প্রাচীনকালে মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল অরণ্য। বন-জঙ্গল, গাছের ডালপালা ছিল তার থাকার জায়গা। খাবার বলতে ছিল গাছের ফল কিংবা জন্তু-জানোয়ারের মাংস। আর এভাবে মানুষ হয়ে পড়ে অরণ্যচারী। পরবর্তীতে ঝড়-বৃষ্টি, প্রচন্ড খরতাপ আর হিংস্র জন্তুদের হাত থেকে বাঁচতে সে আশ্রয় নিল পাহাড়ি গুহায়। কিন্তু সময়ের নানা বিবর্তনে পাথর, বন্যজন্তুর হাড়, গাছের ডালপালা দিয়ে প্রথম ঘর বানাতে শিখল মানুষ।
প্রস্তর যুগ পেরিয়ে তাম্রযুগ, ব্রোঞ্জ যুগ এবং লৌহ যুগে এসে মানুষের ঘর বানানোর নানা কলাকৌশলে আরো দক্ষতা দেখাতে শুরু করলো। কিন্তু অরণ্যের প্রতি তার ভালোবাসা তেমনই রয়ে গেলো। আর তাই তো অরণ্যের মধ্যে সে এমন সব বাড়ি ঘরবাড়ি তৈরি করতে থাকলো, যাতে সে ফিরে পেতে চাইলো প্রাচীন যুগের সেই রহস্যময়তা। এসব বাড়ি তৈরির নকশায় কত রকম যে চমক দেখিয়েছেন স্থপতিরা, তা দেখে অনেকেই তাজ্জব বনে যান। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এ বাসস্থানগুলোতে থাকার জন্য পর্যটকদের ভিড় তাই লেগেই থাকে সারা বছর। প্রকৃতির সান্নিধ্যে তৈরি হওয়া তেমনি কয়েকটি অদ্ভুত বাড়ির সন্ধান দেবো আজ আপনাদের।
গাছবাড়ির গ্রাম, কোস্টারিকা
জঙ্গলে বাড়ি তৈরি করার কথা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। কিন্তু গাছের উপর বাড়ি তৈরির মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে আস্ত এক গ্রামের, সে কথা আমরা কজনেই বা জানি! তেমনি এক গাছ-গ্রামের জন্ম হয়েছে কোস্টারিকায়।
মধ্য আমেরিকার দেশ কোস্টারিকার একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর, অন্যদিকে ক্যারিবিয়ান সাগর। পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা এই দেশে বছরে প্রায় ছয়-সাত মাস ধরে বৃষ্টি হয়। দেশের এমন এক বৃষ্টিস্নাত জঙ্গলে প্রায় এগারো বছর আগে, আমেরিকার কলোরাডো প্রদেশ থেকে এক দম্পতি এসে ৬২ একর জমি কেনেন। ইচ্ছে ছিল, পর্যটকদের জন্য জঙ্গল কেটে বাড়ি-ঘর তৈরি করবেন। চাষাবাদ করার পরিকল্পনাও তাদের ছিল।
কিন্তু জঙ্গল আর প্রকৃতির ভালোবাসায় পড়ে তাদের ভাবনাটাই গেল বদলে। গাছ কাটার বদলে গাছের মধ্যেই বাড়ি করে থাকতে লাগলেন তারা। তারপর আরো বাড়ি তৈরি হলো। সেসব বাড়ি বিক্রি করলেন বেশ ভালো দামে। এভাবে চলতে-চলতে আজ ৬০০ একর জঙ্গলের মালিক এই দম্পতি।
কোস্টারিকার জঙ্গলে এই দম্পতি তৈরি করে ফেলেছেন এক আস্ত গাছবাড়ির গ্রাম। সেখানে দড়ির মই, দড়ির ব্রিজ কিংবা দড়ির পুলিতে চড়ে নিজের বাড়িতে পৌঁছতে হয়। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়ার জন্য এক গাছ থেকে আরেক গাছের মধ্যে কাঠের সিঁড়ি ব্যবহার করা হয়।
জলপ্রপাত বাড়ি, পেনসিলভেনিয়া
