মুসলমানরা ভারতবর্ষ জয় করে প্রথমে অষ্টম শতকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে এবং পরবর্তীতে দশম শতকে সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে। কিন্তু তারও অনেক আগে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবদ্দশাতেই, সপ্তম শতকের প্রথম ভাগে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অনেকটা নীরবে-নিভৃতে ইসলাম প্রবেশ করে আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে।
আর সেখানেই নির্মিত হয় ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ- চেরামন জুমা মসজিদ। এটি শুধু ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদই না, আরব বিশ্বের বাইরে নির্মিত পৃথিবীর প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি। চলুন জেনে নেওয়া যাক, ভারতবর্ষের বুকে প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠার অবিশ্বাস্য গল্পটি।
ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে, আরব সাগরের উপকূলে, বর্তমান কেরালা রাজ্যে এক হিন্দু রাজা ছিলেন, যার নাম ছিল চেরামন পেরুমল। কথিত আছে, একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, আকাশের চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে গেছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাজা তার সভার বিজ্ঞজনদের কাছ থেকে স্বপ্নের অর্থ জানতে চাইলে, কেউ কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। রাজার মনে অস্বস্তি থেকেই যায়।
সেসময় ভারতের সাথে আরবের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক ছিল। আরব দেশীয় বণিকরা সমুদ্রপথে ভারতে এসে বাণিজ্য করত। রাজার স্বপ্নের কিছুদিন পরেই একদল আরব মুসলমান বণিক, রাজা চেরামনের সমুদ্র বন্দরে এসে পৌঁছে। তখন দিকে দিকে ইসলামের জয়জয়কার। এই বণিকদের কাছ থেকে রাজ্যে এই নতুন ধর্ম ইসলাম এবং এর নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর প্রশংসা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এক সময় মহানবী (সা) এর আঙুলের ইশারায় চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করার কাহিনীও রাজার কানে এসে পৌঁছে।
রাজা বণিকদেরকে ডেকে তাদের কথা শোনেন এবং বুঝতে পারেন যে, তার স্বপ্নে তিনি এই ঘটনাটিরই ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বণিকদলের সাথে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কথিত আছে, সেখানে তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা) এর সাথেও সাক্ষাৎ করেন এবং ‘তাজউদ্দিন’ নাম গ্রহণ করেন। মক্কা থেকে ভারতে ফেরার আগেই যাত্রাপথে ওমানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার আরব সঙ্গীদেরকে ভারতে গিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য অনুরোধ করেন এবং তাদের হাতে তার রাজ্যের সভাসদদের উদ্দেশ্যে লেখা একটি চিঠি তুলে দেন। সেই চিঠিতে তিনি নিজ রাজ্যে একটি মসজিদ স্থাপনের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেন।
বণিকদল রাজার চিঠি নিয়ে আবারও কেরালায় আসে। রাজার নির্দেশ অনুযায়ী তারা ৬২৯ সালে ভারতের বুকে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করে। রাজা চেরামনের নাম অনুসারে মসজিদের নাম রাখা হয় চেরামন জুমা মসজিদ। স্থানীয় স্থাপত্য অনুযায়ী তৈরি এ মসজিদটি দেখতে অনেকটাই হিন্দুদের মন্দিরের মতো। ধারণা করা হয়, এটি বিশ্বের প্রথম মসজিদগুলোর একটি, যেখানে জুমার নামাজের আয়োজন করা হয়।
লিখিত ইতিহাস না থাকায় এবং মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া গল্পের উপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচিত হওয়ায়, কিছু কিছু ইতিহাসবিদ চেরামন মসজিদের প্রতিষ্ঠার এই কাহিনীর সাথে একমত পোষণ করেন না। কেরালার স্থানীয় ইতিহাসবিদ রাজন গুরুক্কল মনে করেন, মসজিদটি হয়তো একাদশ অথবা দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়ে থাকতে পারে। তবে মসজিদের ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সায়ীদ বলেন, এটিই ভারতে নির্মিত প্রথম মসজিদ।
মসজিদের ভেতরে অবস্থিত একটি ফলকে মসজিদটির প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে ৬২৯ সাল লেখা আছে, যদিও ফলকটি সম্ভবত পরবর্তী কোনো সংস্কারকার্যের সময় স্থাপিত। ইতিহাসবিদরা মসজিদটির প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারলেও, মুসলমান বণিকরা যে এর কাছাকাছি সময়ে ঐ অঞ্চলে এসেছিল, এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে খুব একটা দ্বিমত নেই।
হাজার হাজার বছর ধরেই ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমের এই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর সাথে আরবের বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় ৩,০০০ বছর আগে হযরত সোলায়মান (আ) এর সময় থেকেই মিসরীয়দের মশলা ক্রয়ের জন্য এই এলাকায় আসার ইতিহাস পাওয়া যায়। আরবীয় বণিকরা মৌসুমী বায়ুপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে ভারতে আসত, এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ করে পরবর্তী ঋতুতে বিপরীত দিকের বায়ুপ্রবাহের জন্য অপেক্ষা করত এবং এরপর সেই বায়ুপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে আবার ফেরত যেতো।
