটির দু’পাশে কাঠের ঘর এবং দু’প্রান্তে দুটি পাথরের গির্জা তৈরি করা হয়। কিন্তু ১৪৭২ সালে আরো একবার বিধ্বংসী আগুনের কবলে পড়ে পুরো সেতুটি। বলাই বাহুল্য প্রায় সব বাড়িঘরসহ সেতুটি অসম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে যে সেতুটি রয়েছে সেটি ৩২টি বাড়ি এবং একটি গির্জা দিয়ে পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছিল।

সেতুর দু’পাশে দোকানের সারি এবং মাঝে পথচারীদের ভিড়; Source: visit-thuringia.com
রিয়ালতো সেতু, ভেনিস
জলের শহর, আলো ও ভালোবাসার শহর, পর্যটক মার্কো পোলোর শহর ইতালির এই ভেনিস। পৃথিবীর সবচাইতে রোমান্টিক শহর বলে আখ্যায়িত করা হয় ভেনিসকে। চারপাশে অথই পানির মধ্যে গড়ে ওঠা অপূর্ব এই নগরীতে রয়েছে চারশোর বেশি সেতু। সান মারকো ও সান পলো জেলা দুটির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ‘গ্র্যান্ডকেনেলে’র চারটি সেতুর মধ্যে প্রাচীনতম সেতুটি হলো রিয়ালতো সেতু। ১২৫৫ সালে প্রথম কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় সেতুটি। শহরের পূর্ব দিকটার সাথে রিয়ালতো বাজারের যোগসূত্র স্থাপন করার জন্যেই এই সেতু নির্মাণ করা হয়।

ভেনিসের রিয়ালতো সেতু; Source: accessibleitalianholiday.com
কিন্তু কাঠের তৈরি সেতু রক্ষণাবেক্ষণ করা ছিল বেশ ব্যয়সাধ্য এবং অস্থায়ী। তখন একটি পাথরের তৈরি সেতুর প্রস্তাবনা দেয়া হয়। অবশেষে বিদ্যমান কাঠের সেতুটির আদলে নতুন করে ১৫৯১ সালে একটি পাথরের সেতু নির্মাণ করা হয়। সেতুটি দু’পাশ দুদিকে ঢালু করে তৈরি করা হয় যার পুরোটাই আচ্ছাদিত হয়ে আছে অসংখ্য দোকানের সারি।

রিয়ালতো সেতুকে পর্যটকদের রয়েছে অশেষ আগ্রহ; Source: myveniceapartment.com
এই সেতুর উপর থেকে খালের চারপাশটা অসম্ভব মনোমুগ্ধকর দেখায়। অনেক যুগলকে দেখা যায় সেতুর নিচে উপস্থিত হন এবং কাছাকাছি গির্জায় ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে প্রেমিক-প্রেমিকারা নিজেদের চুম্বন করে। প্রচলিত আছে এমনটায় দুজনের মধ্যে ভালোবাসা চিরস্থায়ী হয়। অনেক নাটক ও চলচ্চিত্রের চিত্রায়নও এই ব্রিজের উপর করা হয়।

রিয়ালতো সেতুর নিচে এক দম্পতি; Source: acitybornlove.blogspot.com
পুলতেনে সেতু, বাথ
যুক্তরাজ্যের সামারসেটের অন্তর্গত সবচাইতে বড় শহর বাথ। এভন নদীর তীরবর্তী এই শহরটি যুক্তরাজ্যের অনেক প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো শহরটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্থপতি রবার্ট এডাম, পন্টে ভেকিউ সেতু এবং রিয়ালতো সেতু দেখে অনুপ্রাণিত হয় পুলতেনে (Pulteney Bridge) সেতুটির নকশা করেন।

যুক্তরাজ্যের বাথে অবস্থিত পুলতেনে সেতু; Source: pulteneybridgeflowers.co.uk
১৭৭৪ সালের দিকে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। কিন্তু পরবর্তী ৩ শতাব্দী ধরে সেতুটিতে এতটাই পরিবর্তন আনা হয়েছে যে এটি এখন রবার্ট এডামের স্বপ্নের সেতুর সাথে অনেকটাই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সেতুটি অনেকটাই জার্মানি ক্রেমারব্রুকের আদলে নির্মিত।

পুলতেনে সেতুর দু’পাশের দোকানপাট এবং মাঝের রাস্তা; tripadvisor.co.z
সেতুটির দু’পাশে রয়েছে দোকানের সারি আর মাঝখানে রয়েছে পথচারী এবং যানবাহন চলাচলের রাস্তা। যুক্তরাজ্য তাদের বিদ্যমান স্থাপনাগুলোকে ইতিহাস এবং স্থাপত্যশৈলীর উপর ভিত্তি করে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে। পুলতেনে সেতুটি যুক্তরাজ্যের স্থাপনাগুলোর মধ্যে প্রথম সারি বা ‘গ্রেড-১’ শ্রেণীভূক্ত।

যুক্তরাজ্যের প্রথম শ্রেণীভুক্ত স্থাপত্য এই পুলেতেন সেতু; Source: sccs.swarthmore.edu
এছাড়াও যুক্তরাজ্যের ‘ওল্ড লন্ডন ব্রিজ’ ও ‘ব্রিজ হাউস’, ফ্রান্সের প্যারিসে ‘পন্ট নটরডেম’ সেতুগুলোও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শত শত বছরের এসকল পুরনো স্থাপনা বয়ে চলেছে অনেক দিনের ইতিহাস। সেতুগুলোর উপর নির্মিত ঘরবাড়ি ও দোকানগুলোতেও রয়েছে অনেক বছরের প্রাচীনতা। এখানকার অনেক দোকান ব্যবসা করছে কয়েক প্রজন্ম ধরে। শুধু আধুনিকতার স্রোতে ভেসে না গিয়ে দেশগুলো এখনো ধরে রাখার চেষ্টা করছে তাদের শিকড়কে, তাদের হাজার বছরের ইতিহাসকে। সেতুগুলো এখন আর শুধু সেতু হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে এক একটি কাল অতিক্রম করার নীরব সাক্ষী।
ফিচার ইমেজ- flickr.com