ওড়ছা, ভারতের মধ্য প্রদেশে অবস্থিত ছোট্ট একটি শহর। ভূ-রাজনৈতিক নানা বাস্তবতায় এবং ইতিহাসের বিভিন্ন উত্থান-পতনে শহরটি হয়তো আমাদের কাছে আজ ততটা পরিচিত নয়, কিন্তু এখনো শহরটিতে যে কেউ প্রবেশ করলে অবাক ও বিস্ময় দৃষ্টিতে শহরের ঐতিহাসিক অট্টালিকাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হন; কেননা এসব অট্টালিকা বয়সের দিক থেকে যেমন মধ্যযুগীয়, স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও তেমনি দৃষ্টিনন্দন। এসব অট্টালিকার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রাজপ্রসাদ, দুর্গ, উপাসনালয় ও ঋষি-মনিষীদের আশ্রম।
আর এসব স্থাপত্যকে ঘিরে প্রচলিত আছে নানা লোককথা; যার মধ্যে কোনোটি তুমুল বীরত্বগাঁথা, কোনোটি ভূতুড়ে, আবার কোনোটি রোমান্টিক উপাখ্যানের বর্ণনায় ভরপুর। তবে লোককথা ছাপিয়ে শহরটি মুখ্য হয়ে ওঠে তার ঐতিহাসিক গুরুত্বের কাছে; যেন ওড়ছার প্রতি বর্গ মিটারে লুকিয়ে আছে একাধিক উজ্জ্বল ইতিহাসের শ্লোক; বিশেষত আগ্রা ও উদয়পুরের চেয়েও এখানকার প্রতি ইঞ্চি মাটি ইতিহাসের খনিজ সম্পদে ভরপুর।
প্রথমেই খাজুরাহোর কথা বলা যাক, শহরের এ অংশটি কামোদ্দীপক ভাস্কর্যের জন্য জগত বিখ্যাত। এখান থেকে পাওয়া অনেক ভাস্কর্য সারা বিশ্বে এতটাই পরিচিতি লাভ করেছে যে, তা কখনো কখনো সমগ্র ওড়ছা শহরকে ছাপিয়ে যায়। এখানে হিন্দু ও জৈন ধর্মের অনেকগুলো মন্দির রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, মধ্যযুগে এখানে প্রায় ৮৫টি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে ২২টি এখনো বিদ্যমান।
চন্দেল রাজবংশের শাসনামলে এসব মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এসব মন্দির ক্রমান্বয়ে অব্যবহৃত হয়ে পড়তে থাকে এবং জায়গাটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত ভূমিতে পরিণত হয়। ফলে জায়গাটি ঘন জঙ্গলে আবৃত হয়ে যায় এবং মন্দিরগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। এছাড়া কিছু মন্দির ক্রমশ মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়।
১৮ শতকে ভারতে ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রিটিশ সার্ভেয়ার টি. এস. বার্ট স্থানীয় হিন্দু পণ্ডিতদের তথ্যানুসারে এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে অত্র অঞ্চলের জঙ্গল পরিষ্কার করেন এবং মন্দিরগুলো পুনরায় উদ্ধার করেন। এ সময় মন্দিরগুলো থেকে অসংখ্য মূল্যবান ভাস্কর্য উদ্ধার করা হয়। সমগ্র ভারতে যে সকল কামোদ্দীপক ভাস্কর্য পাওয়া যায় তার অধিকাংশ এই মন্দিরগুলো থেকে প্রাপ্ত অথবা এখানে প্রাপ্ত ভাস্কর্যের অনুকরণে নির্মিত। ১৯৮২ সালে ইউনেস্কো এই মন্দিরগুলোকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা করে।
খাজুরাহো থেকে কিছুদূর পশ্চিম দিকে গেলে দেখা মিলবে বেতুয়া নদীর। এই নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী ওড়ছা দুর্গ। ১৫০১ সালে বুন্দেলা রাজবংশের অন্যতম শাসক রুদ্র প্রতাপ সিং এই দুর্গটি নির্মাণ করেন। বৃহৎ এই দুর্গের অভ্যন্তরে রয়েছে রাজা মহল, শীষ মহল, জাহাঙ্গীর মহলসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। রাজা মহলের একাংশ বর্তমানে মন্দির হিসেবে ব্যবহার করা হয়; যার নাম ‘রাম রাজা মন্দির’। এছাড়াও সেখানে রয়েছে একটি বৃহৎ প্যাভেলিয়ান ও রাজ-রানীদের ব্যবহৃত সুদৃশ্য বাগান।
রাজা রুদ্র প্রতাপ সিং এই দুর্গকে ওড়ছা সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন এবং এখানেই রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। সম্ভাব্য শত্রুদের হাত থেকে রাজ্যকে নিরাপদ রাখার জন্য তিনি দুর্গের দেয়ালকে মজবুত ও দুর্ভেদ্য গাঁথুনি দ্বারা নির্মাণ করেছিলেন। এজন্যই এখনো সেই দুর্গ স্বমহিমায় টিকে আছে। এমনকি এখন পর্যন্ত দুর্গটিতে বড় ধরনের কোনো সংস্কার করতে হয়নি।
দুর্গটি নির্মাণের পর সেখানে ধারবাহিকভাবে অনেক রাজা-রানী ও তাদের বংশধররা বসবাস করেছেন। তাদের সেবার জন্য নিয়োজিত ছিল অসংখ্য কর্মকর্তা, চাকরবাকর, উন্নত প্রজাতির ঘোড়া ও হাতি। তাদের সকলের জন্য এখানে গড়ে তোলা হয়েছিল উন্নত আবাসস্থল। দুর্গের ভেতর প্রবেশ করলে প্রথমে চোখে পড়ে একটি সুবিশাল উঠান। উঠানের একপাশে অবস্থিত রাজা মহল; এটি রাজ প্রসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তার পাশে রয়েছে রাজ দরবার ভবন; এখানে বসে রাজাগণ তাদের রাজ্য পরিচালনা ও বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।
সমগ্র দুর্গ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। এসব ভাস্কর্যে দেব-দেবী, বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র, মানবজাতি, পশু-পাখি ও নানা সামাজিক প্রেক্ষাপট ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রাজপ্রাসাদের একটি কক্ষের চার দেয়াল এখনো এমনভাবে আয়না দিয়ে আবৃত আছে যে, সেখানে প্রবেশ করলে আপনার কল্পনায় রাজনর্তকীদের মনোমুগ্ধকর নৃত্যের দৃশ্য এখনো ভেসে উঠবে; আর আপনি তার চারিধারে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় দুলতে থাকবেন!