পাহাড়, জঙ্গল আর জলপ্রপাত। তার মাঝে নির্মিত হয়েছে এক অনিন্দ্যসুন্দর বাড়ি। যেন রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসা কোন রাজপুরী। এ বাড়ি তৈরি হয়েছে একেবারে জলপ্রপাতের উপর। পাহাড়ের বুকে ঘরের মধ্যে জল পড়ার শব্দ, সবুজ প্রকৃতির মধ্যে যেন মায়াবি এক পরিবশে। ১৯৩৫ সালে আমেরিকার পূর্ব প্রান্তের প্রদেশ পেনসিলভেনিয়ায় এই বাড়িটি তৈরি করেন বিখ্যাত মার্কিন স্থাপত্যবিদ ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট। বলা হয়ে থাকে, রাইটের জীবনের সেরা নকশা ছিল এই জলপ্রপাত বাড়ি।
তৎকালীন মার্কিন ধনকুবের এডগার পেনসিলভিনিয়ার অ্যাপ্লেশিয়ান পাহাড়ের মাঝে ‘বেয়ার রান’ জলপ্রপাতের অংশে কিছুটা জমি কিনে নিলেন বাড়ি বানাবেন বলে। ছেলে জুনিয়র এডগারের কথায় সেখানে বাড়ি বানানোর দায়িত্ব দিলেন স্থাপত্যবিদ লয়েডের উপর। লয়েড গোটা জায়গা দেখে সার্ভে করে নিয়ে গেলেন। কিন্তু কোনো নকশাই তার মনঃপুত হচ্ছিল না, কোনো নকশাতেই ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। কোনো নকশাতেই পুরো স্থানটির অপার সৌন্দর্য দৃশ্যমান হচ্ছিল না।
অপেক্ষা করতে করতে আর থাকতে না পেরে একদিন সিনিয়র এডগার লয়েডকে ফোনে বললেন যে, তিনি যাচ্ছেন লয়েডের অফিসে নকশা দেখতে। অথচ তখনো কোনো নকশাই করে উঠতে পারেননি লয়েড। দু’ঘণ্টার মধ্যে এডগার পৌঁছানোর আগে চটজলদি তৈরি করে ফেললেন একটি নকশা। তবে সেটা সিনিয়র এডগারের খুব একটা পছন্দ হলো না। কারণ তিনি চেয়েছিলেন বাড়ির সামনে জলপ্রপাত থাকবে। কিন্তু লয়েড তো জলপ্রপাতের উপরেই গোটা বাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।
যা হোক, লয়েডের নকশায় ভরসা রেখেই সেই বাড়ি তৈরি করলেন সিনিয়র এডগার। গেরুয়া আর কালচে লাল রঙের এই বাড়ি আজও স্থাপত্যবিদ্যায় এক মাইলফলক হয়ে রয়েছে। বাড়ি তৈরিতে খরচ পড়েছিল প্রায় দেড় লক্ষ মার্কিন ডলার। বর্তমানে এই বাড়ি ‘ওয়েস্টার্ন পেনসিলভেনিয়া কনজারভেন্সির সম্পত্তি। জুনিয়র এডগার ১৯৬৩ সালে এটি দান করে দেন। পরের বছর সেখানে একটি পরিবেশ মিউজিয়াম চালু হয়। এই বাড়ি দেখতে প্রতি বছর এক লক্ষেরও বেশি মানুষ আসেন।
পাখির বাসা, সুইডেন
উত্তর ইউরোপের একটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ হলো সুইডেন, যার একদিকে নরওয়ে আর অন্যদিকে ফিনল্যান্ড। উত্তর মেরুর কাছে বলে ঠাণ্ডা আর বরফের অভাব নেই অঞ্চলটিতে। সুইডেনে ২৫টি প্রদেশ রয়েছে, যার মধ্যে একেবারে উত্তরভাগে রয়েছে ল্যাপল্যান্ড প্রদেশ। এই প্রদেশে লইলো ও বৌদেন নামে দুটি প্রাচীন শহর রয়েছে, যেখানে পাহাড়ও আছে, সমুদ্রও আছে। আর আছে বেশ কিছু ন্যাচার পার্ক, সংরক্ষিত জঙ্গল। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর মর্যাদা পেয়েছে এর কয়েকটি।