মাঝখানের এই সময়টা তাদের অনেকেই স্থানীয় নারীদেরকে বিয়ে করে সংসার করত। প্রাচীন মিসরীয় এবং সিরিয়ানরা অনেকেই এই অবসরকালীন সময়ে নিজেদের প্রার্থনার জন্য উপাসনালয়ও গড়ে তুলেছিল। এই অঞ্চলে তাই পাশাপাশি হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান-খ্রিস্টান সবগুলো ধর্মের উপাসানালয়ই দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই ইসলামের আবির্ভাবের পরপরই ব্যবসা করতে আসা আরবীয় বণিকরা এখানে মসজিদ গড়ে তোলা মোটেও অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা না।
স্থানীয় ইতিহাস অনুযায়ী, যার নেতৃত্বে চেরামন জুমা মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তিনি হলেন মালিক দিনার নামে এক মুসলমান ব্যবসায়ী এবং ধর্মপ্রচারক। মালিক দিনার শুধুমাত্র এই মসজিদটিই না, বরং কেরালার বিভিন্ন অংশে আরও কয়েকটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিখ্যাত।
মালিক দিনারের সত্যিকার পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। কিছু ইতিহাসবিদ তাকে মালিক ইবনে দিনার নামের আরেকজন মুসলিম সুফি সাধকের সাথে মিলিয়ে ফেলার কারণে তার অবদান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু মালিক ইবনে দিনার নামে যার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়, তিনি ছিলেন হযরত হাসান বসরি (র) এর ছাত্র, আর তার জীবনী থেকে দেখা যায়, তিনি কখনোই ভারতবর্ষে আসেননি।
ইতিহাসবিদ বাহাদুর সি গোপালানের বর্ণনা অনুযায়ী, চেরামন মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা তাই মালিক ইবনে দিনার না, বরং মালিক দিনার। তিনি ছিলেন রাসূল (সা) এর সাহাবি। তিনি ভারতে এসেছিলেন তার চাচাতো ভাই মালিক ইবনে হাবিবের সাথে, যিনি রাসূল (সা) এর চাঁদ দ্বিখন্ডিত করার ঘটনাটির একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
মালিক দিনারের প্রকৃত নাম অবশ্য জানা যায় না। ধারণা করা হয়, ‘দিনার’ শব্দটি তার মূল নামের অংশ না, এটি স্থানীয়দের দ্বারা তাকে দেওয়া সম্মানসূচক উপাধি। ইতিহাসবিদদের ধারণা, ‘দিনার’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘দ্বীন’ শব্দটি থেকে, যার অর্থ ধর্ম। ‘দ্বীন’ শব্দটির সাথে মালায়লাম ভাষার উপসর্গ ‘অর’ যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছে ‘দিনর’ বা ‘দিনার’ শব্দটি, যার অর্থ, যিনি ধর্ম ধারণ করেন।
মালিক দিনার মোট তিনবার ভারতে এসেছিলেন বলে জানা যায়। প্রথমবার তিনি আসেন মালিক ইবনে হাবিবের সাথে, যখন রাজা চেরামন পেরুমল ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাদের সাথে মক্কায় গমন করেন। দ্বিতীয়বার তিনি ভারতে আসেন রাজা পেরুমলের মৃত্যুর পর তার চিঠি নিয়ে। এ সময়ই তিনি চেরামন জুমা মসজিদটি সহ আরও কিছু মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর শেষ বয়সে তিনি আবারও ভারতে আসার পথে মৃত্যুবরণ করেন।
মূল চেরামন জুমা মসজিদটি আকারে খুবই ছোট ছিল, পরবর্তীতে একাধিক সংস্কারের মাধ্যমে এটি বর্তমান আকার লাভ করে। মূল মসজিদটি কাঠের তৈরি ছিল, যার কেন্দ্রীয় মূল কাঠামোর কিছু অংশ আজও অক্ষত আছে। প্রথমে একাদশ শতাব্দীতে এবং পরে ১৯৭৫ সালে মসজিদটি দুটি বড় ধরনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে যায়।
মসজিদটির ভেতরে একটি প্রাচীন তেল প্রদীপ আছে, যেটি সর্বদা প্রজ্বল্যমান। ধারণা করা হয়, এটি প্রায় ১,০০০ বছর ধরে জ্বলছে। শুধু মুসলমান না, অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও এই প্রদীপের জন্য তেল সরবরাহ করে। কেরালার অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ের মতো এই মসজিদটিও সকল ধর্মবিশ্বাসীদের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত। অমুসলমানরাও এই প্রাচীন ঐতিহাসিক মসজিদটিতে তাদের সন্তানদের হাতেখড়ি দিয়ে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মনিরপক্ষে চরিত্রের কেরালার এই মসজিদটিতে দিনের কিছু কিছু সময় হিন্দুরাও প্রার্থনা করে থাকে।
ভারত সরকার জাতিসংঘের সহায়তায় এই মসজিদটি সহ এর আশেপাশে বিশাল এলাকা জুড়ে যে প্রাচীন স্থাপত্যগুলো রয়েছে, সেগুলোকে পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণের বিশাল উদ্যোগ নিয়েছে। মুজিরিস হেরিটিজ প্রজেক্ট নামের এই প্রকল্পের অধীনে থাকবে একটি মশলা জাদুঘর সহ মোট ২৭টি জাদুঘর, পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম এরকম ৫০টি আকর্ষণীয় স্থান এবং প্রাচীন রোমান সভ্যতার নিদর্শন সম্বলিত একটা খননকৃত এলাকা। এই প্রকল্পটি ২০০৯ সালে শুরু হয়েছে। সম্প্রতি এর প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। চেরামন মসজিদ কর্তৃপক্ষও এই প্রকল্পের সাথে মিল রেখে মসজিদটিকে সর্বশেষ সংস্কারের পূর্বাবস্থায় নিয়ে যেতে আগ্রহী, যাতে ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি পঞ্চদশ শতকের রূপ লাভ করে।
ফিচার ইমেজ- ilatimes.com