রাজা মহল থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে জাহাঙ্গীর মহল অবস্থিত। এই প্রাসাদটি মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সৌজন্যে নির্মাণ করা হয়েছিল। তার নামাঅনুসারেই প্রসাদটির নামকরণ। সম্রাট জাহাঙ্গীর কোনো এক রাতে ওড়ছা শহর পরিদর্শন করতে এসেছিলেন, তখন তাকে খুশি করার জন্য স্থানীয় রাজারা এই প্রসাদটি নির্মাণ করেছিলেন, অর্থাৎ তাকে উপহার দিয়েছিলেন।
চারতলা বিশিষ্ট এই ভবনটি মুসলিম ও স্থানীয় রাজপুত রাজবংশের স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাসাদের বারান্দা ও জানাল দিয়ে পার্শ্ববর্তী বেতুয়া নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সম্ভবত রাতের বেলায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের আগমন কিংবা তার রাত্রিযাপনের কথা বিবেচনা করেই এ জায়গাটি বেছে নিয়েছিলেন ওড়ছার স্থানীয় রাজারা।
ভবনের পেছনের দিকে রয়েছে রাজকীয় হাম্মামখানা। তার পাশেই মোঘল হেরেমের বিখ্যাত তাওয়ায়েফ বা নর্তকী পারভিন রায়ের বাসস্থান। সেখানে মোঘল ঐতিহ্য অনুসরণে নির্মাণ করা হয়েছিল পারভিন মহল। পারভিন মহলের জানালা সবসময় উন্মুক্ত থাকতো, আর তার পাশে ছিল বৈচিত্র্যময় এক বাগান। পারভিনের উত্তাল নৃত্য মোঘল সম্রাটদের মন ছুয়ে যেন সেই বাগানের বৃক্ষগুলোকেও আন্দোলিত করতো। পারভিন মহলের দেয়ালে আজও পারভিনের প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে, যেখানে নৃত্যরত পারভিনকে সেবা করতে দেখা যায় অন্য দুই সেবক- সেবিকাকে।
দুর্গের ঠিক পাশেই অবস্থিত পাথরের তৈরি সুউচ্চ উপাসনালয় ‘চতুর্ভুজ মন্দির’। হিন্দুদের চার হাত বিশিষ্ট ভগবান বিষ্ণুর অনুসরণে এই মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছে চতুর্ভুজ মন্দির। ১৭ শতকে রাজপুত বংশের রাজা মধুকর শাহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। এছাড়া দুর্গের অভ্যন্তরে ‘রাম রাজা মন্দির’ নামে আরেকটি মন্দির রয়েছে, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
চতুর্ভুজ মন্দির থেকে রিকশাযোগে মাত্র ১০ মিনিট পথ অতিক্রম করলে চোখে পড়ে ‘লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির’। এর স্থাপত্য শৈলীর সাথে ওড়ছা দুর্গের মিল পাওয়া যায়। মন্দিরটির ছাদের গঠনপ্রণালী পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। কয়েক বছর আগে সেখানে একবার চুরির ঘটনা ঘটে, তারপর সেখান থেকে দেব-দেবীর মূল্যবান ভাস্কর্যগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর নামানুসারে এই মন্দিরটির নামকরণ করা হয়েছে।
এছাড়া আরও অসংখ্য ছোট-বড় স্থাপত্যশিল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ওড়ছা শহরের অলিতে-গলিতে; বিশেষত ওড়ছা শহরের সাধারণ বাড়ি-ঘরগুলোও কনক্রিট দ্বারা নান্দনিক নকশায় তৈরি। এসব ঐতিহাসিক স্থাপনাকে ঘিরে শহরটিতে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে পর্যটকদের সংখ্যা। তাদের সেবা দিতে সেখানে স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে দেশটির সরকার।
পরিশেষে ‘ছত্রী’র কথা উল্লেখ করতে হয়; এটি ভারতের মধ্য প্রদেশ অঞ্চলের স্থানীয় রীতিতে নির্মিত একধরনের স্মৃতিস্তম্ভ। এগুলোর উপরিভাগ দেখতে অনেকটা ছাতার মতো, এজন্যই একে ছত্রী বলা হয়। মধ্যযুগে নির্মিত এসব স্মৃতিস্তম্ভে সাধারণত স্থানীয় রাজাদের সমাহিত করা হতো। ওড়ছা শহরে এমন ১৪টি ছত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়। সম্ভবত সেসব ছত্রীতে ওড়ছার ১৪ জন বিশিষ্ট রাজা শায়িত আছেন। এটি ওড়ছা শহরের জন্য একটি সৌভাগ্যের ব্যাপার বটে! যাদের হাত ধরে এই শহরটির উত্থান হয়েছিল, তারা সেখানেই এখনো স্বমহিমায় শায়িত আছেন।