এই বৌদেন শহরের পাশের জঙ্গলে ২০১০ সালে প্রথম তৈরি হয় এক গাছবাড়ি। বাড়িটির নাম দেয়া হয় ‘দ্য বার্ডস নেস্ট’, পাখির বাসা। বেসরকারি উদ্যোগে এটি তৈরি করা হয়েছিল কেবল পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে। জঙ্গলে ঘুরতে এসে সেখানে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা সংগ্রহের জন্য এই পাখির বাসাকেই বেছে নেন পর্যটকেরা। চারদিকে গাছের মাঝে ঝুলে রয়েছে কাঠের বাড়ি। বাইরেরটা দেখলে কেউ বলবে না যে, সেটি কোনো মানুষের বাসের উপযোগী কোনো বাড়ি।
পাখিরা যেমন ছোট খড়কুটো দিয়ে নিজেদের ঘর তৈরি করে, এই গাছবাড়ির বাইরেরটা দেখতে অবিকল তেমন। কেবল আকারে বড়। আসলে গাছের ডাল দিয়ে বাড়িটির চারদিক ঘিরে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে জানলাগুলোও দেখতে পাওয়া যায় না্। অথচ বাড়ির ভেতরটা কিন্তু একেবারেই আলাদা। ঝকঝকে আধুনিক সব ব্যবস্থা দিয়ে সাজানো। প্রায় ২০০ বর্গ ফুট জায়গা রয়েছে বাড়িটিতে। দুটো বাচ্চা সমেত চারজনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে দুটো ঘরে।
স্লাইডিং দরজা, বাথরুম আর কিচেন ক্যাবিনেটও রয়েছে। টিভি, ইন্টারনেট পরিসেবাও পাওয়া যাবে এই পাখির বাসায়। বাড়ির ভিতরে ঢুকতে এক বিশেষ সিঁড়িতে করে উঠে আসতে হয়। একনজরে, জঙ্গল অ্যাডভেঞ্চারের পুরো মজা আর রোমাঞ্চ রয়েছে এই পাখির বাসার ভিতরে।
পাথরবাড়ি, পর্তুগাল
পর্তুগালের উত্তরে কাজা দো পেনেদো শহরের প্রান্তে রয়েছে ফাফ পাহাড়। সেই পাহাড়ের ঢালে পাথর কেটে বানানো হয়েছে এক বাড়ি। চারটে গ্রানাইট পাথর আর মাথায় কংক্রিটের ছাদ। এই হলো বাড়ির কাঠামো। তবে ছাদ কংক্রিটের কিনা, তাই নিয়ে মতভেদ আছে। বাড়ির জানালায় আবার বুলেটপ্রুফ কাঁচ লাগানো। ঘরের ভিতর ‘ফায়ার প্লেস’ এর ব্যবস্থা রয়েছে। একটা বড় পাথর কেটে সুইমিং পুলও বানানো হয়েছে।
পাহাড়ের প্রায় দু’হাজার ফুট উঁচুতে রয়েছে এই স্টোন হাউস। স্থানীয়ভাবে পাথরের এই বাড়িটি ‘সেলরিকো দো বাস্তু’ নামে পরিচিত। এখন অবশ্য সে বাড়িতে কেউ থাকে না। কিন্তু ১৯৭২ সালে এটি তৈরি হয়েছিল অবসর সময় কাটানোর জন্য। দু’বছর লেগেছিল বাড়িটি তৈরি করতে।
পাথরে বাড়িটির আসল মালিক কে ছিলেন, সেটি জানা যায়নি। তবে এখন স্থানীয় প্রশাসন এটিকে মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার করছে। সেখানে পুরনো ছবি আর স্থানীয় ইতিহাসের কিছু স্মারক রাখা আছে।
বলা হয়ে থাকে, বাড়িটি বানানো হয়েছিল গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের বিখ্যাত মার্কিন কমিকস ‘ফিন্টস্টোনস’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। পর্তুগালের স্টোন হাউস বাড়িটিতে এই কমিকসের অনুকরণে পাথরের বাড়ি, পাথরের আসবাবপত্র, পাথরের বাসন-কোসন এমনই পাথুরে সব জিনিসপত্র দিয়ে সাজানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাথরের আসবাব আর সিঁড়ি রয়েছে, যাতে ফিন্টস্টোনসের প্রভাব খুব স্পষ্ট। এখন সারা বছর পর্যটকদের আনাগোনা চলে এই পাথুরে বাড়িকে কেন্দ্র করে।
ফিচার ইমেজ: Pinterest.com